রোহিঙ্গা সংকট
বিশ্ব সম্প্রদায়কে আন্তরিক হতে হবে
দীর্ঘদিন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিশ্বব্যাপী তেমন কোনো কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল না। তবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওপর গুরুত্বারোপ করে আসেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তাছাড়া সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী অংশগ্রহণ করেন। উত্থাপন করেন পাঁচটি প্রস্তাব। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৬ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক একটি রেজুলেশন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে।
প্রত্যাশা করা হচ্ছে, প্রস্তাবটি মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তা করবে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর দেশটির মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তারও আগে আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর দেশটির ভেতরে ও বাইরে লাখ লাখ আফগান বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যে কারণে ওদিকেও আরেকটি মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি এই মানবিক সংকটগুলোর দিকে নিবব্ধ হওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিশ্বব্যাপী তেমন কোনো কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল না। ফলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামেও বিষয়টি আর জোরালোভাবে আলোচনায় আসছিল না। তবে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর জোরালো ভূমিকার কারণে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। যার ধারাবাহিকতায় এই রেজুলেশন পাস হলো।
২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে তথাকথিত আরসা নাটকের মাধ্যমে রোহিঙ্গা নিধন শুরু হলে পরবর্তী কয়েক মাসে দফায় দফায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এছাড়া গত ৫০ বছরে আরও তিন দফায় প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে ঢুকেছে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এর সঙ্গে প্রতি বছর ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশু যোগ হচ্ছে। তদুপরি, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে দুর্দশা ক্রমেই বাড়ছে।
অন্যদিকে, নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে রোহিঙ্গারা এখন বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। সেদিক থেকে রোহিঙ্গারা আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবারই সহিংসতা এড়াতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকলেও এসব সহিংসতা ও নিপীড়নের অভিযোগ অস্বীকার করেছে মিয়ানমার সরকার। বংশ পরম্পরায় হাজার বছর ধরে বসবাস করা একটি জাতিগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রহীন করার সময় কোনো দেশ কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থা মোটাদাগে বলার মতো কোনো প্রতিবাদ করেনি।
জাতিসংঘও তখন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশ প্রতিবার নেহাতই মানবিকতার প্রশ্নে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। তবে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার এই শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক অভিযানও জোরদার করে।
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে শুরু থেকেই মাঠে রেফারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া চীনের ভূমিকার ওপর জোর দেয় বাংলাদেশ। কিন্তু চীনের পক্ষপাত সব সময়ই মিয়ানমারের দিকে। প্রথম থেকেই চীন বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপনের পরিবর্তে দ্বিপক্ষীয় সমাধানের পক্ষে। যেন বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ভিন্ন খাতে যায়।
রোহিঙ্গা সংকটে চীন কখনোই মানবিক ও সমাধানযোগ্য সদিচ্ছা দেখায়নি, শুধু নিজেদের স্বার্থটাই দেখেছে। নিরাপত্তা পরিষদে তারা বারবার ভেটো প্রয়োগ করেছে, প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছে। অন্যদিকে, দেশটি বাংলাদেশকে বারবার আশ্বস্ত করলেও শুধু তাদের আশকারা পেয়েই মিয়ানমার নানা অজুহাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রেখেছে। একপর্যায়ে চাপ দিয়ে চুক্তি করিয়েছে। অন্তরালে থেকে প্রত্যাবাসন নাটকও করিয়েছে।
তদুপরি, জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও চীন ও রাশিয়ার ভূমিকার কারণে নিরাপত্তা পরিষদ কোনো রকম ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যদিও গাম্বিয়ার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শুনানিতে সম্মতি দেয়।
