মালয়েশিয়ার নির্বাচন ও আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রত্যাবর্তন
মো. হাসান তারেক
কয়েকদিনের নাটকীয়তা শেষে গত ২৪ নভেম্বর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন বিরোধী জোট পাকাতান হারাপানের নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম। জাতীয় নির্বাচনের পাঁচদিন পর ইস্তানা নেগারা রাজপ্রাসাদে রাজা আল-সুলতান আবদুল্লাহ তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন এবং তাকে শপথ বাক্য পাঠ করান।
মালেশিয়ায় কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলছে। প্রায় সাড়ে চার বছরে মালয়েশিয়ায় আমরা তিনজন প্রধানমন্ত্রীকে দেশ চালাতে দেখেছি, যা দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিরসনের লক্ষ্যেই গত শনিবার দেশটিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হলেও কোনো দল বা জোটই এই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।
এই নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায়, আনোয়ার ইব্রাহিমের সরকারবিরোধী জোট পাকাতান হারাপান ২২২টি আসনের মধ্যে ৮২টি আসন পেয়ে প্রথম হয়। এরপর ৭৩টি আসন নিয়ে দ্বিতীয় হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের পেরিকাতান ন্যাশনাল। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন জোট বারিসান ন্যাশনাল ৩০টি আসন নিয়ে তৃতীয় হয়।
নির্বাচনের পর আনোয়ার ইব্রাহিম ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার দাবি করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের কেউই সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১১২টি আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখাতে পারেননি। ফলে মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে যায়।
মালয়েশিয়ার সংবিধান অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলগুলো সরকার গঠনে ব্যর্থ হলে রাজা হস্তক্ষেপ করেন। এ রকম পরিস্থিতিতে, মালয়েশিয়ার রাজা এমন একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে পারেন, যাকে তিনি বিশ্বাস করেন যে সে আইন প্রণেতাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে। এখানে উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ায় একটি অনন্য সাংবিধানিক রাজতন্ত্র রয়েছে, যেখানে নয় রাজ্যের রাজপরিবার থেকে রাজাদের বেছে নেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক রাজা পাঁচ বছরের জন্য রাজত্ব করেন।
২০১৯ সালে রাজা আল-সুলতান আবদুল্লাহ সুলতান আহমেদ শাহ ৫৯ বছর বয়সে মালয়েশিয়ার সিংহাসনে আরোহণ করেন। ১৯৫৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর তিনি দেশটির ১৬তম রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বর্তমান রাজা এবারের এই রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটাতে প্রধান দুই জোটের নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম ও মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে দীর্ঘ দুই ঘণ্টার বৈঠকেও কোনো সিদ্ধাতে পৌঁছাতে পারেনি প্রধান এই দুই জোট। এরপর বিষয়টি রাজার এখতিয়ারে চলে যায় এবং তিনি মালয়েশিয়ার দশম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আনোয়ার ইব্রাহিমের নাম ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে আনোয়ার ইব্রাহিমের দীর্ঘ তিন দশকের প্রতীক্ষার অবসান হলো।
মালয়েশিয়ার জননন্দিত রাজনীতিবিদ আনোয়ার ইব্রাহিম একজন ভাগ্যবিড়ম্বিত নেতা। আনোয়ার ইব্রাহিম প্রথম নিজের নামটি তৈরি করেন একজন সম্মোহনী ও আগুনের মতো জ্বলে ওঠা ছাত্রনেতা হিসেবে। ছাত্র থাকাকালীন তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মালয়েশিয়ার মুসলিম তরুণদের সংগঠন ‘আনকাতান বালিয়া ইসলাম মালয়েশিয়া’। এরপর সবাইকে একরকম অবাক করে দিয়ে ১৯৮২ সালে তিনি যোগ দেন ‘ইউনাইটেড মালায়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে (ইউএমএনও)’।
১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বহু পুরোনো ইউএমএনও দলে যোগ দেওয়া ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের একটি বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। কেননা, এখানে তিনি দ্রুত নিজেকে রাজনৈতিকভাবে প্রস্ফুটিত করার সুযোগ পান। স্বল্প সময়ের মধ্যে একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনের সুযোগ হয় তার। ১৯৯৩ সালে তিনি মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী হন। সেসময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। তখন ধারণা করা হতো মাহাথির মোহাম্মদের পর হয়তো তার জায়গা নেবেন ক্যারিশম্যাটিক নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম। তবে ১৯৯৭ সালের অর্থনৈতিক সংকট তার এই অভিপ্রায়ে বাদ সাধে।
