ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

রাজনীতি

অসহিষ্ণু হওয়ার প্রয়োজন নেই

বিভুরঞ্জন সরকার | প্রকাশিত: ০৯:৫১ এএম, ৩০ আগস্ট ২০২২

বিএনপি কি বড় কোনো ঘটনা ঘটানোর মহড়া দিতে শুরু করেছে? অথবা সরকার কি বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলনের হুমকিতে বিচলিত বোধ করছে? এই প্রশ্ন দুটি কদিন ধরে অনেকেই আমাকে করছেন। আমি দুটি প্রশ্নের উত্তরে একটু শব্দ বলি, তা হলো ‘না’। আমার বিবেচনায় বড় কিছু ঘটানোর ইচ্ছে বিএনপির মনে মনে থাকলেও সেটা করার জন্য যে ধরনের সাংগঠনিক শক্তি, জনসমর্থন ও আন্তর্জাতিক আনুকূল্য প্রয়োজন তা নেই।

আবার সরকারও বিএনপির হুমকিতে খুব বিচলিত বলেও আমার মনে হয় না। বিশেষ করে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা সামান্য হুমকি-ধমকিতে বিচলিত হওয়ার মানুষ নন। অনেক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা তার আছে। উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ গ্রহণে তিনি তার সক্ষমতার পরিচয় আগে একাধিক ঘটনায় তিনি দিয়েছেন। এখনো দিচ্ছেন।

তাহলে গত ২২ আগস্ট থেকে ২৮ আগস্ট পর্যন্ত বিএনপির ১৯টি কর্মসূচিতে হামলা ও বাধাদানের ঘটনা ঘটলো কেন? আমার বিবেচনায় এটা এক ধরনের সতর্কতা। বিএনপি যেভাবে সরকারকে ‘দুর্বল’ ভাবছে সরকার যে তা নয় এটা বোঝানো হচ্ছে। মাঠ খালি, বিএনপি একতরফা গোল দেবে, এমন ধারণা তাদের যেন না হয়, সেটা বোঝানোর জন্য সরকার ও সরকারি দলের উপস্থিতি জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তবে এটা ঠিক, রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি যতক্ষণ শান্তিপূর্ণ থাকবে ততক্ষণ হামলার ঘটনা না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। সব পক্ষকেই সহিষ্ণুতা দেখাতে হবে। মাথা গরমে ফল ভালো হয় না, সেটা সবাইকে বুঝতে হবে।

বিএনপি নেতারা অবশ্য সরকার পতনের ঘণ্টাধ্বনি বহুদিন থেকেই শুনছেন। আবার সরকারি দলের নেতারা বিএনপির আন্দোলনের কথা শুনে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে বলেন, অমন আন্দোলনের কথা তো সেই কত বছর ধরেই শুনছি।

আগে বিএনপি আন্দোলন জমাতে পারেনি বলে, এখন বা অদূর ভবিষ্যতেও জমাতে পারবে না, সেটা জোর দিয়ে বলা যায় না। একটা কথা ঠিক যে, দিন তারিখ ঠিক করে কোনো গণআন্দোলন হয় না। কোন ঘটনায় মানুষ পথে নামবে বা কি ঘটলে মানুষের ক্ষোভ প্রশমন করা সহজ হবে না, তা আগে থেকে বলা যায় না।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে টানা তিন মেয়াদে। এই সময়জুড়েই বিএনপি সরকার হটানোর আন্দোলনের কথা বলে আসছে। এর মধ্যে দুই দফায় বেশ বড় গোলযোগ তৈরির চেষ্টা করে, বোমাবাজি, আগুন সন্ত্রাস করেও সরকারের ভিত দুর্বল করতে পারেনি। উল্টো তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। মানুষ এখন আর তাই আন্দোলনের কথা শুনলে খুব উৎসাহবোধ করে না।

আগে আমাদের দেশে একাধিক গণআন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান ও বাংলাদেশ আমলে এরশাদ- এই দুই সামরিক স্বৈরশাসকের পতন হয়েছে গণ-আন্দোলনের কারণেই। কিন্তু দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর অবশ্য কোনো নির্বাচিত সরকারকেই মেয়াদকাল পূর্ণ হওয়ার আগে আন্দোলনের মাধ্যমে পতন ঘটানো যায়নি।

আওয়ামী লীগ খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদকালে আন্দোলন করে হটাতে পারেনি। বিএনপিও পারছে না শেখ হাসিনাকে হটাতে। মানুষ এখন আর আন্দোলন করে সরকারকে গদিচ্যুত করতে উৎসাহ পায় না। কারণ সরকার বদল হলে যারা ক্ষমতায় যায় তাদের কারও কারও ভাগ্যের ব্যাপক পরিবর্তন হলেও সাধারণ মানুষের লাভ তেমন কিছু হয় না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য প্রায়ই বলেন যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশের সাধারণ মানুষ কিছু না কিছু পায়। অন্যরা ক্ষমতায় গেলে নিজেরাই সব চেটেপুটে খায়। কথাটি শতভাগ সত্য হলে ভালো হতো। কিন্তু তা তো নয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দলের মোটা আলীরা যা পায় সে তুলনায় জনতা অর্থাৎ চিকন আলীদের পাওয়ার পরিমাণ একেবারেই সামান্য। তবুও বিএনপি বা অন্য দলের চেয়ে আওয়ামী লীগের গণমুখী রাজনীতির যে বৈশিষ্ট্য ছিল, এখন তারও পরিবর্তন এসেছে।

