ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ঈদে মিলাদুন্নবী

মহানবির (সা.) অতুলনীয় জীবনাদর্শ

মাহমুদ আহমদ | প্রকাশিত: ১০:০০ এএম, ০৯ অক্টোবর ২০২২

আজ পবিত্র ১২ রবিউল আউয়াল। এই পবিত্র মাসে বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত এবং নবীকুল শিরোমণি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন হয়েছিল রহমত রূপে। মহানবির সমগ্র জীবন অতিবাহিত হয়েছে মানুষের মুক্তি সাধন, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা, ঐক্য বিধান ও মানুষকে সুসভ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। তিনি (সা.) বলেছেন ‘আমাকে সাদা কালো নির্বিশেষে সকলের জন্য পাঠানো হয়েছে’ (মুসনাদে আহমদ)। তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাঝে ক্ষমার অনুপম দৃষ্টান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

মহানবির (সা.) আদর্শ এতটাই অতুলনীয় ছিল যে, তিনি ইহুদির লাশকেও সম্মান দেখিয়েছেন। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, একবার এক ইহুদির লাশ বিশ্বনবির (সা.) সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর এতে মহানবি (সা.) সেই লাশের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না লাশটি তার সামনে থেকে চলে যায়।

পাশ থেকে হজরত জাবের (রা.) বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! এটি তো ইহুদির লাশ। এতে আল্লাহর রাসুল উত্তর দিয়েছিলন, সে কি মানুষ ছিল না? (সহিহ বোখারি, হাদিস নং ১৩১১)। যে নবি এক ইহুদির লাশকে সম্মান জানানোর জন্য তার সাথীদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সেই নবির উম্মতের পক্ষে কীভাবে সম্ভব শুধু ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণে কারও ওপর অন্যায় অত্যাচার করা?

কতই না অতুলনীয় ছিল মহানবির (সা.) জীবনাদর্শ। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) বর্ণনা করেন, ‘একদা মসজিদে এক মরুচারী বা বেদুঈন আসে আর সেখানেই প্রস্রাব করতে বসে পড়ে। লোকজন তার দিকে ধেয়ে আসে বা ছুটে যায়। মহানবি (সা.) লোকদের বারণ করে বলেন, একে ছেড়ে দাও আর সে যেখানে প্রস্রাব করেছে সেখানে পানির বালতি ঢেলে দাও। তোমরা লোকদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সৃষ্টি হয়েছ, কাঠিন্যের জন্য নয়।’ (বোখারি)

এরপর দেখুন, মহানবি (সা.) এর ঘরে এক ইহুদির অতিথি হওয়া ও এরপর মহানবির (সা.) অতিমানবীয় আপ্যায়নের ঘটনা খুবই বিখ্যাত। রাসুল (সা.) এর সুমহান উদারতা ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে সে ইসলামও গ্রহণ করে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর ঐতিহাসিক উদার চরিত্রকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে, ‘তোমার ধর্মে অবিশ্বাসীদের তুমি ঘৃণা নাহি করে/আপনি তাদের করিয়াছ সেবা ঠাঁই দিয়ে নিজ ঘরে।’

এরপর দেখুন, মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির বেশ কটি ধারা ছিল মুসলিম স্বার্থবিরোধী। তা সত্ত্বেও সুদূরপ্রসারী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহানবি (সা.) এর নামের সঙ্গে ‘রাসুলুল্লাহ’ লেখা যাবে না মর্মে আপত্তি জানিয়ে বলল, আমি যদি সাক্ষ্য দিতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসুল, তাহলে তো আর আপনার সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ হতো না, আপনাকে বায়তুল্লাহ যেতে বাধা দিতাম না।

তখন রাসুল (সা.) সন্ধির লেখক আলীকে (রা.) বললেন ‘রাসুলুল্লাহ’ শব্দটি কেটে দিয়ে ওর ইচ্ছানুযায়ী শুধু আমার নাম লেখো। এতে আলী (রা.) অপারগতা প্রকাশ করলে রাসুল (সা.) জিজ্ঞেস করেন কোথায় লেখা আছে, এরপর নিজ হাতেই তা কেটে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও উদারতার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত পেশ করেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম: ৪/৬১, ইফাবা, ২য় সংস্করণ: ২০০৮ খ্রি.)

ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, মক্কা বিজয়ের দিন মহানবি (সা.) বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করলে কুরাইশদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মহানবি (সা.) বিজিত শক্রদের প্রতি কোনো ধরনের দুর্ব্যবহার তো দূরের কথা কিঞ্চিৎ পরিমাণ ও প্রতিশোধস্পৃহা প্রকাশ করেননি বরং শত্রুদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন।

তিনি কুরাইশদের বলেছেন, ‘হে কুরাইশরা! আমি তোমাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করব বলে তোমরা মনে করো?’ তারা বলল, আপনি আমাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করবেন বলে আমাদের ধারণা। আপনি দয়ালু ভাই। দয়ালু ভাইয়ের পুত্র। অতঃপর রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে সেই কথাই বলছি, যে কথা হজরত ইউসুফ (আ.) তার ভাইদের উদ্দেশে বলেছিলেন, আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। যাও তোমরা সবাই মুক্ত।’ (আর রাখিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা : ৪৩৯, আল কুরআন একাডেমি লন্ডন; ২০০৮)

সাহাবা রেযওয়ানুল্লাহি আলাইহিম বর্ণনা করেন, তিনি পরম সহানুভূতিশীল, কোমল প্রকৃতি এবং সহিষ্ণু স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। প্রত্যেকের সাথে সদয় ব্যবহার করতেন। তিনি (সা.) বলতেন, কোমলতা বিষয়কে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে। যে বিষয় হতে নম্রতা বা কোমলতা বের করে দেওয়া হয় তা অসুন্দর হয়ে যায়। একজন সাহাবি বর্ণনা করেন, একবার এক যুদ্ধের সময় ভিড়ের কারণে আমার পা মহানবির (সা.) পায়ের ওপর পড়ে, আমার শক্ত জুতার কারণে তার প্রচণ্ড কষ্ট হয়, তখন তিনি (সা.) তার লাঠি দিয়ে একথা বলে আমার পা সরিয়ে দেন যে, বিসমিল্লাহ! তুমি আমার পা’কে ক্ষত-বিক্ষত করেছ। এতে আমার খুবই অনুশোচনা হয়। পুরো রাত চিন্তিত থাকি। পরের দিন কেউ আমার নাম ধরে ডেকে বলে, হুজুর (সা.) তোমাকে ডাকছেন।

আমি চরম ভীতি নিয়ে এই ভেবে তার সমীপে উপস্থিত হই যে, সম্ভবত এখন শাস্তি পাবো। কিন্তু তিনি পরম স্নেহের সাথে বলেন, গতকাল আমি আমার লাঠি দ্বারা তোমার পা সরিয়ে দিয়েছিলাম এজন্য আমি খুবই লজ্জিত। এর বিনিময়ে এই ৮০টি ছাগল উপহার দিচ্ছি, গ্রহণ করো আর এ বিষয়টি মন থেকে বের করে দাও অর্থাৎ ভুলে যাও। (মুসনাদ দারমি, হাদিকাতুস সালেহিন, পৃ: ৫৭)

হাদিসে এসেছে হজরত সাঈদ বিন আবি সাঈদ (রা.) বর্ণনা করেন, তিনি হজরত আবু হুরায়রাহকে (রা.) একথা বলতে শুনেছেন; মহানবি (সা.) নজদ অভিমুখে যুদ্ধ অভিযান প্রেরণ করেন আর তারা বনু হানিফার এক ব্যক্তি সুমামাহ বিন আসালকে বন্দি করে নিয়ে আসেন। সাহাবিরা তাকে মসজিদে নববীর খুটির সাথে বেঁধে রাখেন। মহানবি (সা.) তার কাছে এসে বলেন, হে সুমামাহ! তোমার কাছে কি অজুহাত আছে বা তোমার সাথে কি ব্যবহার করা হবে বলে তুমি মনে কর।

সে বললো আমার সুধারণা রয়েছে। যদি আপনি (সা.) আমাকে হত্যা করেন তাহলে আপনি একজন খুনিকে হত্যা করবেন। আর যদি আপনি আমাকে ক্ষমা করেন তাহলে আপনি এমন এক ব্যক্তিকে ক্ষমা করবেন যে এর মূল্যায়ন করতে জানে। কিন্তু যদি আপনি (সা.) সম্পদ চান তাহলে যত ইচ্ছে নিয়ে নিন। এভাবেই পরের দিবস উদয় হয়। তিনি (সা.) আবারো আসেন এবং সুমামাহকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার সংকল্প কি? সুমামাহ্ বলেন, আমি তো গতকালই আপনার সমীপে নিবদেন করেছি, যদি আপনি আমাকে ক্ষমা করেন তাহলে আপনি এমন এক ব্যক্তিকে ক্ষমা করবেন যে এ অনুগ্রহের মূল্যায়ন করতে জানে। তিনি এখানেই কথা বন্ধ করেন আর পরের দিন সূর্য উদয়ের পর পুনরায় বলেন, হে সুমামাহ তোমার নিয়্যত কি? সে বললো, আমার যা কিছু বলার ছিল তা বলেছি।

