ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

‘গরিবের বউ’ এবং ডিমকাণ্ড

লীনা পারভীন | প্রকাশিত: ১০:৫১ এএম, ২৫ আগস্ট ২০২২

বাংলায় একটা স্থানীয় প্রবাদ আছে ‘গরিবের বউ, সবার ভাবি’। এই কথা কবে কে প্রচলন করেছে জানি না; তবে এর অর্থ দাঁড়ায় গরিবের বউয়ের নিজস্ব কোনো পছন্দ বা মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকে না। সে যেন সবার কাছেই অ্যাভেইলেবল। নিজের শক্ত অবস্থান ধরে রাখার সুযোগ নাই কারণ সে গরিব। সমাজে তার আর্থিক ক্ষমতা নেই। তাই চাইলেও প্রতিবাদের ভাষায় কথা বলতে পারে না।

আমাদের বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা এখন সেই গরিবের বউয়ের মতো। যে যখন যেভাবে পারছে শোষণ করছে। বাংলাদেশ উন্নত দেশের পথে হাঁটছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের আলাপ এখন আমাদের জন্য পুরোনো। নতুন করে বলার কিছু নেই কারণ এটাই সত্য যে আমাদের আর্থিক উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু সেই উন্নয়নের সুফল বা আর্থিক উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজে যে এক ধরনের ভারসাম্য বজায় রাখতে হয় সেই কাজটি যেন করার মতো কেউ নেই। রাজনীতিবিদরা ভাবছেন কেমন করে ক্ষমতার কাঠামো ব্যবহার করে দ্রুত নিজের আখের গোছানো যায়। ব্যবসায়ীরা ভাবছেন কত সহজে জনগণকে জিম্মি করে নিজেদের পকেট ভারী করা যায়। সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে গোটা বাজারব্যবস্থা।

সর্বশেষ সিন্ডিকেশনের খেলা দেখলাম আমরা ডিমকে কেন্দ্র করে। প্রায় অর্ধশত বছরের কাছাকাছি এসে আমাকে বলতে হচ্ছে যে ডিমের দাম কমাও। এটা আমার ক্রয়ক্ষমতাকে প্রভাবিত করছে। আমরা সবাই জানি ডিম হচ্ছে আমাদের একদম মৌলিক প্রোটিন পূরণের একটি সহজলভ্য উৎস। এই ডিমের কারণেই সাধারণ মানুষের ঘরে সুষম খাদ্যের ঘাটতি কিছুটা হলেও কমে আসে।

কিন্তু গত দুই সপ্তাহে ডিম, মুরগি ও মুরগির বাচ্চা কেনা-বেঁচায় একটি চক্র বাজার থেকে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ৫১৮ কোটি টাকা। এই টাকা কাদের? কার পকেট কাটা গেলো? প্রতিটা টাকা আমার আপনার মতো সাধারণ মানুষের হিসাবের টাকা। সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে একটি চক্র কোনোরকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কেবল মোবাইল ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমেই ডিমের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল। অথচ এই টাকায় অংশ নেই প্রান্তিক খামারিদের।

অর্থাৎ যারা মুরগির খামার করছে তারা এই সুফল পায়নি। এই খামারিরা কিন্তু অনেক ধরনের প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েই এই ব্যবসা করে যাচ্ছে। তাদের টেম্পারেচার কন্ট্রোলের কোনো আধুনিক ব্যবস্থা নেই এমন অনেক কাঠামোগত সমস্যা আছে খামারিদের। কিন্তু দাম এরা বাড়ায়নি। দুটি সপ্তাহ বাজার কেঁপে গেলো ডিমের দাম বাড়তি হওয়ার কারণে। প্রথমদিকে তো জানাই যায়নি ডিমের দাম কারা বাড়িয়েছে। এক সপ্তাহ পর যখন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর মাঠে নামলো তখন জানা গেলো ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণ করে মধ্যস্বত্বভোগীরা, খামারিরা নয়। মানে হচ্ছে শহরের গুটিকয়েক ব্যবসায়ী নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ করে ডিমের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।

জানা গেছে, এই সুযোগে, অর্গানিক ডিমের সিল লাগিয়েও বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি মহল। বাজারের ওপর বাস্তবে কোনো কর্তৃপক্ষেরই কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। না বাণিজ্য মন্ত্রণালয় না সিটি করপোরেশন পারছে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে। সরকার একটা দাম নির্ধারণ করে দেয় অথচ ব্যবসায়ীরা বিক্রি করে নিজেদের মতো করে। দিনশেষে ভোগান্তিতে পড়ছি আমরা সাধারণ মানুষেরা। যে যেভাবে পারছে আমাদের পকেট কেটে নিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের উসিলায় এখন সবকিছু হালাল করতে চাচ্ছে একটি মহল।

এই যে সর্বশেষ ডিমের দাম বাড়িয়ে ৫১৮ কোটি টাকা আমার আপনার পকেট থেকে নিয়ে নিলো এর বিহিত কি হবে? এফবিসিসিআই হচ্ছে ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। তাদের কাজই হচ্ছে ব্যবসার নীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং চাইলে আইনি ব্যবস্থাও নিতে পারে। অথচ আমরা দেখলাম এই সংস্থাটি এর দায় নিতে অস্বীকার করলো। তাহলে দায়টা কে নেবে? এফবিসিসিআইয়ের তাহলে ভূমিকা কী দেশের ব্যবসা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে? আমরা জনগণ কেবল বলতে পারি কিন্তু জবাবদিহিতার দায় যখন কারোই থাকে না তখন দেশে হরিলুট চলতে থাকে।

আমাদের দেশের নিয়ম হচ্ছে একবার কোনো পণ্যের দাম বাড়লে সেখান থেকে আর আগের দামে ফিরে আসে না। ভোজ্যতেলের দাম সেই যে বাড়লো আর আগের জায়গায় ফিরে আসলো না। তার মানে হচ্ছে বাড়তি টাকা কার পকেটে যাচ্ছে সেই হিসাবটাও কেউ রাখার নেই। ডিমকাণ্ডের পরে জানা গেলো ব্যবসায়ীদের পরিবহন খরচ যা বেড়েছে সেই হিসাব করলে ডিমপ্রতি হয়তো দাম বাড়তে পারতো ২ থেকে ৩ পয়সা।

হ্যাঁ, একদম ঠিক লিখেছি। ২ থেকে ৩ পয়সার জায়গায় ডিম সমিতি বাড়িয়েছে ডিমপ্রতি ২ টাকা ৭০ পয়সা। ফলে ডিমের হালি বাড়তে বাড়তে ৬০ টাকা হয়ে গেলো আর ডজন গিয়ে দাঁড়ালো ১৫০-১৬০ টাকা। আমি নিশ্চিত এই হিসাব অন্যসব পণ্যের বেলায়ও সত্য। পরিবহন খরচের দোহাই দিয়ে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব সবজির দাম বাড়ানো হয়েছে। সামান্য কাচামরিচের কেজি হয়েছিল ৩০০ টাকা।

বলতে ইচ্ছে করে, লে হালুয়া। চেটেপুটে খা বাবারা। যে যেভাবে পারছে আমাদের পকেট কেটে নিয়ে চলে যাচ্ছে। আমরা জনগণ হচ্ছি ‘পাবলিক’। যে পারছে আসতেও কাটছে আবার যেতেও কাটছে। আর আমরা রক্তাক্ত শরীর নিয়ে কেবল ‘কুঁই’ ‘কুঁই’ করছি। সেই শব্দ আদৌ কারও কানে পৌঁছায় বলে মনে হচ্ছে না।

লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম