গণপরিবহন
যৌন হয়রানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ চাই
নারীর ক্ষমতায়ন, উন্নয়ন ও নগরায়নের কারণে সাম্প্রতিককালে নারীদের গণপরিবহন ব্যবহারের হার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে নারীরা কর্মক্ষেত্রে, স্কুলে, কলেজে, শিশুদের স্কুলে পাঠাতে ও আনতে, অসুস্থ হলে হাসপাতালে যেতে ও বিভিন্ন কারণে অন্যত্র যাতায়াত করতে গণপরিবহন ব্যবহার করে। কিন্তু গণপরিবহনে নারীদের নিরাপত্তা প্রায় নেই বললেই চলে। গণপরিবহনে নারীদের প্রতি যৌন হয়রানি ও সহিংসতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত জুনে প্রকাশিত বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট জনগোষ্ঠীর ৩৬ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত করে। তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই গণপরিবহন ব্যবহার করে। ওই জরিপে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, শতকরা ৯৪ শতাংশ নারী যাত্রী কোনো না কোনোভাবে গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হন।
গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হননি এমন একজন নারীকেও খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রকৃত অর্থে, দেশের গণপরিবহনে চলাচলকারী কতজন নারী যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিভিন্ন সময়ে যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় তা থেকে দেশের গণপরিবহনে নারীদের যৌন হয়রানির বিক্ষিপ্ত কিছু চিত্র পাওয়া যায়। গণপরিবহনে নারীদের শুধু যৌন হয়রানিই নয়; এমন ঘটনাও ঘটে যে গণপরিবহনে নারী যাত্রীকে ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা করে নির্জন স্থানে ফেলে যাওয়ার মতো সংবাদও আমরা জানি। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, বিভিন্ন গণপরিবহন যেমন- বাস, লঞ্চ, ট্রেন, অন্যান্য যানবাহন এবং টার্মিনালসহ গণপরিবহনে ৩৬ শতাংশ নারী নিয়মিত যৌন হয়রানির শিকার হন।
এছাড়াও ৮৭ শতাংশ নারী তাদের জীবনে অন্তত একবার যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে। আর ৬৬ শতাংশ নারী কয়েকবার এবং ৭ শতাংশ নারী বারবার যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের হয়রানির শিকার হন। তবে হয়রানির শিকার ৩৬ শতাংশ নারী প্রতিবাদ করেছেন বলে অনলাইনে পরিচালিত ওই জরিপে উঠে এসেছে। ইউএনডিপি বাংলাদেশ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) যৌথ উদ্যোগে ২৪টি জেলার ৫,১৮৭ জন নারীর অংশগ্রহণে বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে যেমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টেক্সট মেসেজ এবং ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে এই ফলাফল পাওয়া গেছে।
সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৩৬ শতাংশ নারী হয়রানির প্রতিবাদ করেছেন এবং ৩৪ শতাংশ নারী কিছুই করেননি। ৭ শতাংশ নারী তাদের পরিবারকে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করেছেন এবং মাত্র ৫ শতাংশ নারী এবিষয়ে তাদের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছিলেন। হয়রানির শিকার মাত্র ১ শতাংশ নারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা চেয়েছেন, ১ শতাংশ ৯৯৯ এ ফোন করেছেন এবং ১ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন ও সহযোগিতা চেয়েছেন।
সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, ৫৭ শতাংশ নারী গণপরিবহনকে সবচেয়ে অনিরাপদ বলে মনে করেন। অন্যদিকে ৪৪ শতাংশ নারী প্রকাশ্যে হয়রানির শিকার হয়েও কোনো সাহায্য পাননি। অন্য এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গণপরিবহনে যাতায়াতকারী ৬৩ শতাংশ নারী, যুবতী ও কিশোরী বিভিন্ন হয়রানির শিকার হন। তাদের মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক যারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন তারা পরে বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন।
যৌন হয়রানির ধরনের মধ্যে রয়েছে গণপরিবহনে ওঠা ও নামার সময় পরিবহন কর্মীদের অযাচিত স্পর্শ, বাসে আসন থাকা সত্ত্বেও নারী যাত্রীদের পাশে দাঁড়ানো, পুরুষ যাত্রী কর্তৃক অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ, ধাক্কাধাক্কি এবং অশালীন মন্তব্য করা। জরিপে অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ নারী ঝামেলা এড়াতে এসব ঘটনার কোনো প্রতিবাদ করেননি। যৌন নিপীড়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে যাত্রীর সংখ্যাই বেশি। গণপরিবহনের চালক ও চালকের সহকারীর হাতেও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন অনেকে। নিপীড়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা বেশি।
আঁচল ফাউন্ডেশন ৫ মার্চ, ২০২২-এ ‘তরুণীদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের মোট তরুণীর প্রায় ৬৬ শতাংশই যৌন হয়রানির শিকার হন। এছাড়াও ৪৫ শতাংশেরও বেশি তরুণী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হন। প্রায় ৮৪ শতাংশের বেশি তরুণী বাসে বা বাসস্ট্যান্ডে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন, যা গণপরিবহনে যৌন হয়রানির সর্বাধিক ব্যবহৃত রূপ। গণপরিবহনে হয়রানির শিকার হওয়া এসব নারীর ৬৫ শতাংশই বিভিন্ন কটূক্তির শিকার হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা গণপরিবহনে যৌন হয়রানির বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেন। এগুলো হলো সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়; নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাবের অভাব; নারীকে পণ্য ও ভোগের বস্তু হিসেবে বিবেচনা করা; পর্নোগ্রাফির অবাধ প্রবাহ; ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার; ভাল আচরণের অভাব; মাদকাসক্তি এবং সুশিক্ষার অভাব ইত্যাদি।
তারা গণপরিবহনে যৌন হয়রানির প্রতিকারে আইনের কঠোর প্রয়োগের পরামর্শ দেন। এছাড়াও সামাজিক আন্দোলন ও প্রতিরোধ জোরদার করা; যৌন হয়রানিকারীকে সামাজিকভাবে বয়কট এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান; মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট এবং উন্মুক্ত সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিশ্চিত করা; নারীদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব বিকাশের পরিবেশ তৈরি করা; বিনোদনমূলক এবং সাংস্কৃতিক অনুশীলন বৃদ্ধি; পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ; আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির সক্রিয় ভূমিকা পালন করা; যৌন হয়রানির মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করা; গণপরিহনে নারীদের সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা এবং তাদের নিজেদের নিরাপত্তার সক্ষমতার প্রশিক্ষণ প্রদান করা ইত্যাদি।
সর্বোপরি গণপরিবহনের মালিকদের সচেতন হওয়া এবং তাদের মালিকানাধীন কোনো গণপরিবহনকর্মী যাতে গণপরিবহনে নারীদের যৌন হয়রানিসহ অন্য কোনোভাবে হয়রানি না করে সে সম্পর্কে অবহিত করা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা। কোনো গণপরিবহনকর্মী এমন আচরণ করলে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি গণপরিবহনে নারীদের প্রতি যৌন হয়রানি বন্ধে বেশ কিছু সুপারিশমালা তুলে ধরে। সুপারিশগুলো হলো- গণপরিবহনে সিসি ক্যামেরা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা। চালক, হেলপার ও সুপারভাইজারের আলাদা আলাদা নেম প্লেটসহ পোশাক বাধ্যতামূলক করা। চালক, হেলপার ও সুপারভাইজারের নিয়োগপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি নিয়ে ডাটাবেজ তৈরি করা।
গাড়ির ভিতরে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের হটলাইন নম্বর, ফোন নম্বর ও গাড়ির নম্বর লাগানোর ব্যবস্থা করা। গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানো। বাস, মিনিবাসে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন দরজার পাশে রাখা। গণপরিবহনে অস্বচ্ছ ও বিজ্ঞাপনে মোড়ানো কাচের ব্যবহার বন্ধ করা। গণপরিবহনে যৌন হয়রানির মামলা, গ্রেফতার ও বিচার দ্রুত শেষ করা ইত্যাদি। গণপরিবহনে নারীর প্রতি যৌন হয়রানিরোধে এসব সুপারিশমালা যুক্তিসঙ্গত বলেই প্রতীয়মান হয়। এজন্য সরকার তথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেখানে ঘর ও কর্মস্থলের বাইরে গণপরিবহনে নারীদের নিরাপদ থাকার কথা, সেখানে গণপরিবহনে নারীদের যৌন হয়রানির ঘটনা দিন দিন বাড়লে নারীর নিরাপত্তা সম্পূর্ণভাবে হুমকির মুখে পড়বে, যা একটি দেশের সুশাসনের মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সুতরাং গণপরিবহনে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি বন্ধে ও নির্যাতনের এ ধরনের বিপজ্জনক পরিসংখ্যানকে কমিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
এইচআর/ফারুক/এমএস