ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মাছের বিনিময়ে মাদক ও চিনি বেশি দিয়ে চা

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | প্রকাশিত: ০৯:৪৭ এএম, ৩০ নভেম্বর ২০২২

সেদিন সকালে টিভিতে চোখ রেখে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম। এমন সময় পত্রিকাওয়ালা বারান্দায় পত্রিকা ছুড়ে দিয়ে কলিংবেল টিপে দ্রুত চলে গেলো। আমি একাই নিচে থাকায় চায়ের কাপ হাতে পত্রিকাটি কুড়িয়ে নিয়ে সোফার টেবিলে রাখতেই একটি শিরোনামের দিকে চোখ আটকিয়ে গেলো। তা হলো- ‘মাদকের জন্য সীমান্তে ছুটোছুটি’।

ভাবলাম হয়তো পুলিশের ভয়ে মাদকসেবীরা ছুটে পালাচ্ছে- এমন বিষয়। লেখাটির ভেতরে কি আছে তা জানার জন্য আগ্রহী হলাম। পড়ার চশমাটা নাকে টেনে দিয়ে এক নিঃশ্বাসে প্রথম পাতার লেখাগুলো পড়ে ফেললাম। ভেতরের পাতায় যাওয়ার আগে বোঝা গেলো পরিবেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করে দ্রুত পারিবারিক ও সামাজিক ভাঙন সৃষ্টি করার প্রধান বাহক হচ্ছে অবাধে মাদকের অনুপ্রবেশ ও সেগুলোর যথেচ্ছ ব্যবহার।

নানা কথা ভাবতে ভাবতে ভেতরের পাতায় চোখ বুলাতে লাগলাম। প্রথমে মনে করেছিলাম বর্তমানে মাদকের বিষয়টি তো কক্সবাজার বা টেকনাফের নাফ নদীর সীমান্ত পথে বা নদীতে অথবা বেনাপোল বা সাতক্ষীরা এলাকায় পাচারকারীদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ বা ফলোআপের ব্যাপার। কিন্তু নয়। ঘটনাটি উত্তরের শান্ত জেলা দিনাজপুরের সীমান্ত এলাকার।

এই জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোতে মাদকসেবী ভয়ানক রকম বেড়ে গেছে। তারা প্রতিদিন সূর্য ডোবার জন্য হা করে থাকে। অন্ধকার নামলেই মাদক সেবনের জন্য চলে যায় চেনা গন্তব্যে। মাদক চালানের অনুপ্রবেশ, সংগ্রহ, মজুত, ব্যবসা, বিক্রি, ভোগ, অসুস্থতা, চিকিৎসা, সামাজিক ও পারিবারিক অস্থিরতা সবকিছুতেই কোথায় জানি একটা অদেখা ছন্দ বিরাজমান। সেটা হলো- সব পর্যায়ে সব বেনিফিসিয়ারিরা বলেন, এটা খারাপ কাজ। আমরা এর বিরুদ্ধে প্রচেষ্টা চালাই। কিন্তু কার্যত তাদের সিংহভাগই নির্দিষ্ট ছন্দ মেনে সন্তর্পণে মাদকের পক্ষেই কাজ করেন- নিজেদের অবৈধ বখরা প্রাপ্তি বা লাভের আশায়।

তারা সবকিছু অস্বীকার করলেও তারাই মাদকের শিকারি। সংকেতধারী, টর্চধারী, হুইসেলধারী, লাঠিয়াল, বন্দুকধারী, সবাই যেন মাদকের চেনা স্টেকহোল্ডার। ভাগবাটোয়ারাপ্রাপ্ত সুবিধাভোগী এই গোষ্ঠীর নিবিড় ছায়াতলে মাদকের অনুপ্রবেশ, বিচরণ, বিস্তার, ব্যবহার আমাদের সমাজকে দিন দিন পঙ্গু করে দিচ্ছে। সবাই চরম সত্যটাকে অস্বীকার করে প্রতারণার ফাঁদ পেতে মাদক নিয়ে অন্যায় করতে বদ্ধপরিকর। কি বৈপরিত্য! কি কপট ভূমিকা আমাদের মধ্যে!

সীমান্তের ওপার থেকে লাইন ক্লিয়ারেন্সের সংকেত পেলে এপারের ‘ভারী’-রা হামাগুড়ি দিয়ে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে চলে যায়। যারা বেড়ার কাছ থেকে মাদকের ব্যাগ-বস্তা বা প্যাকেট (ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, মদ, নেশাজাতীয় ইন্জেকশন) কুড়িয়ে সীমান্তের বাফার স্টেটের ৫০০ মিটার ভেতরে নিয়ে এসে একটি নিরাপদ ঝোপ-ঝাড়, পুকুর, ধানক্ষেত ইত্যাদিতে লুকিয়ে ফেলার কাজ করে তাদের ‘ভারী’ বলা হয়।

এক ভারী বলেন, ‘এক রাতে ১০০ বোতল ফেনসিডিল সীমান্ত থেকে ৫০০ মিটার দূরত্বে সরিয়ে আনতে পারলে মহাজনের কাছ থেকে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়’। তাই এরা দিনের বেলা নাক ডেকে ঘুমায়। সন্ধ্যা নামলেই ভারীরা লাইন ক্লিয়ারের সংকেত পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। এজন্য কখনও তারা সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেয়।

এগুলো নতুন গল্প নয়। তবে মিয়ানমার, কক্সবাজার, কুষ্টিয়া, বেনাপোল বাদ দিলে উত্তরের দিনাজপুর সীমান্তে মাদকের বিস্তৃতি এসময়ের নতুন গল্প। এতদিন ওই পথে পুরোনো কাপড়, মশলা, ফল, কাশ্মিরী শাল, ওষুধ ইত্যাদির চোরাচালানি হতো। কিন্তু মাদক চালানে লাভের অংক বেশি হওয়ায় সবাই মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

ত্রিপুরা সীমান্ত দিয়ে মাছসহ নানা প্রকার বাংলাদেশী পণ্য রপ্তানি করা হয়। সেখানে মাছের দাম মাদকের বিনিময়ে পরিশোধ করার চমকপ্রদ ঘটনা শোনা যাচ্ছে। ইলিশ মাছ রপ্তানির বিনিময়ে মাদক গ্রহণের ঘটনাটি বেশ ভয়াবহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।’(প্রথম আলো ২৪.১০.২০২২)।

এটা ওপেন সিক্রেট। তবে এই সিক্রেটের বিপদটা হলো সংশ্লিষ্ট সবাই মাদকের অপরাধে অপরাধী হলেও কেউই এজন্য অপরাধী হওয়ার দায় নিতে চায় না। সেজন্য পূর্বপরিকল্পিত ও সাজানো উত্তর সবার মুখে শোনা যায়। ভয়ংকর বিপদের দিকটা এখানেই প্রোথিত। তবে সব দেখে শুনেও অভিমান করে চুপ থাকা অনেক ভালো মানুষও রয়েছেন।

দায়িত্বরত ভালো মানুষদের কারণে কখনো বড় অভিযান চালানো হয়। তবে কোনো অপরাধী সীমান্তে আটকা পড়লে সেখানে পুলিশি অ্যাকশন চলে না। মাদক ব্যবসার টাকার ভাগ পুলিশের কাছেও যায় বলে অভিযোগ করেছে স্থানীয় লোকজন। তবে বিট অফিসার পুলিশের উপপরিদর্শক বলেন, ‘বিজিবির আওতাধীন এলাকায় পুলিশ অভিযান চালাতে পারে না। পরোয়ানাভুক্ত আসামি গ্রেপ্তার করতে গেলেও কৈফিয়ত দিতে হয়। ফলে সেখানে পুলিশের তেমন কিছু করার থাকে না।’ অপরদিকে বিজিবির ৪২ সেক্টর কমান্ডার বলেছেন, ‘মাদক নিয়ন্ত্রিত। আমরা মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছি।’ (প্রথম আলো ০৬.১০.২০২২)।

প্রশ্ন হলো, দায়িত্বরত সবাই যদি এধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার তাহলে স্থল সীমান্ত দিয়ে মাদক ঢুকছে কেন এবং কীভাবে? মাদকের বিস্তৃতিতে নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে যুবসমাজের দেহ-মন। ফুরিয়ে যাচ্ছে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট বা জনমিতিক লভ্যাংশের হিসাব-নিকেশ। এর দায় তো কাউকে না কাউকে নিতেই হবে।

সীমান্তে এত পাহারার মধ্যে ওপার থেকে এদেশে মাদকের চালান ছুড়ে দেয় কারা? সেটা কাদের ইশারায়? ক্লিয়ারেন্সের সংকেত দেয় কে? এসব অবৈধ মাদক নিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ দেয় কে? এসব চালাকি ও প্রতারণার মাধ্যমে মাদক অনুপ্রবেশ করতে থাকলে সীমান্তে দিনরাত বেতনভুক পাহারাদার নিয়োজিত রাখার দরকার কি?