তৃণমূলের মানুষদের আওয়ামী লীগের কাছে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে ব্যবধান বাড়ছে। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা, এমপি, মন্ত্রীর দুর্নীতির কথা অনেক মানুষের মধ্যে মুখে মুখে ফিরলেও তারা এসব শোনেন না। নীতিনির্ধারকরা মুখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বললেও বাস্তবে দু্র্নীতিবাজদের প্রশ্রয়ের নীতি নিতেই দেখা যায়।

এর মধ্যে দেশে জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় শুরু হয়েছে লোডশেডিং। বিএনপি নেতারা পেয়ে গেছেন সরকারের বিরুদ্ধে বলার মওকা। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে গত শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের পতন ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে, এখন বিদ্যুৎ, এরপর জ্বালানি তেল, এরপর দেখবেন খাজাঞ্চিখানা শূন্য হচ্ছে, রিজার্ভ শেষ হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী হয়ে উঠছে।’

শ্রীলঙ্কার অভূতপূর্ব জনজাগরণ, প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ দখল, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার পলায়ন, নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের খবরে আমাদের দেশের সরকারবিরোধী মহলগুলোর জিভে জল এসেছে। বিএনপিসহ আওয়ামী লীগবিরোধী সবাই এখন দিন গুনছে, বাংলাদেশ কবে শ্রীলঙ্কা হচ্ছে? বিএনপির এক পাতিনেতা তো ২৭ জুলাই বলেছেন, এক মাসের মধ্যে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি বাংলাদেশেরও হবে।

আমাদের দেশের দু-একটি গণমাধ্যমও জ্বালানি মজুত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে এমন সব রিপোর্ট ছাপছে যেগুলো পড়ে মানুষ বিভ্রান্ত হওয়া ছাড়া কিছুই হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, রিজার্ভ কমে নাকি ৩১ বিলিয়ন ডলারে এসেছে। যদি তাই হয় তাহলে কি আমাদের হাহাকার করতে হবে? বিএনপি যখন ক্ষমতা ছেড়েছিল, তখন যে রিজার্ভ ছিল মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলার, তখন কি বাংলাদেশ অচল হয়ে গিয়েছিল?

জ্বালানি তেলের সংকট কি শুধু বাংলাদেশে দেখা দিয়েছে, সেটা কি বিশ্বজোড়া সমস্যা নয়? সরকার লোডশেডিংসহ কিছু সংযমী পদক্ষেপ নেওয়ায় যারা হাহাকার করছেন, তারা আসলে কি চান?

যদি তর্কের খাতিরে এটা ধরেও নেই যে, দেশে সত্যি সত্যি একটা মারাত্মক সংকট আসছে, তাহলে তার সমাধান কি সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটানো? শেখ হাসিনাকে হটিয়ে কাকে ক্ষমতায় বসালে জ্বালানি সংকট, ডলার সংকটসহ আরও যেসব সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেসব দূর হবে? কোন দল বা নেতা-নেত্রীর হাতে সব সংকট মোচনের জাদুর কাঠি আছে? সংকট মোকাবিলায় শেখ হাসিনার চেয়ে বেশি সক্ষমতা দেখাতে পারবেন বলে মনে করা হচ্ছে? বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকতে দেশে কি দুর্নীতিমুক্ত সুশাসনের নজির স্থাপিত হয়েছিল?

গরম কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় ঝাঁপিয়ে পড়ার দুর্বুদ্ধি যারা দেন, তাদের সম্পর্কে সতর্ক থাকার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের ওপরও অবশ্যই চাপ রাখতে হবে, যাতে সরকার ভয়াবহ সংকটকালেও কোনো ধরনের খামখেয়ালি করতে না পারে। আন্দোলনের নামে উচ্ছৃঙ্খলতা নয়, শান্তি বজায় রেখে সরকারের অপচয়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে হবে। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা যে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের মতো আইন বা শাসন চালু করার বেপরোয়া মনোভাব দেখাতে চান, তাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের কালজয়ী সিনেমা ‘হীরক রাজার দেশে’র একটি জনপ্রিয় সংলাপ কোট করে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সবাইকে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান।’

শেখ হাসিনাকে কেউ হীরক রাজার সঙ্গে তুলনা করতেই পারেন। দেশে গণতন্ত্র নেই, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই– বলার পর যখন শেখ হাসিনাকে হীরক রাজার সঙ্গে তুলনা করা হয়, তখন তাকে মাত্রাছাড়া বলেই মনে হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যদি কিছুটাও এগিয়ে থাকে, তাহলে সেটা স্বীকার করেই তার ব্যর্থতা ও অসফলতার কথা বললেই সেটা মানানসই হয়।

মির্জা ফখরুল ইসলামের ‘দড়ি ধরে টান মারার’ আহ্বানে তার দলের সব নেতাকর্মী কি উৎসাহিত হয়ে কোমর বেঁধে রাস্তায় নেমেছেন? কোনো একটি সমাবেশে কিছু বেশি উপস্থিতি দেখেই যদি মনে করা হয় ‘কেল্লা ফতে' তাহলে সেই নেতার রাজনৈতিক আন্দোলনের জ্ঞানের ঘাটতির প্রমাণ পাওয়া যায়। বিএনপিকে মানুষের মনোভাব যেমন বুঝতে হবে, তেমনি নিজের দলের শক্তি-দুর্বলতার কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, বিএনপি নেতাদের একাংশ সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। নিজের ঘর অরক্ষিত রেখে অন্যের ঘর ভাঙার ভাবনা ভালো নয়। বিশ্ব পরিস্থিতি এখন অনেকটাই টালমাটাল। কোথায় গিয়ে পরিস্থিতি দাঁড়ায় তা না বুঝে হঠকারিতা করা বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করবে না। এখন অসহিষ্ণু না হয়ে সহিষ্ণুতার চর্চা করাই উচিত।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম