ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আত্মহত্যা

নিজেকে ভালোবাসাই উত্তম পন্থা

মোহাম্মদ রাহীম উদ্দিন | প্রকাশিত: ০৯:৫৫ এএম, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২

ডেল (ব্রাকনেরডিজ) কার্নেগি ছিলেন একজন আমেরিকান লেখক, অধ্যাপক ও একাধারে বিখ্যাত আত্ম-উন্নয়নমূলক প্রশক্ষিণমালার উদ্ভাবক। তিনি দরিদ্র মজুর কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রথম জীবনে তেমন সাফল্য না পেলেও এখন সারা বিশ্বে একজন সফল ব্যক্তিত্ব হিসেবে অমর হয়ে আছেন তিনি। তাঁর প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নিয়ে হাজার হাজার হতাশ মানুষ আশার আলো দেখেছেন। মানুষকে সফল হতে তিনি উদ্দীপনামূলক অনেক বই লিখেছেন। তার মধ্যে “How to Stop Worrying and Start Living” এবং “How to Win Friends and Influence People” বেশ জনপ্রিয় বই।

এ বইগুলো আজও অনেকের আগ্রহের বিষয়। তার লেখা পড়ে পাঠকরা উদ্বুদ্ধ হন। তার কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করে লাভ করেন সাফল্য। কিন্তু জনশ্রুতি আছে শেষ জীবনে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়ে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন তিনি। ইতিহাসখ্যাত আরও অনেক কালজয়ী ব্যক্তির মধ্যে রানি ক্লিওপেট্রা, রোমান সম্রাট নিরো, চিত্রশিল্পী ভ্যান গগ্, প্রখ্যাত আমেরিকান লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো এবং লিন্কিন পার্ক ব্যান্ডের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী চেষ্টার বেনিংটন, বাংলাদেশি তারকা মডেল রিসিলা প্রমুখ এবং গত ২৩ আগস্ট রাজধানীর প্রথমসারির বিদ্যালয় হলিক্রস স্কুলের এক শিক্ষার্থী তেজগাঁওয়ের একটি বহুতল ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে জীবনের অবসান ঘটিয়েছেন। আত্মহত্যা বা আত্মহনন হচ্ছে একজন ব্যক্তি কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়া বিশেষ। লাতিন ভাষায় সুই সেইডেয়ার থেকে আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে হত্যা করা।

আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি আত্মহত্যাকে মানসিক অসুস্থতা সংক্রান্ত বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশেই আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে এক ধরনের অপরাধরূপে ঘোষণা করা হয়েছে। অনেক ধর্মেই আত্মহত্যাকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর সারা বিশ্বে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশতম প্রধান কারণ। নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞানুসারে, আত্মহত্যা হলো সজ্ঞানে এমন একটি ভয়ানক কাজ করা, যা কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায় এবং ব্যক্তি ওই কাজের প্রত্যাশিত ফলাফল সম্পর্কে পূর্ব থকেইে পুরোপুরি অবগত থাকে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে, আত্মহত্যা একটি অপ্রতিরোধ্য সামাজিক এবং মানসকি ব্যাধি। অনেকেই একে সমস্যার সমাধান মনে করলেও এটি কোনো সমস্যার সমাধান নয় বরং সমস্যার কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি তিন সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যার প্রচেষ্টা এবং প্রতি মিনিটে একজন আত্মহত্যা করে। সারা বিশ্বে বছরে প্রায় দশ লাখ মানুষ আত্মহত্যাজনিত কারণে প্রাণ হারায়।

গত ছয় বছরে আত্মহত্যা নিয়ে যে পরসিংখ্যান (পুলিশ সদর দপ্তর) দাঁড় করানো হয়েছে তা থেকে দেখা যায় যে প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। Global Health Observatory Data Repository’র তথ্য মতে, প্রতি ১ লাখ লোকের মধ্যে বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার ৩.৭% apps.who.int/gho/data/node.main.MHSUICIDE

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে আত্মহত্যায় বর্তমানে ১০তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে দেখা যায় যে, মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে ৮৭ শতাংশ থেকে ৯৮ শতাংশ আত্মহত্যাকর্ম সংঘটিত হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের গবেষণায় দেখা যায় যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে তাদের অধিকাংশই মানসিক রোগে আক্রান্ত থাকে। যখন একজন মানুষ তার সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য কোনো পথ খোলা পায় না, তখন তা হতাশার তৈরি করে। আর এই হতাশা তার ভিতরের aggressive ভাবটাকে বাড়িয়ে দেয়। তখন যদি কেউ যুক্তি দিয়ে তাকে না বোঝায় যে তার সমস্যার সমাধানের ভিন্ন ভিন্ন পথ আছে তখনই সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

বিখ্যাত সমাজ মনোবিজ্ঞানী কার্ট লিউইনের মতে, ‘পরিবেশের সাথে মানুষের আচরণগত একটা কার্যকারিতা (ফাংশন) আছে’। অর্থাৎ মানুষ সেসব আচরণ করে তা সে পরিবেশের প্রভাবের কারণে করে। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বেকারত্ব, দারিদ্র্যতা, গৃহহীনতা এবং বৈষম্যতাজনিত উপাদানগুলো আত্মহত্যায় উৎসাহিত করে।

আত্মহত্যার অনেক কারণের মধ্যে পারিবারিক কলহ বিবাদ, বৈবাহিক সমস্যা, শারীরিক ও মানসিক রোগ, প্রেমে বিফলতা, যৌতুকের চাপ, পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, বেকারত্ব, অবৈধ যৌনকর্ম, অবৈধ সন্তান ধারণ, সঠিক শিক্ষা, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবই আমাদের দেশে আত্মহত্যার চিহ্নিত কারণ। যে সব ব্যক্তি দুশ্চিন্তায় পড়েন তারা আত্মহত্যায় সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দলের অন্তর্ভুক্ত।

উন্নত দেশে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চরম মুহূর্তজনিত হটলাইন রয়েছে, যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তাদের চিন্তা-ভাবনা এবং আত্মহত্যার পরিকল্পনার কথা জানায়। হটলাইন ব্যবহারের মাধ্যমে ভুক্তভোগী তার সমস্যার সমাধানের পথ সম্পর্কে অবহিত হয়ে আত্মহত্যা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে। আমাদের দেশে ঢাকায় অবস্থিত বেসরকারিভাবে ‘কান পেতে রই’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী দল সীমিত পরিসরে এধরনের সেবা প্রদান করে।

আত্মহত্যা প্রতিরোধে যেসব পদক্ষেপ বা কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে তা হচ্ছে আত্মহত্যার মাধ্যমগুলোর প্রতি চোখ রাখা। যেহেতু আমাদের দেশে বিষপানে আত্মহত্যা করে বেশি লোক, তাই এসব উপকরণ দুষ্প্রাপ্য করতে হবে। বিনা প্রেসক্রিপসনে ওষুধ বিক্রি বন্ধ করা। পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন ও নাটক সিনেমার মাধ্যমে আত্মহত্যার ব্যাপারে লোকদের সচেতন করতে হবে। বিশেষ করে বিষণ্নতা ও ড্রাগসেবীদের ব্যাপরে আলোকপাত করতে হবে। মানসিক ও শারীরিক রোগীদের সময়মতো পর্যাপ্ত চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন।

যখন একজন ব্যক্তি আত্মহত্যার বিষয়ে ব্যাপক চিন্তা-ভাবনা করেন, তখনই তাকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। মনোবিদরা বলেন যে, যখন ব্যক্তি নিজেকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে তা জানামাত্রই সংশ্লিষ্টদের উচিত হবে কাউকে জানানো। আত্মহত্যা প্রতিকার ও প্রতিরোধের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সংস্থা গোষ্ঠী প্রচারণা চালিয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে পারে।

পারিবারিক কলহ-বিবাদ মেটানো বা কমানোর জন্য সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বাড়াতে হবে। আত্মহত্যা কমানোর জন্য একটা জাতীয় নীতি প্রণয়ন করতে হবে। অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি, শিক্ষার হার বাড়ানো, বেকারত্ব কমানো, নেশার উপকরণ দুষ্প্রাপ্য করা, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন অটুট রাখার জন্য সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বিকল্প নেই আত্মহত্যা প্রতিরোধে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নিজেকে ভালোবাসাকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

লেখক: কলামিস্ট, এলামনাই ও লাইফ মেম্বার- বাংলাদেশ সাইকোমেট্রিক সোসাইটি।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

আরও পড়ুন