যুদ্ধাপরাধ
একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি ও করণীয়
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে চালানো গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে একটি প্রস্তাব আনা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে (হাউজ অব রিপ্রেজেন্টিভস)। দেশটির দুই আইনপ্রণেতা এ প্রস্তাব আনেন। এ প্রস্তাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।
কংগ্রেসম্যান রো খান্না এবং কংগ্রেসম্যান স্টিভ চ্যাবট গতকাল শুক্রবার নিম্নকক্ষে প্রস্তাবটি তোলেন। প্রস্তাবে গণহত্যার জন্য পাকিস্তান সরকারকে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তাব দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। রিপাবলিকান দলের সদস্য স্টিভ চ্যাবট টুইটে লেখেন, ‘১৯৭১ সালের বাংলাদেশে চালানো গণহত্যার ঘটনা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। আমার ওহিও অঙ্গরাজ্যর সহকর্মীর সহযোগিতায় বাঙালি ও হিন্দুদের ওপর চালানো নৃশংসতা বিশেষ করে যার কিছু কিছু ক্ষেত্রে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে, তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছি।’ (প্রথম আলো/১০/২৩/২২)
এবারই প্রথম কি না জানি না, তবে রিপাবলিক্যান রিপ্রেজেনটেটিভ স্টিভ শ্যাবট ও ডেমোক্র্যাট রিপ্রেজেনটেটিভ রো খান্না মিলে হাউজে যে প্রস্তাব এনেছে, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সরকার ও নেতারা আজও বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের ওপর যে গণহত্যা চালিয়েছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী, তাকে জেনোসাইড হিসেবে স্বীকার করেনি।
এমনকি তার জন্য পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করে কোনো পদক্ষেপও নেয়নি। এবার স্টিভ শ্যাবট ও রো খান্না জেনোসাইড স্বীকৃতির জন্য তাদের প্রতিনিধি পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। দুজন হাউজ রিপ্রেজেনটেটিভস যে ঐতিহাসিক কাজটি করেছে, তার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। ৫১ বছর আগে পাকিস্তানি সামরিক সরকারের দেশের এক প্রদেশের গণমানুষের ওপর যে নগ্ন নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছিল, পরবর্তীকালে পাকিস্তানি সরকার তার জন্য লজ্জিত তো হয়ইনি, ক্ষমাও চায়নি।
তার মানে, তারা ওই জেনোসাইডকে বৈধ মনে করেছে। সেটা পাকিস্তানি জনগণ না হোক সরকার ও রাজনীতিকদের মধ্যেও নেই তা নিয়ে কোনো অনুশোচনা এবং অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমাপ্রার্থনা করেনি। মানুষ হত্যা, ইডেজেনিয়াস মানুষ কিংবা ভিন্ন সংস্কৃতির, ভিন্ন ধর্ম ও বিশ্বাসের মানুষকে দমনের জন্য যে সামরিক নির্মমতার পথ অনুসরণ করা হয়েছিল, যা কোনো মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়, এটা তখনও মানবতাবাদী মানুষ যেমন মেনে নেয়নি, তেমনি আমরাও, আজও যারা সেই গণহত্যার শিকার হয়েছি, মেনে নেবো না।
মাত্র ৯ মাসে পাকিস্তানি সেনারা, এদেশীয় রাজাকার-আল বদর ও আল শামসের সহযোগিতায় ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করেছে, এক ব্রাশফায়ারে একটি পাড়ার সব মানুষকে হত্যা করেছে, জ্বালিয়ে দিয়েছে গোটা একটি পাড়ার বসতবাটি, সহায় সম্পদ এবং উল্লসিত হয়েছে সেই রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে- সেই নির্মম গণহত্যার দৃশ্য ও কান্নার চিৎকার, পাকিস্তানিদের সেই নৃশংস অপরাধ কি আমরা ভুলে যাবো? ভুলে গেছি? নাকি কোনো কালে ভোলা সম্ভব?
না, আমরা ভুলিনি, ভুলবো না। পৃথিবীর অনেক মানুষও ভুলতে পারেনি, ভুলতে পারবে না। আমরা কি হিটলারের গণহত্যার নির্মম কাহিনি ভুলে গেছি? না, পৃথিবীর মানুষের পক্ষে, যে কোনো জেনোসাইড, মানবতাবিরোধী হত্যাযজ্ঞের বিষয়টি ভোলা সম্ভব নয়? আমরাও বাংলাদেশের আপামর জনগণ পাকিস্তানি বর্বরতার ইতিবৃত্ত কোনো দিন ভুলে যাব না। ভুলতে পারব না। ওহাইও’র ডেমোক্র্যাট রক খান্না, মনে হয় ইন্ডিয়ান অরিজিন, তিনি যে ভোলেননি, তিনি তার সহকর্মী শ্যাবটকে জানিয়েছেন বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর বিষয়টি, তা বোঝা যায়। এভাবেই এক কান থেকে অন্য এক কানে পৌঁছে যায় গণহত্যার নির্মম ঘটনা। এবং ইতিহাসের পাতায় তা রক্তে লেখা থাকবেই।
আমার মনে হয় হাউজে ডেমোক্র্যাটরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রস্তাব ওঠেনি। রিপাবলিক্যানদের পক্ষ থেকেও কোনো প্রস্তাব আসেনি। তবে এ দুটি দলের অনেক সদস্যই যে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর গণহত্যা চালিয়েছিল, সেই ইতিহাস তাদের জানা আছে। কেননা, আইনপ্রণেতাদের বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়-আশয় নিয়ে পড়াশোনো করতে হয় বা জানতে হয়। বাংলাদেশের তরফ থেকেও আমেরিকান কংগ্রেসের কাছে ওই নির্মম হত্যাযজ্ঞের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই।
