জঙ্গি ছিনতাই: আলামত সুবিধার নয়
বাংলাদেশে জঙ্গি আছে কি নেই তা নিয়ে এক সময় বিতর্ক উঠেছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকতে দেশে জঙ্গি উত্থানের ষোলকলা পূর্ণ হলেও ঢাকার রাস্তায় তার আগেই স্লোগান উঠেছিল, ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান'। আফগানিস্তান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েই প্রধানত বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার শুরু। এরপর জঙ্গিদের তৎপরতা ও জঙ্গি দমনের অনেক ঘটনা আমরা শুনেছি।
গুলশানের হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে বড় ধরনের কয়েকটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালানো হয়েছিল। তারপর জঙ্গি তৎপরতার তেমন খবর আর পাওয়া না গেলেও জঙ্গিরা নানা উপায়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে, সেটা ঠিক। জঙ্গিদের নিষ্ক্রিয় রাখা গেলেও নির্মূল করা যায়নি। সামরিক বাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর জিয়াউল হকসহ আরও কয়েকজন জঙ্গি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি এড়িয়ে জিহাদের জন্য প্রস্তুত হওয়া থেকে যে নিজেদের বিরত রাখেনি তা বোঝা যাচ্ছে, সর্বশেষ ঢাকার আদালত চত্বর থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনতাইয়ের ঘটনা থেকে।
এছাড়া সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে একের পর এক তরুণ নিরুদ্দেশ হওয়ায় খবর প্রকাশের পরও জঙ্গি তৎপরতার বিষয়টি সামনে আসে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ৫৫ জন তরুণের বাড়ি ছাড়ার তথ্য প্রকাশের পর এ নিয়ে নতুন করে কৌতূহল তৈরি হয়। এত বিপুল সংখ্যক তরুণের ‘নিখোঁজ’ হওয়ার ঘটনা আবার মানুষের মনে উদ্বেগ ছড়ায়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে গণমাধ্যমে খবর ছাপা হয়, নতুনভাবে উগ্রপন্থিদের চাঙ্গা করতে নেপথ্যের অন্যতম প্রধান কারিগর হলেন শামিন মাহফিজ নামের সাবেক এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। ছাত্র হিসেবে কৃতিত্বের পরিচয় দেওয়া শামিন ২০০৩ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন। ২০১১ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। জঙ্গিবাদে জড়ানোর কারণে দু’বার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সর্বশেষ ২০১৪ সালে গ্রেপ্তার হন।
জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসার আল ইসলাম, হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি)- এসব সংগঠন থেকে সদস্য এনে নতুন জঙ্গি প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে শামিনের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। শিক্ষক হওয়ায় উগ্রপন্থিরা তাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেন। তার আরেক নাম ‘মেন্ডিং মুরং’। পার্বত্য এলাকায় জঙ্গি কার্যক্রমের সময় সংগঠনের সদস্যদের কাছে এই নামে বার্তা আদান-প্রদান করেন। শামিনের বিরুদ্ধে বান্দরবানের থানচি ও যাত্রাবাড়ী থানায় ৫টি মামলা থাকার তথ্যও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে।
সম্প্রতি র্যাব জানায়, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারকস্ফীয়া নামে নতুন একটি জঙ্গি সংগঠন গড়ে উঠেছে। ঘরছাড়া অনেক তরুণ পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় আত্মগোপনে রয়েছে। বিভিন্ন সংগঠনের ছত্রছায়ায় সেখানে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। গোপনে তারা উগ্রপন্থি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। জঙ্গিদের ধরতে পার্বত্য চট্টগ্রামে সম্মিলিত অভিযানও চালানো হয়েছে।
এই খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, হুজিবির শীর্ষ নেতা মাওলানা আবু সাঈদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শামিন, মাইনুল ইসলাম মাহিন ওরফে রক্সি, তমাল ওরফে শওকত, রনভীর ওরফে বিকাশ, সোহান ওরফে ফেলানী মিলে আবার নতুনভাবে জঙ্গি তৎপরতা শুরু করার ছক কষেন। হুজিবির আদর্শে সংগঠন চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া দাওয়াতি ও সামরিক কার্যক্রমে জোর দেওয়া হয়।