তবে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অন্তর্বর্তী আদেশ দেওয়ার সময়টায় মিয়ানমারকে সাহস জোগাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশটি সফর করেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। তখন মিয়ানমারের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাসহ কয়েকশ কোটি ডলার প্রকল্পের চুক্তিও সই করে চীন।
ব্যাপারটা এমন যে, যখনই মিয়ানমারের অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক মদত প্রয়োজন পড়ে, চীন তখনই হাজির। রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় হেগের আদালতের অন্তর্বর্তী আদেশ এসেছিল ২৩ জানুয়ারি। অন্যদিকে, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং দেশটি সফর করেন ১৭ জানুয়ারি।
এসব ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করলে বুঝতে সমস্যা হয় না যে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকট থেকে সেদিনই পরিত্রাণ পাবে, যদি কোনো দিন চীন আন্তরিকভাবে চায়। চীন চাইলে রাশিয়াও চাইবে। জাপান বা ভারতের অবস্থান এখানে তেমন প্রভাব ফেলতে পারবে না।
অন্যদিকে, এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় চীনের পাশাপাশি ভারতও সম্প্রতি এক চরম প্রতিযোগিতার লিপ্ত হয়েছে। এটাও আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন ও ভারতের মতো বন্ধু দেশকে কখনও পাশে পায়নি বাংলাদেশ।
চীন ও ভারত চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ হলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে দুটি দেশই কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, সীমান্ত নিয়ে চীনের সাথে ভারতের বিরোধ দীর্ঘদিনের। দেশ দুটি বেশ কয়েকবার যুদ্ধেও জড়িয়েছে। ভারতের আকসাই চিন অঞ্চল ও অরুণাচল প্রদেশকে চীন নিজেদের এলাকা মনে করে। সেকারণে দেশটি লাদাখ ও সেভেন সিস্টার্স নিয়ে চরম নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকে। এ ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে থাকা শিলিগুড়ি করিডোর।
এ করিডোরটি ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে সেভেন সিস্টার্সে যোগাযোগের একমাত্র পথ। চীনের দোকলাম থেকে যার দূরত্ব মাত্র ১৩০ কিলোমিটার। দুর্যোগপূর্ণ সময়ে চীনের চুম্বী ভ্যালিতে মোতায়েন থাকা সেনাবাহিনী শিলিগুড়ি করিডোরের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে পুরো সেভেন সিস্টার্স ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ফলে নিরাপত্তা ও যোগাযোগের কথা চিন্তা করে ভারত কালাদান প্রকল্পের মাধ্যমে সেভেন সিস্টার্সে প্রবেশের বিকল্প একটি পথ তৈরিতে উদ্যোগী হয়।
ভারতের কলকাতা থেকে সমুদ্রপথে মিয়ানমারের সিটওয়ে বন্দর হয়ে কালাদান নদীপথে পালেতোয়া। সেখান থেকে সড়কপথে ভারতের মিজোরাম তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করা যাবে। সংক্ষেপে এই হলো কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্টের রুট। এটার ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে দ্রুত সংযোগ স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ রুট ছাড়াও অন্য একটি বিকল্পও তৈরি থাকলো ভারতের কাছে। এ কারণে ভারতের কাছে দেশটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন খেলায় মিয়ানমারের পক্ষে মূল খেলোয়াড় হচ্ছে চীন। রাশিয়া স্ট্যান্ডবাই, ডাক পড়লেই মাঠে এসে চীনের শক্তি বৃদ্ধি করে। তদুপরি, দীর্ঘ সময় ধরে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের ক্ষমতার উৎস চীন। চীনই বিশ্ব মতামত উপেক্ষা করে তাদের টিকিয়ে রেখেছে। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, কোয়াড জোটের সদস্য জাপানও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষে দল ভারী করেছে।
মূলত, চীন-জাপান-রাশিয়া সবাই তার নিজের স্বার্থেই মিয়ানমারকে রক্ষা করতে চাইছে। রাশিয়া মিয়ানমারের অস্ত্রের বাজার দখলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। নজর আছে খনিজ সম্পদের দিকেও। ইতিমধ্যে রাশিয়ার তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘গ্যাসপম’ মিয়ানমারে অফিস খুলেছে। অন্যদিকে, অং সান সু চির সময়ে, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে প্রচুর অর্থ লগ্নি করেছে জাপান।
পাশাপাশি রাখাইনের মংডুর কাছাকাছি পরিকল্পিত ইকোনমিক জোনে জাপান বিশাল লগ্নিরও পরিকল্পনা করেছে। জাপান জান্তা সরকারের প্রতি সমর্থন না জানালেও খুব একটা বিরোধিতাও করেনি। বর্তমানে চীন-রাশিয়া-জাপান তিন শক্তির প্রতিযোগিতার কারণে মিয়ানমারের একসময়ের সবচেয়ে গরিব অঞ্চল রাখাইন এখন অন্যতম ভূ-কৌশলগত ভূমি হিসেবে সমাদৃত হচ্ছে।
তবে মিয়ানমার সব সময়ই চীনের ওপর নির্ভরশীল থেকেছে। অন্যদিকে, বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে সৃষ্ট নতুন ভূ-রাজনৈতিক ইকুয়েশনের কারণে চীনও মিয়ানমারের ওপর নির্ভরতা দিন দিন বাড়াচ্ছে। মিয়ানমারের শাসকেরা এ সুবিধাই ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছেন।