সে রকম কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলেও যে তার কোনো ফলোআপ নেই, তা বোঝা যায়। ক্ষমতার চেয়ারে একবার বসতে পারলে সব অতীত ধোঁয়াশাপূর্ণ বলে মনে হয়। আবার এ প্রশ্নও উঠতে পারে যে আমরা কেন মার্কিনি আইনপ্রণেতাদের কাছে গণহত্যার স্বীকৃতি চাইবো- যখন ১৯৭১ সালে মার্কিনি প্রশাসন ও সামরিক বাহিনী ছিল জেনোসাইডারদের পক্ষে, আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে।
সেই রকম একটি দেশের হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভের সদস্যদের কাছে ওই স্বীকৃতি চাওয়া কি ঠিক? না কি তা যুক্তি সঙ্গত? তবে, বাংলাদেশ সেটা চায়নি। প্রতিনিধি পরিষদের দুই সদস্য চেয়েছে। একটি বিষয় স্পষ্ট যে বাংলাদেশিরা মাথা নোয়াতে জানে না। তাই তো জেনোসাইডের স্বীকৃতি চায়নি কারও কাছে। তবে কয়েকটি মুসলিম দেশের চাপের কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছিল। কারণ তাদের স্বীকৃতি ছাড়া আন্তর্জাতিক সমাজের কাছ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন ছিল। সেই ক্রান্তিলগ্নে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই তালিকায় মার্কিনিরাও ছিল, পাকিস্তানের স্বীকৃতিরও প্রয়োজন ছিল আমাদের, চীনের সহযোগিতা ও স্বীকৃতিরও দরকার ছিল। সে সব বেদনার ইতিহাস আমরা ভুলে যাইনি। সাহায্য ও আর্থিক সহযোগিতার জন্য কিছুটা ছাড় তো দিতেই হবে। হবে না?
বরং মার্কিনি প্রতিনিধি পরিষদের দুই দলের দুইজন সদস্য যে বিলটি উপস্থাপন করেছে, তাও এক ঐতিহাসিক ঘটনাই বলতে হবে। কারণ, পাকিস্তানি সামরিক সরকার যখন পূর্ব পাকিস্তানে, আজকের বাংলাদেশে গণহত্যা চালাচ্ছে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের পক্ষে ছিল। আজ যদি সেই মার্কিনি পরিষদ বিলটি অনুমোদন করে, তাহলে তো তাদেরই নৈতিক পরাজয় হবে।
মার্কিনিরা যে ১৯৭১ সালে ভুল করেছিল, তা আজ শুধরানো যায়, যাবে। হাউজের সদস্যরা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে প্রস্তাবটি পাস করেন, তাহলে ওই প্রস্তাব বিল হিসেবে যাবে সিনেটে। সিনেট এখন রিপাবলিক্যানদের দখলে। তারাও যদি কনসিডার করেন প্রস্তাবটি বিল আকারে পাস করতে, তাহলে তা যাবে প্রেসিডেন্টের কাছে স্বাক্ষর নেওয়ার জন্য। তিনি স্বাক্ষর করলেই মিলবে সেই স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি পেয়ে বাংলাদেশের কি লাভ?
না, তেমন কোনো লাভ নেই, আক্ষরিক অর্থে। কিন্তু ইতিহাসের লাভ অনেক। সে বিবেচনায় আপাতত আমরা যাবো না। নৈতিক দিক থেকে গণহত্যার পেছনে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক ও মানসিকতায় নেমে আসতে পারে ধস, যা খুব জরুরি এখনো। এখনো পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নানা কায়দা কৌশলে সে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যার দরুন সে দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও রাষ্ট্র কাঠামোয় গণতন্ত্র বিকাশ লাভ করেনি।
কেবল তাদের জন্যই এটা জরুরি নয়, তৃতীয় বিশ্বের যে সব দেশে সামরিক শাসন চলছে তারা জাতিগত গণহত্যারর সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পাবে। যেমন পাকিস্তানি সরকার জেনোসাইডের হুকুমদাতা কশাই নামে খ্যাত জেনারেল টিক্কা খানকে তাদের সেনাপ্রধান করেছিল। বরং গণহত্যার অপরাধে তার বিচার যদি হতো, তাহলে ন্যায় প্রতিষ্ঠা ছিল সম্ভব। যে রাষ্ট্রটি তার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার বিচার করে না, বরং আসকারা দিয়ে মাথায় তুলে রাখে, তারা আর যাই হোক কোনো দিনই ন্যায় কি জিনিস তা বুঝতে পারবে না। পাকিস্তানি রাজনীতিকদেরও সামরিক ব্রেন। এটাই প্রমাণিত হয়েছে। ওই ব্রেনে গণতন্ত্র ঢুকবে না।
গত ৫১ বছর ধরে এটাই তো দেখছি। মার্কিনি দুই তরফের দুজন রাজনীতিক মিলে বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর অপরাধে পাকিস্তার সরকারকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে আহ্বান জানিয়েছে। আর জো বাইডেনকে বাংলাদেশিদের হত্যার বিষয়টিকে জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
আমরা আশাবাদী, জো বাইডেন মানবিক মানুষ। তার দলও গণমানুষেরই পক্ষের স্বার্থ নিয়ে কাজ করে। ধারণা করি রক ও শ্যবটের যৌথ প্রস্তাব বিল হাউজের সদস্যরা অনুমোদন করবেন এবং তা সিনেটেও একইভাবে পাস হবে। বাইডেনের জয় হোক, আমাদের ওপর যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, তা গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি পাক।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম