ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

তিস্তা নিয়ে টালবাহানা বন্ধুত্বের অংশ হতে পারে না

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম | প্রকাশিত: ০৯:৪৭ এএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২

কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফরের প্রধান বিষয়গুলোর ওপর কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম সংবলিত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি এবং তিস্তা নিয়ে কেউ লিখেছেন আবারো আশ্বাস, কেউ আবারো হিমঘরে, কেউ এবারো শুধু আশাবাদ ইত্যাদি। তিস্তাপাড়ের ভুক্তভোগী মানুষ আশাবাদী। কিন্তু দীর্ঘদিন চাতক পাখির মতো আকাশের পানে চেয়ে কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির দেখা না পেয়ে তারা চরম হতাশ ও ক্ষুব্ধ। এই লেখায় সেসব সংবাদ ও একই বিষয়ে নিকট অতীতের নানা বিষয়ের ওপর কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে।

দীর্ঘ ১২ বছর পর যৌথ নদী কমিশনের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক বসেছিল। ভাবা হচ্ছিল সেখানে তিস্তা চুক্তির এজেন্ডা চূড়ান্ত করে প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে এর একটি সফল পরিসমাপ্তি ঘটবে। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক গত ৫ সেপ্টেম্বর শেষ হয়েছে। এর একদিন পর যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে দু’দেশের অনেকগুলো চুক্তির ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছে। কুশিয়ার নদীর পানি বণ্টন চুক্তি সবচেয়ে বড় ইস্যু না হলেও সেটাকে প্রধান হিসেবে ধরে নিয়ে বড় সাফল্য হিসেবে প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু ৩০ বছর ধরে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে যে আশা সেটা আবারো অবহেলায় ফাইলবন্দি হিসেবে থেকে গেছে।

তিস্তাপাড়ের লাখ লাখ মানুষ তথা বাংলাদেশের মানুষ তিস্তা নিয়ে কালক্ষেপণের ব্যাপারে আবারো গভীর হতাশ। তিস্তার ব্যাপারে এবার কোনো আশ্বাসও দেওয়া হয়নি (প্রথম আলো ৮.০৯.২০২২)। যে আশ্বাস আগের দুই যৌথ ঘোষণায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দিয়েছিলেন। এবার এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। এই চুক্তি যে আবারো হিমঘরে চলে গেছে এ ব্যাপারে যৌথ ঘোষণায় তার প্রতিফলন লক্ষণীয়।

তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রের যে ইচ্ছা সেটা প্রাদেশিক অনীহা ও আন্দোলন ভীতির মধ্যে প্রোথিত তা আবারো প্রমাণ হয়ে গেলো। পশ্চিমবঙ্গের ঐকান্তিক ইচ্ছে না থাকলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নিজের চেষ্টায় তিস্তা চুক্তি করা সম্ভব নয়। সেকথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর মুখে বহু আগে থেকেই প্রতিফলিত হয়ে আসছে। যদিও এবারের বৈঠকের ব্যাপারে- ‘তাঁর ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে দেওয়া হয়নি’ বলে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। এ ধরনের তথ্য শুনে মনে হচ্ছে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়ের গভীর অনিচ্ছার মধ্যে তিস্তা ইস্যু নিয়ে টালবাহানা করা হয়েছে।

গত বছর তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে মমতা ব্যানার্জী বলেছেন- ‘আগে নিজে খাব, পরে তো দেব’ (দৈনিক ইত্তেফাক ৮.৩.২০২১)। কথাটি এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরের সময় উভয় দেশের অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য চুক্তি সই করার বিষয় সম্পর্কে মমতা ব্যানার্জীর সামনে তিস্তা প্রসঙ্গ উত্থাপন করার প্রতিক্রিয়া হিসেবে।

এর আগে ২০১৭ সালে তিনি বলেছিলেন, ‘তিস্তায় তো পানি নেই-চুক্তি হবে কীভাবে’? তাঁর কথা ছিল তিস্তা নয়- তোরসা, জলঢাকা, মানসাই, ধানসাই ইত্যাদি নদীতে পানি আছে। সেগুলো থেকে বাংলাদেশের জন্য পানি দেওয়া যাবে। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের তিস্তা চুক্তি নয়, দরকার তো জলের! তবে এসব ক্ষীণ জলধারাকে বর্ষাকালে নদী মনে হলেও এগুলো সারা বছর প্রবাহমান কোনো নদী নয়।

এসব নদীর কোনো অস্তিত্ব বা প্রবাহ কি বাংলাদেশে আছে? তিনি তিস্তা পানিবণ্টনের কথা অন্যখাতে নিয়ে গেছেন। কিন্তু তিস্তা সমস্যার সমাধান তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি দিয়েই করতে হবে। তার আপাতত কোনো বিকল্প নেই। কারণ, চীনের সঙ্গে তিস্তা পুনর্জীবন ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত প্রকল্পের একটি সফল বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতের বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন।

মমতা ব্যানার্জী এধরনের কথা বহুদিন ধরে শোনাচ্ছেন। সেটা নিজেদের কারণে আমাদের বাধ্য হয়ে শুনতে হচ্ছে। কিন্তু শুধু বললেই হলো? তিস্তার পানি কে সিকিমে আটকালো বা কে মহানন্দা দিয়ে সরিয়ে নিল? কোথায় গেলো? কোথায় যাচ্ছে? কোথায় কে ব্যবহার করছে বা কে কোথায় আটকে রেখে, কে খাচ্ছে? মমতা ব্যানার্জীর মুখে তিস্তায় পানি নেই উক্তিটি শোনার পর এ প্রশ্নগুলো নিয়ে মুখে ও মিডিয়ায় এখন হইহই ব্যাপার চলেছে। শুনতে খারাপ লাগলেও এটা ওপেন সিক্রেট। প্রযুক্তির বহুধা ব্যবহারের এ যুগে অনেকেই তা জানেন। এপ্রিলে উপরের বরফ গলা পানিও তিস্তা দিয়ে নেমে আসে। মমতার কথা যে সঠিক নয় তা সবাই স্বীকার করবেন। এবার বললেন নিজে আগে খাওয়ার কথা!

বহু বছর আগেই বলেছিলাম, প্রকাশিতও হয়েছিল- মমতার একাই খাব নীতি তিস্তা চুক্তির অন্তরায়। এবারও টিভিতে তাঁর বাচনভঙ্গি ও অবহেলাসূচক কথাবার্তা দেখে তাই মনে হলো। এখন মার্চ মাসের ঝাঁ ঝাঁ রোদেজ্বলা খরার সময়। আমরা বাংলাদেশে প্রবল তৃষ্ণার্ত ও উৎকণ্ঠিত। এমন সময় মমতার মমত্বহীন কণ্ঠ আমাদের আবারো হতাশ করেছে- করেছে ক্ষোভে ভারাক্রান্ত।

সাবেক একজন পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, ‘ভারত সবই পেয়েছে... এবারের বৈঠকে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন প্রসঙ্গে কোনো ইঙ্গিত নেই।’ শুধু সভার পর সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে। সব সময় শুধু আশ্বাস দিয়ে সভা শেষ করা হয়েছে। এতবড় আন্তর্জাতিক দ্বিপাক্ষিক সমস্যা হওয়া সত্ত্বেও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি কোনো কার্যকর সমাধানের দিকে গড়ায়নি।

তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার এজেন্ডা নিয়ে মোট কতবার মিটিং-বৈঠক হয়েছে মনে আছে কী? বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সভা করার হিসাব অনুযায়ী ৯৬ বার বসা পূরণ হয়েছিল কয়েক বছর আগেই! সেই ১৯৯৮ সালে ডালিয়ার ‘অবসর’, ঢাকার সচিবালয়, নানা জায়গায় বহুবার অতীতের বহু রাষ্ট্রপতি-মন্ত্রী-সচিব কমিটি, টেকনিকাল কমিটি, সংসদীয় কমিটির প্রচেষ্টা ভন্ডুল করে ২০১৭ সালে দিল্লির রাজপ্রাসাদের ঝলমলে আলোয় বন্ধুত্বের উষ্ণতার মধ্যে আলোচনার ফলাফলে অনেক ইতিবাচক আশা ছিল।

তখন আমাদের আশার ওপর ‘বাড়া ভাতে ছাই’ দেওয়ার কাজটি করেছিলেন মমতা ব্যানার্জী। সেবার ৩৬টি চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরিত হলেও তিস্তাকে সুকৌশলে বাদ রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন মমতার কথা, আর মমতা বলেছিলেন ভিন্ন কথা-যেখানে বাংলাদেশের মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী অক্টোবর ৫, ২০১৯ সালে বলেছেন দ্রুততম সময়ে তিস্তা চুক্তি করা হবে। ইন্টারনেটের এই যুগে দ্রুততম সময় বলতে চোখের পলক বোঝানো হয়।

প্রধানমন্ত্রী মোদী কি এ বিষয়ে মমতার সাথে পরামর্শ করে বলেছেন? কারণ ২০১৭ সালে আমরা দেখেছি কেন্দ্রকে মমতা ব্যানার্জী তোয়াক্কা করেন না। ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরের সময় উভয় দেশের অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য একটি বড় সুযোগ এসেছে। কিন্তু তিস্তা প্রসঙ্গ নিয়ে ইতোমধ্যে সেখানেও নানা বাগড়া বসানো হয়েছে।

আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, ওগুলো বাদ, এটা আনন্দ উৎসব। তিস্তা সমস্যা নিয়ে চিন্তা পরে হবে! পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেছেন, ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সই হয়ে গেছে ১০ বছর আগেই। তবে বাস্তবায়ন হয়নি। তিস্তা চুক্তি নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তিস্তা তো অলরেডি ১০ বছর আগে চুক্তি হয়ে গেছে। বাস্তবায়ন হয় নাই (দৈনিক যুগান্তর ১৩.৩.২০২১)।

২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগে দুই দেশের পানিসম্পদ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়ে দুপক্ষ একমত পোষণ করে এবং মনমোহন সিংয়ের সফরেই চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার বিরোধিতায় সেটি আটকে যায়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বলেছেন, ‘তিস্তা চুক্তি ১০ বছর আগে পাতায় পাতায় সই হয়েছে। ডকুমেন্টও উভয়পক্ষ। ভারত সরকার আমাদের বলেছে, আগে যে চুক্তি হয়েছে সেটা স্ট্যান্ডবাই। তারা এটা গ্রহণ করে এবং তার থেকে কোনো ব্যত্যয় হয়নি। কী কারণে যে বাস্তবায়ন হয় নাই, আমরা তো সেটা জানি’ (দৈনিক যুগান্তর ১৩.৩.২০২১)।

কথা হলো, কি কারণে দশ বছর আগে সই করা চুক্তি অদ্যাবধি বাস্তবায়িত হয়নি তা সরকারের জানা থাকলেও ভুক্তভোগীরা জানার জন্য বেশ কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তাহলে সেটা কি একটা ডামি ছিল? পরে কি আর সেটার অগ্রগতি হবে না? বাস্তবতা যুগ যুগ ধরে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই করার আশ্বাস দিয়ে সেটা সুকৌশলে হিমঘরে রাখা হয়েছে।

মানুষের দেহে প্রবল পানি নিয়ে তৃষ্ণা নিয়ে মনে কোন উৎসবে আনন্দ করার কোনো উপায় থাকে কি? তিস্তার একটি ন্যায্য পানিবণ্টন চুক্তির আশ্বাস আর কতযুগ হিমঘরে পড়ে থাকবে? তিস্তা চুক্তি পরে আর কবে কোন সময় হবে সেটার আশ্বাস শুনতে শুনতে মানুষ বড্ড ক্লান্ত। সেটা কবে কীভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে তা ভুক্তভোগীদের কাছে মোটেও বোধগম্য নয়!

ইতোপূর্বে কয়েকটি লেখায় উল্লেখ করেছি, চীনের সঙ্গে তিস্তা পুনর্জীবন ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত প্রকল্পের একটি সফল বাস্তবায়ন করতে গেলেও ভারতের বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন। তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়ের গভীর অনিচ্ছার মধ্যে পর্যবসিত তিস্তা ইস্যুটি বার বার বাদ দিয়ে কালক্ষেপণ করাটা বন্ধুত্বের অংশ হতে পারে না। এটাকে প্রতিপক্ষের বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত।

বাংলাদেশের মানুষ ভারতের প্রতি বহুবিধ বিষয়ে কৃতজ্ঞ যেটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ভারত সফরে হিন্দিতে ‘ম্যায় হামেশা আভারী হুঁ’ বলা বক্তৃতার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই কৃতজ্ঞতাপূর্ণ সময়ে যদি সেটা প্রতিপক্ষের অনুরূপ কৃতজ্ঞতার ছায়ায় আদায় করা না যায় তাহলে এখন ‘আমার অংশের তিস্তা দিয়ে নিজে কি করব’- তা নিয়ে নিজেদের ভাবতে হবে বৈ-কি?

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/জেআইএম