হুম্মামদের হুংকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল
অপরাধ ও বোধ, দুটো ধর্ম নিয়ে যাচাই করলে, নৈতিকতা উত্তর দেবে, পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়। কিন্তু পাপ ও পাপীকে নিয়ে বড়াই করার মধ্য দিয়ে যাদের জীবন পরিক্রমা বিস্তৃত, তাদের কী বলা যায়? দুষ্টু নাকি অবুঝ?
যুদ্ধাপরাধ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সড়কে শত্রু হয়ে বাধা প্রদান করেছে, তা নিয়ে মতবিরোধ করে কুতর্ক করার যৌক্তিকতা কি আছে? যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয় ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর। তার চার মাসের মাথায় বিএনপি তার ছোট ছেলে হুম্মাম কাদের (হুকা) চৌধুরীকে ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ তাদের সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করে।
সেই হুম্মাম নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে যা বলছেন, করছেন, তা তার এই হুংকারে হতাশ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। তিনি যেন বড়াই করে বলতে চান যে, তার বাবার রাজনৈতিক কর্মগুলো ভালো ছিল এবং বাংলাদেশ বিরোধিতা করাও ভালো ছিল!
এই সেই হুম্মাম কাদের, যে তার বাবার ফাঁসির রায়ের আগেই মিডিয়ায় পরিচিত হয়ে ওঠেন, বিচারকের কম্পিউটার অপারেটরকে হাত করে রায়ের খসড়া বের করে জনগণকে বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে ধোঁকা দিতে গিয়ে। তারপর অনেকদিন নিরুদ্দেশ ছিলেন হুম্মাম। সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা ছিল যে, তাকে গুম করা হয়েছে, মুচলেকা দিয়ে বিদেশে চলে গেছেন, এসব। কিন্তু হুম্মাদ কাদের গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে উদিত হয়েছেন বিএনপির বিভাগীয় জনসভায়।
কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীকে ‘শহীদ’ উল্লেখ করে হুম্মাম চৌধুরী যে বক্তব্য দিয়েছেন, এটা সব বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্য অপমানস্বরূপ। হুম্মামের অঙ্গভঙ্গি রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। এই আস্ফালনের জন্য হুম্মামকে ক্ষমা চাইতে সাতদিনের সময়ও দেওয়া হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের পরিবারের সদস্যরা স্বাধীন বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা দেশবিরোধী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে, জঙ্গিবাদে অর্থায়ন করছে। যুদ্ধাপরাধীদের উত্তরাধিকাররা এখন ফণা তুলতে চাইছে; আস্ফালন করছে।
হুম্মাদ কাদের ধর্মীয় কার্ড খেলে মানুষকে বোকা বানাতে চেয়েছেন। সে জন্যেই তিনি বক্তৃতার শুরু এবং শেষে নারায়ে তাকবির ধ্বনি দিয়ে ক্ষান্ত হননি, এটিকে তার বাবার স্লোগান হিসেবে দাবি করেন। ওই বক্তৃতায় সাকাপুত্র তার বাবাকে ‘শহীদ’ বলেছেন। সাকা যুদ্ধাপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি। অশ্লীল বক্তব্য ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করে ঘরে-বাইরে আলোচিত সাকার মতো যদি তার পুত্রও রাজনীতি করতে চান, তাহলে তার কপালে দুঃখ আছে বলতে হয়।
হুম্মাম কাদের তরুণ রাজনীতিবিদ। তার মনে রাখা উচিত যে, বাপ-দাদার দেখানো পথে তার সফলতা নেই। তার বাপ-দাদার অপকর্মের জন্য পুরো চট্টগ্রামে তারা একটি ঘৃণিত পরিবার। দেশ স্বাধীন হলে তার দাদা ট্রলারে করে বার্মা পালানোর সময় ধরা পড়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে পেটানোর সময় ভারতীয় বাহিনী তাকে উদ্ধার করে।
হম্মাম কাদেরের বাবা সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরী বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিল স্বাধীনতার আগে আগে। ১৯৭৫ সালের পর দেশে ফিরে আসেন। তার মতো খুনি, জালেমকেও জেলখানায় থেকে, দীর্ঘ আইনি লড়াই করে মৃত্যুদণ্ড পেতে হয়েছে।
হুম্মাম কাদের চট্টগ্রামের সমাবেশে তার বাবাকে ‘শহীদ’ বলে শেষ করেননি, ক্ষমতা হারালে আওয়ামী লীগকে এর পরিণতি ভোগেরও হুমকি দিয়েছেন। আওয়ামী লীগকে যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত তথাকথিত শহীদদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ক্ষমা চাইতে যেতে হবে বলেছেন।
যারা যুদ্ধাপরাধী তাদের বিচার করে বাংলাদেশ তার একটি নৈতিক দায়িত্ব শেষ করেছে। কিন্তু এই বিচারের প্রতিশোধের কথা তুলে দেশে যদি নৈরাজ্যের স্বপ্ন দেখে কেউ, প্রতিহিংসার রাজনীতিতে সামনে আনতে চায়, তারা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। আওয়ামী সরকারবিরোধীরাও এই ধরনের প্রতিহিংসা চায় না।
হুম্মাম কাদের যা বলেছেন, তা স্পষ্ট হুমকি। দেশকে অস্থিতিশীল করার প্রয়াসে তার এই হুংকার। এটি হুম্মাম কাদের চৌধুরীর স্পর্ধাও বটে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হুমকি দেওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিত। হুম্মাম কাদেরকে গ্রেফতার করা উচিত, যেন কেউ এরকম দুঃসাহস দেখাতে না পারে।
মনেপ্রাণে একজন ইসলামিস্ট আমি নিজেও। মহান আল্লাহকে স্মরণ করি। তার পথে চলতে চাই। কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করে যারা এমন স্লোগানকে সামনে রেখে পথচলাকে নির্ধারিত করতে চায়, তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ‘না’ বলতে পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে পড়বে বলেও মনে করার সুযোগ আছে।
লেখক: রাজনীতিক ও সমাজকর্মী।
এইচআর/ফারুক/এমএস