ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

মূর্তি ভাঙার পাগলদের থেকে সাবধান!

মোস্তফা হোসেইন | প্রকাশিত: ০৯:২১ এএম, ৩১ আগস্ট ২০২২

গত বছর কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে মূর্তির পায়ের নিচে কোরআন শরিফ রেখেছিল ইকবাল নামে মুসলমান এক যুবক। অপকর্মের নায়ক চিহ্নিত হওয়ার আগেই প্রচণ্ড উত্তেজনা তৈরি হয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে। মুসলমানের ধর্মগ্রন্থ মন্দিরে রেখে পূজায় বিঘ্ন ঘটালেও টার্গেট হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই। এর সূত্র ধরে ৫-৬ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে কয়েকদিনের মধ্যে।

শত শত মূর্তি ভাঙচুর হয় সারাদেশে। আক্রান্ত হয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর। এক পাগলের কাণ্ড বলে কুমিল্লার ঘটনা চাপা পড়ে যাওয়া কিংবা চাপা দেওয়ার চেষ্টা হলেও বাকি ঘটনাগুলোর একটারও বিচার হয়নি। বাকি ঘটনাগুলো যে কোনো পাগলের ঘটনা ছিল না তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই। আর এই অপাগলরা যে হরহামেশাই এমন ঘটনা ঘটাতে পারে সেই সন্দেহটাও হালকা নয়।

এবার দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানের এখনও ঢের বাকি। কিন্তু আলামত খুব একটা সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। ইতোমধ্যে মানিকগঞ্জে মূর্তি ভাঙচুর হয়েছে। গত শুক্রবার হরিরামপুর উপজেলার বাল্লা ইউনিয়নের ভাদিয়াখোলা বাজারের মন্দিরের প্রতিমা ভাঙে দুবৃত্তরা। তার মাত্র মাসখানেক আগে সিংগাইরের সিদ্ধাবাড়ি গ্রামের একটি কালীমন্দিরে মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

কুমিল্লায় দুর্গাপূজার সময় মন্দিরে কোরআন শরিফ রেখেছিল যে তরুণ তাকে মানসিক রোগী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। কাকতালীয় মনে হলেও মানিকগঞ্জের সিদ্ধাবাড়ির কালীমন্দিরের মূর্তি ধ্বংসকারী শামীম হোসেনকেও মানসিক রোগী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অন্যদিকে ভাদিয়াখোলা মন্দিরের ভাঙচুর কোনো মানসিক রোগীর কি না সেই হদিস পাওয়া যায়নি।

মূর্তি ভাঙচুরের এমন ঘটনা প্রায় পুরো দেশেই ঘটছে। আর এটা যে শুধু সাম্প্রতিক বিষয় তাও নয়। যে কারণে প্রশ্ন আসতেই পারে, আসলে প্রশাসন কি ভূমিকা পালন করছে। তারা ধর্ম বিশ্বাস নির্বিশিষে সব নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত। একই ঘটনা বারবার ঘটার পর তা প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না কেন? প্রশ্ন আরও আছে। মূর্তি ভাঙার বিষয়টি জানতে পুরোনো পত্রিকা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দেখা গেলো শুধু মানিকগঞ্জেই এমন ঘটনা প্রতি বছর ঘটছে।

সুতরাং দুর্বৃত্তরা প্রশাসনকে জানিয়েই দিয়েছে যে, তারা সুযোগ পেলেই মূর্তি ভাঙবে। উদাহরণ হিসেবে মানিকগঞ্জের কথাই ধরা যায়। এই মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার সিংজুরি গ্রামের সর্বজনীন কালীবাড়ি মন্দিরে মূর্তি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে ২০১৫ সালে। রাইজিং বিডি এতদসংক্রান্ত সংবাদ করে ২২ মে। এ ঘটনার সূত্রে স্থানীয় আক্কাস ও তার ছেলেকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। সর্বশেষ জানা গেছে অভিযুক্ত আক্কাস আলী ও তার ছেলে এখন মুক্ত। মামলাটিও এখন আর নেই।

রহস্যজনক মনে হতে পারে মানিকগঞ্জ জেলায় সিরিজ ভাঙচুরের ঘটনায়। ২০১৫ সালে হয়েছে সিংজুরিতে ভাঙচুর, ২০১৬ সালে সাটুরিয়ার পাইকপাড়া গ্রামে। হৃদয় নামের এক যুবককে হাতেনাতে ধরে পুলিশে দেওয়া হয়েছিল তখন। বলা হয়েছিল হৃদয় মানসিক রোগী। সেই হৃদয় কি এখনও অসুস্থ কিংবা তার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা আর সংবাদ হয়নি।

২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর, সিংগাইর উপজেলার বাঙ্গালা গ্রামে দুটি মন্দিরে হামলা করে ১৫টি মূর্তি ভাঙচুর করেছিল দুর্বৃত্তরা। এবছর ১৭ জুলাই প্রকাশিত সংবাদে জানা যায় সিংগাইর উপজেলার সিদ্ধাবাড়ি কালীমন্দিরে ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তর। শামীম হোসেন নামে এক যুবককে ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয়। এই শামীমও মানসিক রোগী হিসেবে বলা হয়। সর্বশেষ ২৭ আগস্ট সংবাদ হয়েছে হরিরামপুর উপজেলার বাল্লা ইউনিয়নের ভাদিয়াখোলা বাজারের মন্দিরে।

মানিকগঞ্জের মূর্তি ভাঙার এই তথ্যগুলো তাৎক্ষণিক পাওয়া গেছে। হয়তো আরও থাকতে পারে। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী মানিকগঞ্জের প্রায় প্রতিটি উপজেলায়ই এবং প্রতি বছরই এভাবে মূর্তি ভাঙা হয়ে আসছে। আর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা বিধানে যে প্রশাসন ব্যর্থ তাও স্পষ্ট। একইসঙ্গে দেখা যাচ্ছে, একাধিক স্থানে মূর্তি ভেঙেছে কথিত মানসিক রোগীরা। প্রশ্ন আসতেই পারে পাগলরা কি মূর্তিই ভাঙে নাকি মূর্তি ভাঙার জন্যই তারা পাগল হয়। আর মূর্তি ভাঙার পাগলদের নিয়ন্ত্রণের জন্য কারও দায়-দায়িত্ব আছে কি না।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে হামলা, মূর্তি ভাঙচুর এবং তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় মামলা হয়। আসামি গ্রেফতার হওয়ার সংবাদও পাওয়া যায়। কিন্তু সংবাদ হয় না অপরাধীদের শাস্তি হওয়ার বিষয়টি। আদৌ কি বিচার হয় অপরাধীদের? না হলে কেন হয় না। বলা হতে পারে, মামলা খারিজ হওয়ার কথা, চলমান থাকার কথাও আসতে পারে। যেহেতু মন্দিরের আগুন নিভে যাওয়ার মতোই ঘটনাগুলোও নিভে যায়, তাই মূর্তি ভাঙার পাগলও বাড়তে থাকে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিভে যাওয়ার নয়।

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্বাধীনতা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। প্রশাসন তাদের সেই স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে দায়বদ্ধ। সঙ্গত কারণেই আমাদের প্রশ্ন আসে, কুমিল্লায় মন্দিরে কোরআন রাখাকে কেন্দ্র করে যে শ’খানেক মামলা হয়েছিল সেগুলোর খবর কি?

ধরা যাক ইকবাল হোসেন পাগল ছিল আর সে পাগলামি করার জন্য মূর্তির পায়ে কোরআন রাখাটাকেই উত্তম মনে করেছিল।কিন্তু হাজীগঞ্জে যে সংঘবদ্ধ হামলার ঘটনা ঘটলো, সেখানে প্রাণহানি ঘটলো। সেই সূত্রে যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মূর্তি ভাঙচুর হলো, হিন্দু বাড়িতে হামলা হলো সেগুলো নিশ্চয়ই পাগলেরা করেনি। ওই দুবৃত্তদের কি বিচার হয়েছে?

এমন অনেক প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখেই আবার আসছে দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে যে পাগলের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে, তা বোঝা যায় পরপর দুই মাসে মানিকগঞ্জে দুটি ভাঙচুরের ঘটনা দেখে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা প্রশাসন কী ব্যবস্থা গ্রহণ করছে কিংবা করবে, তা বোধকরি প্রকাশ হওয়া প্রয়োজন। অন্তত এই সংবাদগুলো প্রকাশ হলেও দুর্বৃত্তরা জানতে পারবে তাদের অপকর্ম রোধে প্রশাসন তৎপর। ইচ্ছা করলেই তারা ভাঙচুর করে পার পাবে না।

বাংলাদেশের নাগরিক তিনি যে ধর্মেই বিশ্বাস করুন না কেন, তার নিরাপত্তা বিধান রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ ধরনের কর্মকাণ্ড আমাদের দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার পাশাপাশি বহির্বিশ্বে অস্থিরতা তৈরিতেও সহায়ক।

সম্প্রতি নাটোরে ঘটে যাওয়া ঘটনার সূত্রে ভারতে শাসক দলের পক্ষ থেকে কলকাতায় স্মারকলিপি দেওয়ার কথা শুনেছি। এটা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য শুভ নয়। সুতরাং বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি রক্ষার প্রয়োজনে সর্বোপরি দেশের নাগরিকদের ইচ্ছা অনুযায়ী ধর্মকর্ম করার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা আর না ঘটে।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম