মরার গাড়ি যাস না কেরে?
বিলম্বে এলেও ট্রেনের টান ছিল জবর। টানের সুখে ভাসতে ভাসতে সাবাসি দিচ্ছিলাম; ভয়ও পাচ্ছিলাম। রেললাইনে যে পরিমাণ পাথর থাকার কথা, তার সিকিভাগও নেই। নাট-বল্টু ঠিকঠাক লাগানো আছে কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো ট্রেনটা যখন একটু পর পর ফাল দিয়ে উঠছিল, ভাবছিলাম- ট্রেনের গতির দায় শোধ করতে গিয়ে জীবনের গতি স্তব্ধ হয়ে যাবে না তো!
আল্লাহ মেহেরবান, সেরকম কিছু ঘটার আগেই ট্রেন মশাখালি স্টেশনে যাত্রাবিরতি করল। যতবার ট্রেনে এই পথে যাই, মশাখালি নামটা আমাকে ভাবায়। মশাখালি মানে কী? খালি মশা আর মশা? মশা ছাড়া আর কিছু নেই? তাহলে মানুষের বেশ ধরে এ অঞ্চলে যারা বসবাস করছে, তারা কে? দেখতে-শুনতে মানুষ মনে হলেও আসলে তারা মানুষ নয়, মশা?
কোহেমান জগতের বাসিন্দা জিন-পরীদের কেউ কেউ যেমন মানুষের বেশ ধরে আমাদের চারপাশে বিচরণ করছে, তেমনি মশারাজ্যের মশকবৃন্দও মানুষের রূপ ধরে এ অঞ্চলে আস্তানা গেড়েছে? আবার ভাবি-পকেটে কোনো কিছু না থাকলে আমরা যেমন বলি, পকেট খালি; মশাখালি শব্দটা কি সেই অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে? মশাখালি মানে এ অঞ্চলে কোনো মশা নেই; সব বিতাড়িত হয়েছে। অলক্লিয়ার। অথবা এমন কি হতে পারে না- মুসা নামের কোনো ব্যক্তির নামানুসারে এ এলাকার নাম হয়েছিল মুসাখালি, যা পরে বিকৃত হয়ে মশাখালি হয়েছে?
এছাড়া আরও একটা ভাবনা আমার মধ্যে কাজ করে। একসময় পূর্ববাংলাজুড়ে জমিদার ‘মহাশয়’দের খুব দাপট ও আধিপত্য ছিল। মহাশয় কথ্য ভাষায় মশাই বলা হয়। হতে পারে- এ তল্লাটে মশাইরা ছাড়া আর কেউ কল্কি পেত না-এটা বোঝাতেই মশাই খালির উদ্ভব হয়েছিল, যা পরে মশাখালিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এর বিপরীতও হতে পারে! এ এলাকা থেকে মশাইদের ঝাড়েবংশে উচ্ছেদ করা হয়েছে। অলআউট- খালি, খালি, মশাই খালি। মশাই খালি থেকে শেষমেশ মশাখালি।
মানুষের মন হচ্ছে পাগলা ঘোড়া। একবার দৌড় শুরু করলে কোথায় গিয়ে থামবে- তার কোনো সীমারেখা নেই। ভাবনার পালে হাওয়া লাগতেই পাগলা ঘোড়ারূপী মন ছুটে গেল অতীতের এমন এক ঘটনায়- যেখানে মশাই আছে, মশাও আছে। অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার শ্রীকান্ত উপন্যাসে সমুদ্রপথে বার্মা, হালের মিয়ানমার ভ্রমণের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন।
ভ্রমণকালে লেখক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়েন। উপন্যাসের এ অংশটুকু ‘সমুদ্রে সাইক্লোন’ নামে আমাদের নবম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে সংকলিত হয়েছিল। ঝড়ের কামড়ে ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ হওয়া এক যাত্রী লেখকের ফুরফুরা অবস্থা দেখে অবাক হয়ে বলেছিলেন-
: মশাইকে খুব তাজা দেখাচ্ছে!
স্কুলের প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় এ লাইনটি কোড করে প্রশ্ন করা হলো-
: মশাইকে তাজা দেখাচ্ছে কেন?
কিছুদিন পর ক্লাসে উত্তরপত্র বিলি করার সময় নরেশ স্যার সহপাঠী খায়রুল ফরাজিকে দাঁড় করালেন। বললেন-
: এই গর্দভ; পরীক্ষায় খাতায় এইসব কী লেখছস!
উত্তরপত্রে খায়রুল যা লিখেছিল, নরেশ স্যার তা পড়ে শোনালেন। খায়রুল লিখেছিল-
: মশা আমাদের শরীরের রক্ত খায়; তাই তাকে তাজা দেখায়।
মশাইকে মাইনাস করে মশাকে প্রাধান্য দিয়েছিল খায়রুল। আমি মাইনাস তত্ত্বের অনুসারী না হয়ে মশা ও মশাইকে সমান গুরুত্ব দিলেও নবাগত এক যাত্রী এসে আমাকে মাইনাস করতে চাইল। বলল-
: এই যে ভাই, উডুইন; এই সিট আমার।
জামালপুর কমিউটার ট্রেনে যাত্রীদের প্রচণ্ড চাপ থাকায় সিট পাওয়া একরকম ভাগ্যের ব্যাপার। আমার গন্তব্য ময়মনসিংহ হলেও সিটের জন্য অতিরিক্ত ভাড়া কবুল করে দেওয়ানগঞ্জের টিকিট কেটে ট্রেনে উঠেছি। পকেট থেকে টিকিট বের করলাম। টিকিটের গায়ে স্পষ্টভাবে সিট নম্বর লেখা দেখে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে বললাম-
: আপনের টিকিটটা দেখান তো!
টিকিট লোকটার হাতেই ছিল। সে আমার নাকের সামনে সেটা মেলে ধরল। হাতে নেওয়ার পর বুঝতে পারলাম, গণ্ডগোলটা কোথায় হয়েছে! বললাম-
: আপনের মাওই ঠিক আছে; কিন্তু তাওইয়ের ক্ষেত্রে উল্টাপাল্টা কইরা ফেলছুইন।
লোকটা আমার কথার মর্মার্থ বুঝতে পারল না। বিষয়টা খোলাসা করার উদ্দেশে বললাম-
: আপনের সিট নম্বর এক হইলেও বগি এইটা না। আপনের সিট হইল ঘ বগিতে। আর আপনে উডছুইন খ বগিতে। ঘটনা কী ঘটছে, বুঝছুইন?
লোকটা মাথা নাড়তে নাড়তে দ্রুত চলে গেল। এক মিনিট, দুই মিনিট করে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। রাতের গায়ে লেগে থাকা কালো আল্পনা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। পেটে, পিঠে, ঘাড়ে হাজার হাজার যাত্রী নিয়ে মশাখালি স্টেশনে মরা অজগরের মতো পড়ে আছে জামালপুর কমিউটার। সবচেয়ে বিপদে পড়েছে সিট না পাওয়া মহিলা ও শিশু যাত্রীরা। ট্রেনের ভেতরে পা রাখার জায়গাও নেই। তারা না পারছে বসতে, না পারছে ঠিকমতো দাঁড়াতে। সন্তানসহ এক মহিলার দুরবস্থা দেখে উঠে দাঁড়ালাম; বললাম-
: আপনে এইখানে বসেন।
দুই সিটের মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন মলিন বেশভূষার এক মহিলা। তার কোলে শিশুকন্যা। পাশে দাঁড়ানো শিশুপুত্র। পায়ের কাছে রাখা একটা বস্তা। গমনরত টিকিট চেকারের ধাক্কা খেয়ে টাল সামলানোর চেষ্টা করতেই ধাক্কা লেগে বস্তা কাত হয়ে পড়ল। এর পরপরই সামনের মহিলা যাত্রী গর্জন করে উঠলেন-
: বস্তার মধ্যে এইতা কী রাখছুইন?
বস্তার মালকিন নরম গলায় বললেন-
: পোড়া মবিল।
: ডাহাইত বেডি! আফনে পোড়া মবিল লইয়া গাড়িত উডছুইন? কাপড়ে লাগলে কী দশাটা অইত!
পৃথিবীতে যত রকম দুই নম্বরি কারবার আছে, বাঙালি আয়ত্ত করেছে। তেলে ভাজা নানান পদের খাবার টাটকা ও মচমচে রাখতে তেলের সঙ্গে পোড়া মবিলের মিশ্রণ খুব কাজে দেয়-এটা বাঙালি আবিষ্কার করে ফেলেছে। বিভিন্ন ভাজাপোড়া, বিশেষ করে রমজান মাসে রোজাদারের ইফতারের তালিকায় যুক্ত হয় নানারকম ভাজাপোড়া জিনিস। মহিলা কি রমজান মাস টার্গেট করে পোড়া মবিল সংগ্রহ করেছে? গর্জনকারীনির পায়ে লেগে থাকা মবিল নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দিলেন পোড়া মবিলের মালকিন। কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়ানোর পর তাকে জিজ্ঞেস করলাম-
: পোড়া মবিল দিয়া আপনে কী করবাইন?
মহিলা বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন-
: ঘরের চালে লাগাইবাম।
এরই মধ্যে আধাঘণ্টা পার হয়ে গেছে। ট্রেনের নড়াচড়ার কোনো লক্ষণ না দেখে কয়েক গজ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলা বলে উঠলেন-
: এইটা কী কারবার! গাড়ি এমুন ল্যাডা মারল কেরে!
