ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ব্যাংক চলে জনগণের আস্থায়

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ০৯:৩৫ এএম, ০৩ ডিসেম্বর ২০২২

হঠাৎই ব্যাংক বড় খবর হয়ে উঠেছে। মাত্র ২৫ হাজার টাকা ঋণখেলাপির দায়ে পাবনার ১২ কৃষকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় এবং পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। পরে অবশ্য এই ১২ জনসহ মোট ৩৭ জন কৃষকের জামিন হয়েছে। বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক নামের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সামান্য ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারেননি এই কৃষকরা।

এমন এক খবরে মনে হতে পারে বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি ঋণ আদায়ে খুবই সংকল্পবদ্ধ। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। বাংলাদেশের ব্যাংক ঋণ জালিয়াতি এখন সবার মুখে মুখে। বুধবার এই লেখা লেখার দিনই খবর বের হলো যে, এস আলম গ্রুপ একাই ইসলামি ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। সমস্যাটি ঋণ নেওয়ায় নয়, বরং কীভাবে নেওয়া হচ্ছে, কারা নিচ্ছে সেটাই আলোচ্য। দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদন, ইসলামী ব্যাংকে ভয়ংকর নভেম্বর প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর আরও আরও পত্রিকা ও মিডিয়া এখন রিপোর্ট করছে। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী নভেম্বর মাসের মাত্র দুই সপ্তাহে তিন ইসলামি ধারার ব্যাংক থেকে বেনামে ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা ঋণ গেছে, যেখানে গ্রহীতাদের ঠিকানাই নেই।

শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাস ছেলে কোম্পানি গঠনের ১৪ দিনের মাথায় ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ পেয়েছে ৯০০ কোটি টাকা। জামানতের প্রয়োজন হয়নি, লাগেনি কোনো ক্রেডিট রিপোর্ট। কোম্পানির ঠিকানায় কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যায়নি।

নথিপত্রে মালিকের জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা টেলিফোন নম্বরও নেই। এমন তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ৯০০ করে মোট ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে ইসলামী ব্যাংক থেকে। ছয় বছরে প্রতি বছর গড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হলেও গত এক বছরেই ঋণ দেওয়া হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা।

একটি টেলিভিশন টকশোতে দেখলাম একজন সাবেক ব্যাংকার বলছেন, এই টাকাগুলো পাচার হয়ে যাচ্ছে। এমন এক অবস্থায় মনে হচ্ছে কিছুটা নড়চড়ে বসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নাবিল গ্রুপসহ আট প্রতিষ্ঠানকে ইসলামী ব্যাংক থেকে অনিয়মের মাধ্যমে আগ্রাসী ঋণ দেওয়ার ঘটনা তদন্ত করার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু অর্থমন্ত্রী যখন সাংবাদিকদের বলেন, ব্যাংকের অবস্থা কোথায় খারাপ, লিখিত দিয়ে যান, আমরা খতিয়ে দেখব, তখন আমাদের বিস্মিত ও ব্যথিত হতে হয়।

সাংবাদিকরা রিপোর্ট করেছেন, এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ সেটা অনুসন্ধান করা। সাংবাদিকরা কেন তাকে লিখিত দিতে যাবেন? অথচ সম্প্রতি বেসিক ব্যাংকের অর্থপাচারের মামলার শুনানিকালে হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেছেন, সব ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, আমরা কি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবো? এটা কি হয়? আদালত বলেন, এসব অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন যা করছে তাতে মনে হয়, আমরা নাটক দেখছি। হাততালি দেওয়া ছাড়া আর কী করার আছে।

বড় বড় ঋণ জালিয়াতির ঘটনা, ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনা অনেকদিন ধরে আলোচনায়। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে বেসিক ব্যাংক, ফার্মার্স ব্যাংক লোপাটের ঘটনা আমরা জানি। বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ক্রিসেন্ট গ্রুপের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে না ফেরত দেওয়ার অভিযোগ অনেকদিনের। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট করে দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় দেশের আর্থিক খাতে আলোচিত নাম প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার।

এসব ঘটনা এমন একটি স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল খাত সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক ধারণা পোক্ত করছে। ব্যাংক চলে জনগণের আস্থায়, সেটা একবার নষ্ট হলে বড় বিপদ। অর্থব্যবস্থায়, বিশেষ করে আর্থিক সংকটের সময়ে, ব্যাংকের ভূমিকা যে গুরুত্বপূর্ণ তা নতুন করে বলার কিছু নেই। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং খোদ উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপকদের সবসময় সতর্ক থাকতে হয়, যাতে কোনোভাবেই ব্যাংক যেন বিপদে না পড়ে।

সাবধান এ কারণে থাকতে হয় যে ব্যাংকের সৃষ্টির মধ্যেই এর বিনাশ লুকোনো থাকে। ব্যাংক গ্রাহকদের নানা সেবা দিয়ে থাকে। তবে এর মূল ব্যবসা ঋণ দেওয়া ও তা সুদসহ ফেরত নেওয়া। ব্যাংকের কাছে মানুষ তার সঞ্চয় গচ্ছিত রাখে। তার বিনিময়ে সে একটি পূর্ব-ঘোষিত কিন্তু সময়ে-সময়ে পরিবর্তনযোগ্য হারে সুদ দেয়।

গ্রাহকরা চাইলে তাদের সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে যেকোনো সময় আমানত তুলতে পারেন। আমানতকারীদের সুদ মেটাতে গেলে ব্যাংকের আয় দরকার। সেই আয় আসে ঋণ থেকে। বিনিয়োগকারীদের মূলধনের প্রধান উৎস ব্যাংক থেকে থেকে নির্দিষ্ট সুদের বিনিময়ে ঋণ।

এমন একটি সিস্টেমে যখন মালিক নামের লোকদের আধিপত্য সৃষ্টি হয়, তখন সেটা নিয়ে ভাবতে হয়। কোনো এক সকালে যদি সব আমানতকারী তাদের গচ্ছিত টাকা ফেরত চান, পৃথিবীর সেরা ব্যাংকও তা দিতে পারবে না। কারণ, গ্রাহকদের জমা রাখা আমানত থেকেই তো ব্যাংক ঋণ দিয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদের সে সব ঋণ তো চাওয়ামাত্রই ফেরত পাওয়া যাবে না। তাই ঋণ তাদেরই দিতে হয় যাদের ক্যাশ ফ্লো ভালো, যারা ঋণ যথাসময়ে ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা রাখে।

ব্যাংক খাতের সাম্প্রতিক যেসব ঘটনা বের হচ্ছে, তা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে ক্ষমতা আছে তার প্রয়োগ দেখতে চায় মানুষ। যে বোর্ড এসব ঋণের অনুমোদন দিয়েছে সেই পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশাসক নিয়োগ জরুরি হয়ে পড়েছে; যে কর্মকর্তারা এসব ঋণ ছাড় করেছেন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার এখনই।

মনে রাখা দরকার জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ পেতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেন একশ্রেণির ব্যাংক কর্মকর্তাই। আদেশ করেন পরিচালকদের কেউ কেউ। এদের শাস্তি পেতে হবে।

শুধু মামলা করাই যথেষ্ট নয়, বড় অঙ্কের জালিয়াতি রোধে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিও আরও বাড়ানো প্রয়োজন।

ব্যাংক খাতে জাল-জালিয়াতির প্রবণতা কমাতে হলে বড় অঙ্কের ঋণের ওপর তদারকি বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভাবতে হবে কীভাবে সামগ্রিক আর্থিক খাতে জালিয়াতি রোধে আরও কার্যকর হওয়া যায়।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

এইচআর/এমএস/ফারুক