আইনের লোকেরা কঠোর না হয়ে সহায়তা করলে সাধারণ মানুষ তো এটাকে সুবিধা ভেবে জীবন-জীবিকার অবৈধপথ বেছে নেবে। উভয় দেশের পাহারাদাররা সৎ ও নির্ভীক হলে সীমান্ত চোররা মাদক চোরাচালনিতে আস্কারা পায় কীভাবে? আইনের লোকেরা বেআইনি কাজে সহায়তা করায় বিষয়টা দিন দিন বেশি ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে।

মাদকে এত মধু! এজন্য ভারী, মহাজন, লাইনম্যান, সীমান্ত পাহাদার, মাদক সম্রাট, মাদক সম্রাজ্ঞী, ভোক্তাসদৃশ সব মৌমাছি, বোলতা, ভীমরুল, মাছি, পোকা, পিঁপড়া, প্রজাপতি সবাই এই মধু খেতে বেপরোয়া। এজন্য পাহারাদারদের চিহ্নিত মাদক ব্যবসার সীমান্তগুলোতে পোস্টিং পেতে কোটি কোটি টাকা খরচ করার সংবাদ শোনা যায়। এজন্য রেষারেষি, মারামারি এমনকি হত্যাকাণ্ড ঘটে যায়। গত বছর টেকনাফ সীমান্তের ঝাউবনের কাছের চেকপয়েন্টে মেজর সিনহাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। দিনাজপুর সদর উপজেলার দাইনুর সীমান্তে গত ৭ অক্টোবর বিএসএফ নবম শ্রেণির ছাত্র মিনার হোসেন মিনারুলকে (১৬) এবং ০৯ অক্টোবর সাতক্ষীরার খৈতলা সীমান্তের কাছে ভারতের কৈজুরী এলাকায় হাসানুর রহমান (২৫) নামক এক যুবককে গুলি করে হত্যা করেছে। হাসানুর ভারতে আত্মীয় বাড়ি থেকে দেশে ফিরছিল (ইত্তেফাক ০৯.১০.২০২২)। তাকে মাদক চোরাচালানে সন্দেহ করে বিএসএফ গুলি করেছে। অর্থাৎ সীমান্তের মাদক ব্যবসা ভালো মানুষদেরও প্রাণ হরণকারী হিসেবে আবির্ভুক হয়েছে।

মাদক সেবনের কারণে গ্রামাঞ্চলের তরুণরাও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তারা সন্ধ্যায়-রাতে পড়ার টেবিল ছেড়ে মাদকের সন্ধানে মোটরসাইকেলে চড়ে সীমান্ত এলাকার হাট-বাজারে ঘুর ঘুর করছে, ছুটে বেড়াচ্ছে। বাবা-মা, অবিভাবকের গাঁটের টাকা চুরি করে মাদক সেবন করে বাজারে আড্ডা দিচ্ছে। তরল মাদক সেবন করলে মুখে বোঁটকা গন্ধ হয়।

অনেকের নেশার ঘোর কাটে না। কারও কারও মিষ্টির প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়। নেশায় ঢুলু ঢুলু চোখ-মুখে বাড়ি ফিরে কেউ যাতে ধরা না পড়ে এবং তাদের মুখের গন্ধ বুঝতে না পারে সেজন্য তারা দীর্ঘক্ষণ চায়ের দোকানে বসে থাকে। আর ঝিমুতে ঝিমুতে অর্ডার দিয়ে বলে, ‘চিনি বেশি দিয়ে চা দাও- আরেক কাপ’।

চোরাচালনকৃত এসব মাদক সেবনকারীরা আমাদের দেশের স্কুল-কলেজপড়ুয়া উঠতি তরুণ। তারা ক্রমান্বয়ে বেশি বেশি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। তাই সন্ধ্যা নামলেই নেশার প্রভাবে স্নায়ুর উত্তেজনায় নতুনভাবে মাদকগ্রহণের জন্য ছোটাছুটি শুরু করে। সীমান্তের ওপার থেকে ওরা বিষ ছুড়ে দেয়, আমরা কুড়াই আর খাই। দোষটা বেশি আমাদের। আমরা ওদের মাদকের প্রতি অতিমাত্রায় কাবু ও নতজানু। সীমান্ত এলাকার পরিবারগুলোর ১৫-৩৫ বছর বয়সীরা সহজ আয়ের লোভে মাদক চোরাচালানিতে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের মোটিভেশনের মাধ্যমে ফেরানো বেশ কঠিন। সেজন্য আমাদের ঘাটে ঘাটে নিয়োজিত রক্ষক পাহারাদাররা মনোদৈহিক ও নৈতিকভাবে অতি কঠোর না হলে এ অবস্থা থেকে মুক্তির আর উপায় কী?

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। [email protected]

এইচআর/ফারুক/জেআইএম