আর্থিক সংকট মোকাবিলা নিয়ে মতবিরোধের জেরে তাদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। অবশেষে ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ আনোয়ার ইব্রাহিমকে সরিয়ে দেন উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে। পরে আনোয়ার ইব্রাহিম মাহাথির মোহাম্মদের বিপক্ষে গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এই আন্দোলনই মালয়েশিয়ার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি প্রজন্মকে উৎসাহিত ও বেগবান করেছিল। আন্দোলনের নেতা হিসেবে আনোয়ার ইব্রাহিম গ্রেপ্তার হন এবং তার বিপক্ষে সমকামিতা ও দুর্নীতির মামলা করা হয়। যদিও শুনানিতে আনোয়ার ইব্রাহিম তার ওপর আনীত অভিযোগগুলো অস্বীকার করেন।
যেহেতু মুসলিম প্রধান দেশ মালয়েশিয়ায় সমকামিতার কার্যক্রমগুলো অপরাধ হিসেবে গণ্য করে, তারপরও তাকে মামলাগুলোতে দোষী সাব্যস্ত করা কঠিন হয়ে গেলো প্রমাণের অভাবে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জানালো আনোয়ার ইব্রাহিম রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। এরপরও তার ছয় বছরের কারাদণ্ড হলো। ফলে সহিংস সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে দেশের রাস্তায়।
২০০৪ সালের শেষ দিকে মাহাথির মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হলে দেশের সুপ্রিম কোর্ট সমকামিতার মামলায় ভিন্ন অবস্থান নেয় এবং কারাগার থেকে মুক্ত হন আনোয়ার ইব্রাহিম। কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর নতুন একটি বিরোধী দলের প্রধান হিসেবে আবির্ভূত হন আনোয়ার ইব্রাহিম।
২০০৮ সালের নির্বাচনে তার এই দলটি শক্ত অবস্থানের জানান দিলে ওই বছরই আবার তার বিপক্ষে সমকামিতার অভিযোগ তোলা হয়। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে তার বিপক্ষে তোলা অভিযোগগুলো প্রমাণের অভাবে আবার খারিজ করা হয়। এর পরের বছর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তার নেতৃত্বের বিরোধী দল অনন্য অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ২০১৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের প্রাক্কালে আনোয়ার ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে আনা সমকামিতার অভিযোগ খারিজের আগের রায় স্থগিত করে তাকে আবার জেলে পাঠানো হয়। কিস্তু ২০১৮ সালে মালয়েশিয়ার রাজনীতি এক আশ্চর্যজনক মোড় নেয়।
ওই বছরের নির্বাচনে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে বারিসান ন্যাশনাল পার্টিকে ক্ষমতাচ্যুত করার দাবির মাঝে ঐকমত্যে পৌঁছান মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয়ার ইব্রাহিম। ওই নির্বাচনে জয়ের পর রাজকীয় আদেশে আনোয়ার ইব্রাহিমকে সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে দুই বছরের মধ্যে তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দেন মাহাথির মোহাম্মদ। কিন্তু তার আগেই তাদের জোট ভেঙে যায়।
ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরোধিতার মুখে আনোয়ার ইব্রাহিমকে আবার ত্যাগ করেন মাহাথির মোহাম্মদ। পরে জোট সরকারের পতনের পর ক্ষমতায় আসেন ইউনাইটেড মালায়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও)। নতুন প্রধানমন্ত্রী হন মুহিউদ্দিন ইয়াসিন। তবে এক বছর পরই পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে পদত্যাগ করেন তিনি। এরপর প্রধানমন্ত্রী হন ইউএমএনওর ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব। চলতি বছরের অক্টোবরে আগাম নির্বাচনের ডাক দিয়েছিলেন তিনি, সে ডাকেই এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো যে নির্বাচনের মাধ্যমে ফিনিক্স পাখির মতো প্রত্যাবর্তন করলেন আনোয়ার ইব্রাহিম।
তবে, আনোয়ার ইব্রাহিমকে সামনে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য। প্রথমত, আনোয়ার ইব্রাহিমকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দিতে হবে। যেহেতু, তার নিজের জোট পাকাতান হারাপান ৮২টি আসন পেয়েছে এ কারণে তাকে অন্য কারও সঙ্গে জোট করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে হবে। এক্ষেত্রে বারিসান দল উপযুক্ত অপশন।
কেননা, ইতিমধ্যে বারিসান দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা মুহিউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন করবে না। দ্বিতীয়ত, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ অর্থনীতিতে গতি ফেরানো হবে তার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। তৃতীয়ত, বিগত কয়েক বছর ধরে মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে তাতে স্থিতিশীলতা ও স্বস্তির সুবাতাস ফেরানো হবে তার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আশা করা যায়, আনোয়ার ইব্রাহিম তার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বশৈলী ও পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মালয়েশিয়াকে সঠিক পথেই পরিচালিত করবেন।
লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা।
এইচআর/ফারুক/এমএস