বিশ্বে প্রভাব বিস্তারে চীনের বিআরআই প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ ধরা হয় মিয়ানমারকে। এটা হচ্ছে ভারত মহাসাগরে চীনের প্রবেশদ্বার। ফলে, চীন নিজের অনুকূল ভূ-রাজনৈতিক যোগ-বিয়োগ থেকে আন্তর্জাতিক আঙিনায় মিয়ানমারের ঢাল হচ্ছে বারবার। এর বিনিময়ে মিয়ানমার থেকে যা চেয়েছে, তা-ই পেয়েছে চীন।
চীনের নতুন ভূ-কৌশলগত পরিকল্পনা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআইয়ের যাত্রা শুরুর পর থেকে মিয়ানমারের বঙ্গোপসাগরতীরের রাখাইন (আরাকান) অঞ্চল বিশ্বের অন্যতম কৌশলগত ভূমিতে পরিণত হয়েছে। রাখাইন-ইউনান গ্যাস পাইপলাইন ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করা তেল পরিবহনের জন্য পাইপলাইন আছে একই পথে। আছে চীনের তৈরি গভীর সমুদ্রবন্দর এবং নির্মাণাধীন রেল ও সড়ক সংযোগ। আফ্রিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যে এ পথের গুরুত্ব দিন দিন বাড়বে।
বর্তমান পৃথিবীতে ‘চীনা ফাঁদ’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানসহ আফ্রিকার বহু দেশ চীন থেকে ঋণ নিয়ে ‘ফাঁদে’ আটকা পড়েছে। বাংলাদেশেও চীনের ঋণ আছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিষ্কার করে বলেছেন, বাংলাদেশ চীনের ‘ঋণ ফাঁদে’ আটকা পড়েনি, পড়বেও না। কিন্তু চীনের ঋণের ফাঁদে আটকা না পড়লেও বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে ‘চায়না ফাঁদে’ যে আটকে গেছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চল কক্সবাজারে ফিলিস্তিনের মতো একটি পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে আরও বড় ফাঁদে ফেলে বিশেষ সুবিধা আদায় করা চীনের পরিকল্পনার মধ্যে আছে কি না, সেটাও ভাবনায় নিতে হবে। ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেসব যুক্তি সামনে আসছে, তাতে এটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তা ছাড়া, এটাও মনে রাখা দরকার, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে যাওয়া পাকিস্তানিদের যেখানে এখনো ফেরত পাঠানো যায়নি, সেখানে এই বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ফেরত পাঠানো যাবে– সেটারই ভরসা কোথায়?
চীন তার ভূ-রাজনীতির স্বার্থে উত্তর কোরিয়ার মতো মিয়ানমারকেও যা খুশি তা করার লাইসেন্স দিলেও মিয়ানমার ধীরে ধীরে পশ্চিমাদের সঙ্গেও সখ্য বাড়িয়েছে। সম্প্রতি মিয়ানমারের এই চালাকি চীন-রাশিয়া বুঝতে পারছে। বাংলাদেশের জোরদার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং চীনের এই বোধোদয়ের সম্ভবত যোগফলই হচ্ছে, সর্বশেষ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে চীনের বিরোধিতা না করা। আর মিয়ানমার প্রসঙ্গে চীন যেদিকে রাশিয়াও সেদিকে এই নীতির কারণে রাশিয়াও বিরোধিতা করেনি। তবে বাংলাদেশকে এইটুকুতে সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। চীন ও রাশিয়ার এই পদক্ষেপ তখনই ইতিবাচক হিসেবে গণ্য হবে যদি নিরাপত্তা পরিষদেও দেশ দুটি একই অবস্থান ধরে রাখবে।
বাংলাদেশে যখন কোনো বিদেশি প্রতিনিধি আসে বা কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তখনই কেবল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আলোচিত হয়, গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়। এর বাইরে পুরো সময়েও তেমন কার্যকর কিছু আর এখন চোখে পড়ে না। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর অভিবাসীদের প্রতি সমগ্র বিশ্বের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়েছে।
এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। বিশ্ব বাংলাদেশের ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর দুর্দশাকে যেন আর উপেক্ষা না করতে পারে সরকারকে সেজন্য কূটনৈতিক পদক্ষেপ আরও জোরদার করতে হবে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোকে বারবার তাগিদ দিচ্ছেন রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য পদক্ষেপ নিতে। সেটাকে আরও জোরদার করার সময় এখনই।
জাতিসংঘে সর্বসম্মতিক্রমে রেজুলেশন পাসের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বার্তা দিয়েছে যে, তারা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ব্যাপারে ইতিবাচক। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চীন, রাশিয়াসহ ভারতের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোও যাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করে, সে কৌশল নিতে হবে। এই দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সেটির সিকিভাগও কাজে লাগানো যায়নি। নিরাপত্তা পরিষদে যদি সদস্য দেশগুলোর ইতিবাচক অবস্থান নিশ্চিত করা যায় তাহলে মিয়ানমার তার অবস্থান পাল্টাতে বাধ্য হবে। কারণ, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব মেনে চলা বাধ্যতামূলক।
লেখক: কলাম লেখক।
এইচআর/ফারুক/এমএস