তিনি (সা.) বলেন, একে মুক্ত করে দাও। সুমামাহ মসজিদের কাছে খেজুর বাগানে যায়, গোসল করে মসজিদে প্রবেশ করে কলেমা শাহাদত পাঠ করে বলে, হে মুহাম্মদ (সা.)! আল্লাহর কসম পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে বেশি অপছন্দ ছিল আপনার চেহারা আর বর্তমান অবস্থা এমন যে, আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় হচ্ছে আপনার চেহারা। আল্লাহর কসম পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে বেশি অপছন্দ ছিল আপনার ধর্ম আর বর্তমান অবস্থায় আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয় হচ্ছে আপনার আনীত ধর্ম।

আল্লাহর কসম! পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করতাম আপনার শহরকে আর এখন এ শহরই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়। আপনার (সা.) ঘোড় সওয়ারিরা তখন আমাকে ধরেছে যখন আমি উমরাহ করতে চাচ্ছিলাম। এ ব্যাপারে আপনার নির্দেশনা কি? রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে শুভসংবাদ দেন আর তাকে উমরাহ করার নির্দেশ দেন। যখন তিনি মক্কায় পৌঁছেন তখন কেই বললো, তুমি কি সাবি হয়ে গেছ? উত্তরে সে বললো, না, আমি মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি ঈমান এনেছি।’ (বুখারি)

একটু ভেবে দেখুন, তিনি (সা.) তিনদিন পর্যন্ত তাকে ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত করার প্রজ্ঞাপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করেন যাতে সে মুসলমানদের ইবাদতের রীতি-পদ্ধতি ও নিষ্ঠা এবং আপন প্রভুর সমীপে কীভাবে অনুনয় বিনয় করে তা দেখতে পায়। এবং মুসলমানরা মহানবির (সা.) প্রতি কীভাবে ভালোবাসা ও প্রীতি প্রকাশ করে আর তিনি (সা.) তার মান্যকারীদের কি শিক্ষা প্রদান করেন। মহানবি (সা.) তাকে সরাসরি কোনো তবলিগ করেননি। কেবল প্রত্যহ জিজ্ঞাসা করতেন, তোমার সংকল্প কি? যাতে বুঝতে পারেন এর ওপর কোনো প্রভাব পড়েছে কি না; এবং তৃতীয় দিন তাঁর দিব্য শক্তি বুঝতে পেরেছে যে, এখন এর মধ্যে কোমলতা সৃষ্টি হয়েছে। তাই কোনো অঙ্গীকার ছাড়াই তাকে মুক্ত করে দেন তারপর যে ফলাফল সৃষ্টি হয়েছে অর্থাৎ তার ইসলাম গ্রহণ প্রমাণ করে যে, তার (সা.) ধারণা সঠিক ছিল।

ক্ষমা ও মহানুভবতার এমন দৃষ্টান্ত মহানবির (সা.) জীবনে আমরা আরও উজ্জ্বলভাবে দেখতে পাই। সেকালে আরবরা মহানবির (সা.) পবিত্র দেহকে পাথরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করেছে, বিষ প্রয়োগ করে তাকে হত্যার চক্রান্ত করেছে, হিংসা-ক্রোধ ও পাশবিকতায় উন্নত হয়ে তার চাচার হৃৎপিণ্ড প্রকাশ্যে চর্বণ করেছে, তাড়িয়ে দিয়েছে তাকে জন্মভূমি থেকে। এমনকি যে ব্যক্তির নির্মম আঘাতের দরুন তার প্রিয়তম কন্যার মৃত্যু ঘটেছিল, মক্কা বিজয়ের পরে তিনি সেই অত্যাচারীদের অকুণ্ঠচিত্তে এবং হাসিমুখে ক্ষমা করে দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে মহত্তম নিদর্শন ঔদার্য ও মহানুভবতার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

ক্ষমার যে দৃষ্টান্ত মহানবি (সা.) প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তা ছিল অসাধারণ। আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা এবং শ্রেষ্ঠনবির আদর্শ মোতাবেক জীবন পরিচালনা এবং তার প্রতি অধিকহারে দরুদ পাঠ করার তাওফিক দান করুন, আমিন।

‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিউ ওয়া আলা আলি মুহাম্মদ ওয়া বারিক ওয়া সাল্লাম ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ।’

এইচআর/ফারুক/এমএস