বজ্রপাতে মৃত্যু
চাই প্রতিকার ও সচেতনতা
মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলায় বিলে শাপলা তোলার সময় বজ্রপাতে তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শনিবার (১০ সেপ্টেম্বর) দুপুর আড়াইটার দিকে উপজেলার ধামারণ ইউনিয়নের পশ্চিমের চক বিলে এ ঘটনা ঘটে। শিশু তিনটি কি অভিভাবকহীন ছিল? নিশ্চয়ই না, তবে কেন তাদের অভিভাবক তাদের খবর রাখেনি? প্রশ্নটা আসতেই পারে।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলায় বজ্রপাতে ৯ জন মারা গেছেন। ৮ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে উপজেলার পঞ্চক্রোশী ইউনিয়নের মাটিকরা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। বিকেলে মাটিকরা গ্রামের একটি জমিতে চারা তোলার কাজ করছিলেন শ্রমিকরা। এ সময় বৃষ্টি ও বজ্রপাত শুরু হলে তারা মাঠের ভেতর একটি ঘরে আশ্রয় নেন। তখন সেখানে বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই আটজন মারা যান। বজ্রপাতে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হবে এমন কথা কি তারা কখনও শোনেনি? এমনটা ভাবা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এভাবেই প্রতিনিয়ত বজ্রপাতের কবলে পড়ছে শিশু থেকে বৃদ্ধ।
বজ্রপাত প্রতিরোধে সচেতনতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে বজ্রপাত। বাড়ছে মৃত্যু সংখ্যা কিন্তু বাড়েনি সচেতনতা। অনেকে ভাবছে ঝড় শেষ বজ্রপাতও শেষ। কিন্তু না। সাধারণত এপ্রিল মাসকে বজ্রপাত শুরুর মাস হিসেবে ধরা হয়। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বজ্রপাত হয়। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে- এক সমীক্ষায় দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বজ্রপাতের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি।
এই বৃদ্ধি জলবায়ুগত এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানের পরিবর্তনের ফল তা সহজেই বলা যায়। অন্য যে কোনো দুর্যোগের চেয়ে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিনিয়ত প্রতিবেদন হওয়ার পরও এমন মৃত্যু কাম্য হতে পারে না। ঘটনার বিবরণ থেকে বোঝা যায় সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। সচেতনতা না বাড়লে বাড়বে মৃত্যুর ঝুঁকি।
তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বজ্রপাতে ২ হাজার ৭৭৪ জন মানুষ মারা যায়। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে বজ্রপাতে মৃত্যু নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মে মাসে এটি আরও বেশি। দুর্যোগ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ডিজাস্টার ফোরামের এক প্রতিবেদন বলছে, গত দেড় মাসে বজ্রপাতে ১৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বেশি মানুষ মারা গেছে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও গাইবান্ধা জেলায়। বিভাগের মধ্যে বেশি মানুষ মারা গেছে সিলেটে। বজ্রপাতে যারা মারা গেছে তাদের অধিকাংশই মাছ ধরছিল বা খোলা স্থানে কাজ করছিল।
সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডার স্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের তথ্য মতে, ২০২০ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল এ চার মাসে বজ্রপাতে সারাদেশে ৭৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সাধারণত জানুয়ারি মাসে প্রচণ্ড শীত থাকায় এ মাসে বজ্রপাত হয় না। তবে ওই বছর কনকনে শীতের মধ্যেও জানুয়ারি মাসে বজ্রপাতে নিহত হয়েছে তিনজন। তারা তিনজনই পুরুষ। ফেব্রুয়ারি মাসে কোনো হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও মার্চ মাসে ছয়জন এবং এপ্রিল মাসে ৭০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
এপ্রিল মাসে মোট নিহত হয়েছেন ৭০ জন। সবচেয়ে বেশি ৪০ জন নিহত হয়েছে কৃষিকাজ করার সময়। ২০১৯ সালে মে মাসে মারা যায় ৬০ জন। ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি ৩৫৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৬ সালে চারদিনে ৮১ জনের প্রাণহানির পর নড়েচড়ে বসে সরকার। সে বছরই বজ্রপাতকে দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়। সে বছর ১২ মে একদিনে মারা যায় ৩৪ জন।
বজ্রপাতের বিস্তর গবেষণায় দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তন, লম্বা গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, আকাশে কালো মেঘের পরিমাণ ও মেঘে মেঘে ঘর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে বজ্রপাত। তাপমাত্রা যত বাড়বে বজ্রপাতও ততো বাড়বে।
তাপমাত্রা গড়ে এক ডিগ্রি বেড়ে গেলে বজ্রপাত ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি বজ্রপাত বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইদানীং মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বা ঘন কালো মেঘের ওপরের ও নিচের অংশ দুটি পুল হিসেবে প্রবাহিত হয়। এই কারণে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কালো মেঘের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে বজ্রপাতের পরিমাণ।
বিদ্যুৎপ্রবাহ মানুষের শরীর দিয়ে প্রবাহিত হয় অনেকটা ইলেকট্রিক শকের মতো। বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে মানুষ যেভাবে দ্রুত শক্ড হয়, ঠিক একইভাবে বজ্রপাতেও মানুষ শক্ড হয়ে মারা যায়। কারণ মানুষের শরীর বিদ্যুৎ পরিবাহী। এ কারণে মানুষের ওপর বজ্রপাত হয়। যদি কোনো খোলা স্থানে বজ্রপাত হওয়ার মতো কোনো বিদ্যুৎ পরিবাহী পদার্থ না থাকে আর সেখানে যদি মানুষ থাকে যার উচ্চতা অন্য বিদ্যুৎ পরিবাহীর চেয়ে বেশি তাহলে মানুষের ওপর বজ্রপাত হয়। সরাসরি মাটিতে সাধারণত বজ্রপাত হয় না। বজ্র বিদ্যুৎ পরিবাহীর ওপর পড়ে। এরপর ওই পরিবাহির মাধ্যমে বজ্রের বিদ্যুৎ মাটির সঙ্গে মিশে যায়। উঁচু গাছ, ভবন, পাহাড়ের শীর্ষে সাধারণত বজ্রপাত হয়। বাসাবাড়িতে লাগানো বজ্রপাত নিরোধক দণ্ডের ওপরও বজ্রপাত হয়।
বজ্রপাতের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় বজ্রপাত ঘটছে। বজ্রপাতে মুত্যুর প্রতিবেদনে দেখা যায়, অনিরাপদ স্থানে থাকার কারণেই অকালে প্রাণ হারিয়েছে অনেকে। বজ্রপাত থেকে বাঁচতে হলে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয় তা হলো নিরাপদ জায়গায় থাকতে হবে। বজ্রপাতকে গুরুত্বহীন মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ দিনের পর দিন প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে এই বজ্রপাত।
বিশেষ করে যারা ঘরের বাইরে ক্ষেতখামারে কাজ করে তারা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। যেহেতু মেঘের নিম্ন দেশের ঋণাত্মক চার্জ এবং পৃথিবীর ধণাত্মক চার্জের স্পার্কিংয়ের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি হয় এবং এই ক্ষেত্রের মধ্যে যা কিছু পড়ে তা অতিরিক্ত তাপের কারণে পুড়ে যায়। সেহেতু উঁচু স্থান অর্থাৎ উঁচু গাছ, ইলেকট্রিক পোল, মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি এরূপ বস্তুর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে।
কেননা যে স্থান বা বস্তু যত উঁচু সে স্থান মেঘের তত সন্নিকটে থাকায় বজ্রপাতের সম্ভাবনা তত বেশি। বাড়ির ছাদ কিংবা উঁচু স্থানে অবস্থান করলে দ্রুত সেখান থেকে নেমে নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। মৌসুমে ঘনকালো (ঝড়মেঘ) মেঘ দেখলেই সাবধান হতে হবে এবং বৃষ্টি শুরুর আগে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। পাকা বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া বেশি নিরাপদ। তবে পাকাবাড়ি সুউচ্চ হলে সেক্ষেত্রে বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা থাকতে হবে।
বজ্রপাতের সময় জানালার কাছে না থাকাই ভালো। পায়ে রাবারের স্যান্ডেল পরে থাকা এবং পানি ও যে কোনো ধাতববস্তুর যেমন সিঁড়ির বা বারান্দার রেলিং, পানির কল ইত্যাদির স্পর্শ থেকে বিরত থাকা বেশি নিরাপদ। বিদ্যুৎ পরিবাহী যে কোনো বস্তুর স্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে। পুকুর বা জলাশয়ে থাকা নিরাপদ নয়।
বজ্রপাতে বাড়ির ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্র যেগুলো ইলেকট্রিক সংযোগ বা ডিশের সংযোগ থাকে সেগুলো বিচ্ছিন্ন করা ভালো। নতুবা পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া এগুলো বন্ধ থাকলেও স্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে। মাঠের মধ্যে ফাঁকা জায়গায় থাকলে যদি বজ্রপাত হওয়ার অবস্থা তৈরি হয় তাহলে কানে আঙুল দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিচু হয়ে বসে থাকতে হবে। তবে মাটিতে শোয়া যাবে না, কেননা মাটিতে শুয়ে পড়লে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। গাড়িতে থাকা অবস্থায় বজ্রপাতের পরিস্থিতি তৈরি হলে গাড়ির মধ্যে থাকাই নিরাপদ। তবে মনে রাখতে হবে গাড়ির ধাতব কোনো অংশের সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে।
যতই দিন যাচ্ছে প্রকৃতি যেন বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছে। বজ্রপাতে মৃত্যু একটি পরিবারের স্বপ্নকে অকালেই ভেঙে দিচ্ছে। তাই সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রচার-প্রচারণা চালনার মাধ্যমে জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে। পাঠ্যবইয়ে পঠিত বিষয় হিসেবে সংযুক্ত করতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হয়। বজ্রপাত কোথায় এবং কীভাবে ঘটছে, কি করলে তার ঝুঁকি কমবে তা জানলে ও মানলে বজ্রপাতে মৃত্যু লোপ পাবে।
সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করলেও এর ঝুঁকি প্রশমনে দৃশ্যমান উদ্যোগ কম। বাংলাদেশে বজ্রপাতের পূর্বাভাস ও এলাকা শনাক্তকরণ যন্ত্র স্থাপন করা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু সরকার বেশ কয়েকটি স্থানে বজ্রপাত পূর্বাভাস যন্ত্র বসালেও এর ফোরকাস্টিংয়ের ব্যবস্থা এখনো করতে পারেনি।
আবার বজ্রপাতের ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রাথমিক পর্যায়ে সারাদেশে ৫০ লাখ তালগাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিলেও এটিও খুব একটি কার্যকর নয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। বজ্রপাত পূর্বাভাস যন্ত্রের আধুনিকায়ন ও নতুন প্রযুক্তির ব্যবস্থা করা হলে এই ঝুঁকি কমানো সম্ভব। সেই সাথে সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এএসএম