ল্যাডা মারা মানে শুয়ে পড়া। ট্রেনের শুয়ে পড়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরতে মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ যাত্রী বললেন-
: দেখতাছুইন না, গাড়ি দুই নম্বর লাইনে দিছে; ক্রসিং আছে।
ক্রসিংয়ের মামলা কতক্ষণে শেষ হবে, কে জানে! ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। প্ল্যাটফরমে গিয়ে শুনি অন্য কাহিনি। বিষয়টা পরিষ্কার করতে এক দোকানদারের শরণাপন্ন হলাম। সে জানাল-
: গফরগাঁও ইস্টিশনে বলাকার ইঞ্জিন বইট মারছে। হেইডা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত এইডা ছাড়নের বাও নাই।
বইট মারা মানে বসে পড়া। সামনের স্টেশনে এক ট্রেন বসে পড়েছে। আর এখানে আরেক ট্রেন শুয়ে আছে। ট্রেনের বসে পড়া ও শুয়ে থাকার মাঝখানে পড়ে গেছি আমরা- হাবিলের ভাইয়েরা, কাবিলের বোনেরা। বাবা আদম (আ.) আমাদের সামনে উদাহরণ রেখে গেছেন- কীভাবে ধৈর্য ধরে পৃথিবীর বুকে চলাফেরা করতে হয়। আমরা অসীম ধৈর্য নিয়ে মশাখালি স্টেশন পাহারা দিচ্ছি। কেউ বসে আছি; কেউ দাঁড়িয়ে আছি; কেউ গোঙাচ্ছি; কেউ কাতরাচ্ছি। কাতরানোদের তালিকায় আছেন মধ্যবয়স্ক এক মহিলা। কাতরাতে কাতরাতে ট্রেনের উদ্দেশে তিনি বললেন-
: মরার গাড়ি যাইতি না? যাস না কেরে?
মোবাইল ফোনের এই যুগে খবর চালাচালি হতে সময় লাগে না। জানা গেল, মশাখালির স্টেশন মাস্টার ভাওতা দিয়েছেন। ট্রেনের ইঞ্জিন নষ্ট হওয়ার মিথ্যা গল্প উপস্থাপন করেছেন। আসল ঘটনা হচ্ছে, ময়মনসিংহ শহরে ক্ষমতাসীন দলের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ঢাকা থেকে নেতৃবৃন্দ সেখানে গেছেন। তারা কাউন্সিল শেষে ভোজন-ভাজন সেরে অগ্নিবীণা ট্রেনে ঢাকায় ফিরবেন। অগ্নিবীণা যাতে গতি না হারিয়ে নির্বিঘ্নে ঢাকায় পৌঁছতে পারে, সেজন্য লাইন ‘ক্লিয়ার’ রাখা হয়েছে। এ এক আজব দেশ। আজব তামাশা। কোনো সভ্য দেশে এরকম ঘটনা ঘটলে রাজনীতি ও রাজনীতিকদের অবশ্যই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো। বাংলাদেশে সেই পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। হবে কি কোনোদিন?
ইতিমধ্যে চারঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। যন্ত্রণার বদলে মানুষের চোখে-মুখে ভর করেছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। অনেকেই নির্ধারিত স্টেশনে নেমে খাল-বিল-চর ডিঙিয়ে দূরের গন্তব্যে যাবেন। এত রাতে কোনো যানবাহন পাওয়া যাবে না ভেবে তারা স্টেশনে রাত কাটানোর কথা বলছেন। কেউ করণীয় সম্পর্কে ফোনে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করছেন। হায়! ট্রেন জড় পদার্থ বলে এসব ঘটনার সাক্ষী হতে পারছে না।
বাংলাদেশে সাধারণত একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং তা ঘটেই চলে। সেই হিসেবে মশাখালির ঘটনাকে কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি বলা যেতে পারে। কয়েকদিন আগের সেই ঘটনার সূত্রপাত- দলীয় কাউন্সিলে সভাপতি নির্বাচিত হওয়া এক নেতার বিদেশ থেকে দেশে গমন।
নেতার বিদেশ থেকে ফেরা উপলক্ষে দলের নেতাকর্মীরা বিমানবন্দর সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। এ কারণে যেসব পথচারী সেদিন সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। অফিস থেকে বের হয়ে দেখি, রাস্তা ফকফকা। কোনো যানবাহন নেই। অনেকটা পথ হেঁটে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে চলাচলকারী কোনো বাসে ওঠার আশায় স্টাফ রোডে পা রাখতেই এক ভদ্রমহিলা আমার অনুগামী হলেন। বিপৎকালে পরিচয়ের আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন পড়ে না; একজন অন্যজনের সহমর্মী, সুহৃদ হয়ে যায়। কথায় কথায় জানলাম, তিনি যাবেন জিগাতলা। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তিনি বললেন-
: বাসায় আমার দুধের বাচ্চাটা না থাকলে আজ খিলক্ষেত থেকে যেতাম।
জিজ্ঞেস করলাম-
: খিলক্ষেতে আপনার কে থাকেন?
: খিলক্ষেতে আমার মায়ের বাসা।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনীতির গর্ভে জন্ম নেওয়া জনদুর্ভোগের ইতিহাস যখন লেখা হবে, তখন সন্তানের জন্য এক মায়ের এভাবে পথ পাড়ি দেওয়ার কথা হয়তো কোথাও লেখা থাকবে না; তবে আমার মনের মণিকোঠায় তা চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
লেখক: সাংবাদিক, রম্যলেখক।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/এমএস