দাওয়াতি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে চলতি বছরের শুরুর দিকে তারা ১০-১২ জনকে যুক্ত করে। তাদের মধ্যে আছেন কৃষিবিদ মহসিন, ব্যবসায়ী মুরাদ হোসেন কবির ও রাকিব। নতুনভাবে গোছানো সংগঠনের আমির হিসেবে মাহিনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। শামিন হলেন প্রধান উপদেষ্টা। এছাড়া উগ্রপন্থিদের অর্থের জোগানও তার মাধ্যমে আসে। তার মাধ্যমে নতুন জঙ্গি সংগঠনের জন্য একে-২২ সহ অত্যাধুনিক অস্ত্র কেনা হয়েছে।
২০২০ সালের নভেম্বরে পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) কমান্ডার নাথান বোমের সঙ্গে কক্সবাজারের একটি হোটেলে বৈঠক হয়েছিল শামিনের। নাথান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্র। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ায় নাথানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয় শামিনের। কক্সবাজারের ওই বৈঠকে মাহিনও ছিলেন।
কুকি-চিনের পক্ষে আরও উপস্থিত ছিলেন বিনাশ চোং। সেখানে শামিনের সঙ্গে তাদের সমঝোতা হয়। বলা হয়, শামিনের সংগঠনের সদস্যদের অর্থের বিনিময়ে সামরিক প্রশিক্ষণ দেবে কুকি-চিন। তারা তাদের ‘কমন’ (অভিন্ন) শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়বে। মাসে ন্যূনতম এক লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা প্রশিক্ষণ বাবদ কুকি-চিনকে দেওয়া হবে।
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় খুমিদের ওপর পিএইচডি করতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন শামিন। এর সূত্র ধরে তার নিয়মিত পাহাড়ে যাতায়াত ছিল। এজাজ কারগিলের পরামর্শে তিনি পাহাড়ে গিয়ে গবেষণার আড়ালে জঙ্গি কার্যক্রম চালাতে থাকেন। ২০১১ সালে প্রথম পাহাড় থেকে জেএমবি নেতা ইসমাইলসহ গ্রেপ্তার হন শামিন। ২০১২ সালে জামিন পান। ওই সময় কারাগারে জেএমবি নেতা রাজীবের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। এর পর জেএমবিতে সক্রিয় হন।
দ্বিতীয় দফায় ২০১৪ সালে ঢাকায় গ্রেপ্তার হন। এ দফায় কারাগারে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি মাওলানা আবু সাইদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তখন জেএমবির আদর্শ থেকে সরে আসেন। এর পর হুজিবি নেতা হাফেজ ইয়াহিয়া ও আনসার আল ইসলামের নেতা মাহিনের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। শামিনের পরামর্শে তারা সব সংঠনকে একত্রিত করার উদ্যোগে অংশ নেন। নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদের গোপন আস্তানায় নির্বিঘ্নে আনা-নেওয়া করতে জঙ্গিদের একটি জলযান কেনার পরিকল্পনা ছিল। পাহাড়ি এলাকার পাশাপাশি সমতলেও গোপন বড় আস্তানা তৈরি করতে চেয়েছিল তারা।
২০ নভেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশের চোখে ঝাঁজালো তরল স্প্রে করে রাজধানীর জনাকীর্ণ আদালত চত্বর থেকে জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে তাদের সহযোগীরা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।
মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান এবং আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব নামের এই দুই জঙ্গি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন আনসার আল ইসলামের (আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) সদস্য। তারা কাশিমপুর কারাগারে বন্দি ছিলেন।
ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গিকে ধরতে দেশব্যাপী রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। তাদের ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সীমান্ত সিল করাসহ একযোগে অভিযানও শুরু করেছে। এ ঘটনায় আহত এক পুলিশ কনস্টেবল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঘটনার তদন্তে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, আদালত এলাকার প্রতিটি সড়ক ও মোড়ে মোড়ে জঙ্গিদের অবস্থান ছিল। তাদের সবার পিঠে ব্যাগ ছিল। তারা সব প্রস্তুতি নিয়েই জঙ্গি ছিনতাই করতে এসেছিল। কেউ মোটরসাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করেছে, কেউ সড়কে দাঁড়িয়ে ছিল। ঘটনাটি তাদের পরিকল্পিত। তাদের অনেক দিনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। পুরো ঘটনাটি এক মিনিটের কম সময়ের মধ্যে ঘটেছে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘স্প্রে করার কারণে আমাদের পুলিশ সদস্যরা চোখে দেখতে পাচ্ছিল না। এই সুযোগে চার জঙ্গিকেই তারা নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা দুজনকে নিতে পেরেছে।
ঘটনার পরপরই আমাদের ডিএমপির সব ইউনিট একযোগে কাজ শুরু করেছে। জঙ্গিরা চারজনকেই ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু আমাদের পুলিশ সদস্যদের তৎপরতায় অন্য দুজনকে নিতে পারেনি। আমরা ঢাকায় তাদের পালিয়ে যাওয়ার রুট শনাক্ত করেছি। তাদের গ্রেপ্তারে কাজ চলছে।’
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রায় ১০ বছর আগেও জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছিল। গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহের আদালতে নেওয়ার পথে ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ত্রিশাল ও ভালুকার মাঝামাঝি সাইনবোর্ড এলাকায় পুলিশের প্রিজন ভ্যানে হামলা চালায় জঙ্গিরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিদের গোলাগুলি হয়।
সালাহউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি (৩৮), জাহিদুল ইসলাম মিজান ওরফে বোমা মিজান (৩৫) ও হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব হাসান (৩৫) নামের জেএমবির তিন শীর্ষ নেতাকে ছিনিয়ে নেয় জঙ্গিরা। তিনজনের মধ্যে সালাহউদ্দিন ও রাকিব মৃত্যুদণ্ড এবং বোমা মিজান যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। ওই দিনই রাতে জঙ্গি হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব হাসান পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। ঘটনার পরপরই সালেহীন ও মিজান ভারতে পালিয়ে যান। বোমা মিজান ব্যাঙ্গালুরুতে গ্রেপ্তার হন। তবে এখনো সালেহীনের কোনো সন্ধান মেলেনি।
ওই ঘটনার পর জঙ্গিদের আদালতে আনা-নেওয়ার সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তা কার্যকর করা হলে হয়তো জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়ানো যেতো। জঙ্গি তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে আছে বলে এটা মনে করা ঠিক নয়, যে জঙ্গিদের ষড়যন্ত্র থেমে আছে। ৫৩ জন তরুণের হিজরতের বিষয়টিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিবেচনায় রাখা উচিত ছিল।
জামায়াতের আমির ডা. মো. শফিকুর রহমানের ছেলে রাফাত সাদিক সাইফুলকে গ্রেপ্তারে বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গত ৯ নভেম্বর সিলেট থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। দুই দফায় মোট ৫ দিনের রিমান্ড শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রাফাত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সিলেট অঞ্চলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। তিনি দীর্ঘদিন ধরে জিহাদি কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেপ্তার হওয়া তিন জঙ্গি জিজ্ঞাসাবাদে রাফাতের নাম বেরিয়ে আসে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে জঙ্গি প্রশিক্ষণের সঙ্গে জামায়াতের শীর্ষ নেতার পুত্রের জড়িত থাকা এবং জঙ্গিদের এক প্ল্যাটফর্মে আসার চেষ্টার তথ্য জানার পরও কারাগার থেকে জঙ্গিদের আদালতে আনা-নেওয়ার সময় উদাসীনতা দেখানোর পক্ষে কি কোনো যুক্তি খাড়া করলে সেটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে? চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ার প্রবাদ থেকে আমরা কবে বেরিয়ে আসতে পারবো?
আরও একটি বিষয় নিয়ে ভাবা দরকার। সেটা হলো, জঙ্গিদের আর্থিক দিক। জঙ্গি তৎপরতার জন্য কারা অর্থের জোগান দিচ্ছে? বিদেশ থেকে কেউ তাদের সহায়তা দিচ্ছে, নাকি দেশের ভেতর থেকেই তারা টাকা পাচ্ছে? এ বিষয়ে নজরদারি বাড়ানোর দিকটও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেকেই মনে করেন, অর্থের জোগান বন্ধ হলে জঙ্গিরা এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়বে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম