ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রাজনীতি

অল্প সময়ে অনেক ধর্মঘটের ধকলটা কার?

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | প্রকাশিত: ১০:০৮ এএম, ২০ নভেম্বর ২০২২

বহুদিন দেশে হরতাল-ধর্মঘট ছিল না। আবার শুরু হয়ে গেছে এসবের ধকল। মজার ব্যাপার হলো এবারের ধর্মঘট অভিনব। একজনের দায় আরেকজনের ঘাড়ে চাপিয়ে ঘন ঘন ধর্মঘট ডেকে দেওয়া হচ্ছে নির্দ্বিধায়। পরিবহন ধর্মঘটের নামে স্থল, জল, হাঁটাপথ সবকিছুতেই বাধা দেওয়া হচ্ছে হঠাৎ করেই।

আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে- যেদিন বিরোধী দল বা বিএনপি বিভাগীয় সমাবেশের ডাক দিচ্ছে সেই দিনকে উপলক্ষ্য করে শাসক দল সেই বিভাগে তিনদিন আগে থেকেই সব পরিবহন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে দিচ্ছে। পরিবহন সমিতির ওপর দায় চাপিয়ে শুধু সেই বিভাগের জেলা-উপজেলা, গ্রামগঞ্জ থেকে নয়, ভিন্ন জেলা বা দেশের ভিন্ন কোনো এলাকা থেকে সমাবেশমুখী যানবাহন চলাচল করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে।

যে উদ্দেশ্যে এসব ধর্মঘট ডেকে আড়ালে থেকে কৌতুক করা হচ্ছে ধর্মঘটীদের সে উদ্দেশ্য কি আসলে সফল হচ্ছে? এ নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক শুরু হয়েছে। সাধারণ জনগণ এজন্য খুবই বিব্রত ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে চলেছে। অথচ এ ব্যাপারে সরকার বা প্রশাসনের কোনো বিকার নেই।

ঘন ঘন ধর্মঘটের ফলে বিরোধী প্রতিবাদের ভাষার সাথে আরও বেশি তেজ ও জেদ লক্ষ্য করা গেছে। দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে ছয়টিতে ইতোমধ্যে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ শেষ হয়েছে। ছয়টি সমাবেশে ধর্মঘটের কোনো সুফল না থাকা সত্ত্বেও সিলেটের বিভাগীয় সমাবেশ ১৯ নভেম্বরের দুদিন আগে হবিগঞ্জসহ সব জেলা থেকে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে।

পথের সব বাধাবিপত্তি ডিঙ্গিয়ে বিএনপি সমর্থকরা সেসব সমাবেশে বহু আগে থেকে হাজির হয়ে সমাবেশগুলোকে উচ্ছল প্রাণসঞ্চালনা দিয়েছে। ধর্মঘটের ফলে তারা আগেই সমাবেশস্থলে আসায় তাদের উপস্থিতি ও গণমাধ্যমে ভরপুর প্রচারণা দেখে যারা শুধু নির্দিষ্ট দিনে আসতো বা আসতে চাইতো না তারাও যে কোনো প্রকারে সমাবেশে হাজির হয়েছে।

অর্থাৎ, সমাবেশের একদিনের প্রচারণা এবার তিনদিন আগে থেকেই প্রচারিত হয়ে বিরোধী শক্তিকে আরও বেশি উজ্জীবিত করে তুলেছে। শাসক দলের ধর্মঘট ডাকার প্রয়াস একটি ছলনা হিসেবে প্রতীয়মান হওয়ায় সাধারণ ও ভুক্তভোগী মানুষ আরও বেশি উৎসাহী ও কৌতূহলী হয়েছে বিভাগীয় সমাবেশগুলোর প্রতি। তারা বলছেন, যেমন ঠাকুর, তেমন মুগুর। পথে পথে তল্লাশি, হোটেলে অভিযান ইত্যাদির জন্য সমর্থকরা সমাবেশস্থলের মাঠে তাঁবু গেড়ে একসঙ্গে অবস্থান করছেন।

নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাই তো তারা তিন-চারদিন আগে থেকেই পুটলিতে চিড়া-মুড়ি, নাড়ু বেঁধে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মাধ্যমে সমাবেশস্থলে হাজির হয়ে পিকনিক করে গান গাইতে সুযোগ পেয়েছে। সেখানে তারা সারি সারি চুলা জ্বালিয়ে রান্নাবান্না করে খাওয়ারও সুযোগ পেয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এটা ঘটতো না যদি শাসক দলের অহেতুক ভুল নীতি ব্যবহারের বাস্তব প্রতিচ্ছবির জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কথা জানা থাকতো।

এভাবে বার বার জনসভাকে কেন্দ্র করে এধরনের হঠকারিতামূলক পরিবহন ধর্মঘট ডাকা শাসক দলে উন্নয়ন কাজ করার জনপ্রিয়তা যতটুকু ছিল সেটুকুও ম্লান করে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। জনসভার বিরুদ্ধে ডাকা এসব ধর্মঘট তাদের জনভীতিকে আরও প্রামাণ্য করে তুলছে এবং এটা তাদের জন্য আরও বুমেরাং হচ্ছে বৈ কিছু নয়।

আর সরকারের ভয়ে পরিবহন সমিতিগুলো উপায়ন্তর না দেখে নিজেদের বাঁচানোর জন্য ধর্মঘট ডেকে আড়ালে থেকে মজা করছে। প্রশাসনযন্ত্র তাদের চাকরি বাঁচানোর জন্য ধর্মঘটে দায়সারা দায়িত্ব পালন করছে। সবাই এসব উদ্ভট সিদ্ধান্তের কাজকে ছলনা ও এক ধরনের প্রতারণা মনে করে মনোক্ষুণ্ন হয়ে যেনতেন কাজ মনে করছে।

ফরিদপুর বিভাগের মহাসমাবেশকে ঘিরে গণপরিবহন ধর্মঘটের পাশাপাশি মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ শোনা গেছে। এতে একদিক এসব ধর্মঘট বুমেরাং হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে জনসমাগমকে আরও বেশি বেগবান করে সফল সমাবেশ করে চলেছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেশের সব মানুষ তো আর রাজনীতি করে না। জনভোগান্তি সৃষ্টিকারী এসব ধর্মঘট না ডাকলে বিভাগীয় সমাবেশগুলো এত প্রাণ পেত না।

খুলনা সমাবেশের আগে সেখানকার বিরোধী নেতারা বলেছেন, যানবাহন বন্ধ করে কোনো লাভ নেই। ‘মনে চাইলে মানুষ পায়ে হেঁটেও মক্কা যেতে পারে।’ ফরিদপুরের জনসভায় বক্তারা বলেন, পরিবহন ধর্মঘট সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের দুর্গে লক্ষ মানুষ জমায়েত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানাচ্ছে। তবুও সরকার খেলার নামে অরাজনৈতিক কথাবার্তা বলে অবজ্ঞা করছে।

এবার নির্বাচন নিয়ে যেনতেন খেলা খেলতে দেওয়া হবে না। মানুষ গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। তাই সব বিভাগীয় সমাবেশের বহু আগেই ধর্মঘট ডাকা হলেও জনসমাগম ঠেকানো যায়নি। কয়েকদিন ধরে নেতাদের মধ্যে বাকযুদ্ধ ও পাল্টা বাকযুদ্ধ চলছেই। জনভোগান্তির কথা ভাবনায় নেই কারও।

দেশের বাকি জনগণ তো ‘ওয়াচডগ’। তারা গণমাধ্যমে ধর্মঘটের নামে নিরীহ ভুক্তভোগী মানুষের দুর্দশা দেখে সহানুভূতি প্রকাশের ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে। কারণ, এসব ধর্মঘট তো আর একটি-দুটি নয়। অনেক হবে। হয়তো সামনে আরও অনেক হতে থাকবে। তবে এসব পরিবহন ধর্মঘট কি কোন জনসমাবেশ ঠেকাতে সক্ষম? নাকি শুধু জনভোগান্তি সৃষ্টির কারণ?

আরেকটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঢাকায় একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের মহাসমাবেশকে ঘিরে লক্ষণীয় ছিল। সেটা হলো- বিআরটিসি বাসে দলীয় ব্যানার টাঙিয়ে আসা। উন্মুক্ত মাঠে ফটক বানিয়ে পুলিশি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দলীয় সমাবেশ করাকে অনেক গণমাধ্যম আওয়ামী লীগের ভয় পাওয়ার বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছে।

এছাড়া ডলারের রিজার্ভ সংকট ঠেকাতে আইএমএফের ঋণ গ্রহণকে অর্থনীতিবিদরা প্রথম কিস্তি পাওয়ার পর কঠিন প্রেসক্রিপশন হাতে ধরিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা করছেন। যার মূল মিটিং আইএমএফ এখনও করেনি এবং বিদেশি সাংবাদিকরা দেশের অর্থনীতিকে আইসিইউয়ে থাকার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তা-না হলে এই সময়ে আইএমএঢের ঋণ গ্রহণ এত প্রয়োজনীয় মনে হলো কেন?

একটি দলীয় অনুষ্ঠান বা কর্মসূচির জন্য সরকারি পরিবহন ব্যবহার করা যায় না। এমনকি সেজন্য সরকারি পরিবহন বা যানবাহন ভাড়া করারও বিধান নেই। এটা দেশবাসীর দৃষ্টিকটূ লাগায় সমালোচনার উদ্রেক করেছে।

একদিকে বিরাধী দলের সমাবেশকে পণ্ড করার মানসে পরিবহন ধর্মঘট চালু থাকা এবং সরকারের নির্লিপ্ত থাকার ভূমিকা অন্যদিকে সরকারি যানবাহনে দলীয় ব্যানার লাগিয়ে ঢাকায় সমাবেশস্থলে সমর্থক নিয়ে আসাটা বড় ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত। নিজেরটা সরকারি নিরাপত্তার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ও অনেকটা যান্ত্রিক কিন্তু বিরোধীদেরটা হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাকৃতিক।

আজকাল গণমাধ্যমের কল্যাণে এসবের কোনোটাই সাধারণ মানুষের চোখ এড়ায় না। প্রবাদে আছে- ‘নিজের বেলা আটিসাঁটি, পরের বেলা চিমটি কাটি’- অহেতুক নিষ্ফল পরিবহন ধর্মঘট ডেকে এমন ভাব প্রদর্শন করছি কেন?

আর এগোলোই কোন শাসনকালের ইতিহাসের প্রতিপাদ্য হিসেবে লেখা হয়ে থাকে। নাগরিকদের কল্যাণের জন্য গৃহীত যে কোনো কিছুই একদিন মহান হয়ে ভেসে আসে। হজরত ওমর রাতের বেলা দুঃখী প্রজাসাধারণের প্রকৃত অবস্থা যাচাই করতে একা একা চুপি চুপি দেখতে যেতেন। দরিদ্র মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে এক রাতে তিনি শুধু পানির পাত্র উনুনে জ্বাল দিতে দিতে অভুক্ত সন্তানদের সান্ত্বনা দিতে দেখা এক অসহায় মায়ের সন্ধান পেয়েছিলেন।

তাদের জন্য নিজেই গাধার পিঠে করে খাবার বহন করে এনে দিয়ে মানবকল্যাণে ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অংশ হয়ে আজও বেঁচে আছেন। আমরা গণতন্ত্রের জন্য নূর হোসেনের বুকের লেখা স্লোগানকে বুলি করছি, নিজের অবস্থান খেয়াল না করে অপরের কথা বলা নিয়ে বার বার উপহাস করছি। কিন্তু নিজেরা ভালো হতে চেয়েও ভালো হতে পারছি কই?

ঢাকায় লাখ কর্মী-সমর্থকের সমাবেশের দিনও নিজের ভিটা ও দুর্গে যখন আরও ভিন্ন লাখ লাখ প্রতিবাদী মানুষ গণতন্ত্র, ভোটাধিকার প্রয়োগ, জ্বালানি সংকট, উচ্চদ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের দাবি জানাতে জড়ো হয় তখন সেটাকেও গুরুত্ব দিয়ে ভাবার বিষয়। এগুলোকে নিছক খেলার সঙ্গে তুলনা করাটাও ঠিক নয়। ‘পুকুরে বাচ্চারা ঢিল ছুড়ে খেলায় মত্ত হলে অগভীর জলে বাস করা ব্যাঙদের অকাল মৃত্যু ঘটতে পারে’-একথা ভুলে গেলে চলবে কি করে? এজন্য দায়িত্বরত থাকা সবাইকে আরও দায়িত্বজ্ঞানহীন মনে হয়। কারণ দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাসের এই সময়ে নিম্ন আয়ের মানুষেরা সেই অসহায় ব্যাঙের মতো অতি অগভীর পুকুরে বাস করছে।

বার বার সরকারি ইঙ্গিতে পরিবহন ধমর্ঘটের ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ঝান্ডা যখন লোভী ব্যবসায়ীরা আরও অগ্নিমূল্যের দিকে তাড়া করে নিয়ে যায় এবং ছা-পোষা, দরিদ্র মানুষকে পরিবারসহ পেটের ক্ষুধায় কাতর করে নির্ঘুম রাখতে বাধ্য করে তখন বড় বড় সমাবেশের নামে প্রতিযোগিতা করে অর্থ ব্যয় করা ও জৌলুস দেখানোর নামে মানুষের কষ্ট বাড়ানো কি সমীচীন মনে হয়? এত অল্প সময়ে এসব অনেক বেশি ধর্মঘটের ধকলটা আসলে কার?

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/এমএস