মন্ত্রীর নামে মুক্তহস্তে ক্যাশ প্রদান করেন ...
এই প্রথম আমাদের জেলায় কেউ মন্ত্রী হলেন। প্রথম পাওয়া, প্রথম হওয়া- এজাতীয় বিষয় নিয়ে মানুষের অন্যরকম আবেগ থাকে। আমরা আবেগে ফুটতে লাগলাম। কিছুক্ষণ আগে মন্ত্রী বাহাদুর দেশ, জাতি ও পবিত্র সংবিধানের নামে শপথ গ্রহণের কাজ সম্পন্ন করেছেন। গভীর আগ্রহ নিয়ে টেলিভিশনের পর্দায় আমরা সে দৃশ্য দেখেছি।
কোনো দৈব-দুর্বিপাকের চক্করে না পড়লে তার মন্ত্রিত্ব পদ খারিজ হওয়ার আশংকা নেই। মন শংকামুক্ত থাকলে সেখানে আনন্দ-উল্লাসের ঢেউ প্রবল হয়। অত্যধিক আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে গরমাগরম বুক মেলানোর জন্য আমরা কয়েকজন গতকালই ঢাকায় চলে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলাম। দলপতি রাজি হয়নি। আমাদের দলপতির নাম বাক্কাস। সে আমাদের বলেছে-
: আমরার লিডার মন্ত্রী হইতেছে- এই খুশিতে ডগমগ হইয়া আমরা ডিগবাজি খাইবাম ঠিকই, তবে আসল কাম কিন্তু এইটা না!
দলে লিয়াকত নামে একটা ছেলে আছে। সে অবাক হয়ে বলল-
: আর কী করবাম!
: করবাম নারে পাগলা, ধরবাম।
: কী ধরবাম, কারে ধরবাম?
: শপথ গ্রহণ শেষ হোক। তারপর জানতে পারবি।
মন্ত্রীর শপথ গ্রহণ শেষ হওয়ার পরপরই লিয়াকত বাক্কাসকে স্মরণ করিয়ে দিল-
: বাক্কু ভাই, গতকাইল ধরাধরির ব্যাপারে হালকা আওয়াজ দিছিলা। শপথ গ্রহণের কাম তো শেষ হইল। এইবার কও...
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বাক্কাস বলল-
: মুখে আর কয়জনের নাম কইবাম! এই নে লিস্ট...
বাক্কাস পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে আমাদের সামনে রাখল। সেখানে কয়েকশ মানুষের নাম লেখা। লিস্ট দেখে লিয়াকতের মুখ হা হয়ে গেল। ঢোক গিলে সে বলল-
: এতগুলা লোকেরে ধরন লাগব!
বাক্কাস লিয়াকতের পিঠ চাপড়ে বলল-
: ডরাইস না! নামগুলা বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ কইরা দিছি। একটা কমিটি গঠন কইরা সেই কমিটির আন্ডারে কয়েকটা দলে ভাগ হইয়া অ্যাকশনে নাইম্যা পড়। লিয়াকতের হাত থেকে লিস্ট নিয়ে দেখলাম- প্রথমেই রয়েছে ‘জি’ ক্যাটাগরির তালিকা। বাক্কাসের কাছে জানতে চাইলাম-
: ‘জি’ মানে কী?
: ‘জি’ মানে গেইট। এই ক্যাটাগরিতে যাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করছি- তারা গেইট নির্মাণের খরচ বহন করব।
এরপর আছে ‘এস’ ক্যাটাগরি। জিজ্ঞেস করলাম-
: ‘এস’ দিয়া কী বুঝাইতে চাইছস?
: ‘এস’ মানে সংবর্ধনা। মন্ত্রীরে সংবর্ধনা জানানোর খরচাপাতি এরার কাছ থেইক্যা আদায় করবাম।
‘এস’ এর পরে ‘এ’ ক্যাটাগরি। আমার প্রশ্নের উত্তরে বাক্কাস জানাল-
: ‘এ’ মানে আপ্যায়ন।
: অঃ। আমি আরও ভাবছিলাম, ‘এ’ মানে আপেল। মন্ত্রীরে আপেল খাওয়াইবার দায়িত্ব পড়ছে এই ক্যাটাগরির লোকদের ওপর!
: কস কী! শুধু আপেল খাওয়াইলেই চলব? খাইতে খাইতে মন্ত্রীসাবের ভুঁড়ি যদি দশ ইঞ্চি ঝুইল্যাই না পড়ল- তাইলে আপ্যায়ন কইরা লাভ কী? বুঝছস, দুনিয়ার সেরা খাদ্য-খাবার উনার সামনে হাজির করা লাগবে।
: তাইলে একটা কাম করি?
: কী কাম?
: সুন্দরবন থেইক্যা একটা হরিণ আনার ব্যবস্থা করি। হরিণের আস্ত রোস্ট মন্ত্রীর পাতে তুইল্যা দিবাম।
প্রস্তাব শুনে বাক্কাস কিছুক্ষণ মাথা ঝাঁকাল। তারপর শিস বাজাতে বাজাতে বলল-
: কথাটা খারাপ কস নাই। গুড আইডিয়া। দেখি, কী করা যায়!
সবশেষে ‘ইউ’ ক্যাটাগরি। ছোটবেলায় বর্ণপরিচয়ের বইয়ে পড়েছি- ‘ইউ’ ফর আমব্রেলা। হায় আল্লাহ! এতগুলো লোকেরে মন্ত্রীর মাথার উপরে ছাতা ধরার দায়িত্ব দেওয়া হবে! কথাটা বাক্কাসকে বলতেই সে হাঃ হাঃ শব্দে হেসে উঠল। হাসি থামার পর বলল-
: আরে পাগলা, কেউ মন্ত্রী হওয়ার পর তার মাথায় ছাতা ধরনের লাইগা লিস্ট কইরা লোক তালাশের প্রয়োজন পড়ে না। মন্ত্রীর মাথায় ছাতা ধরনের জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বগলে ছাতা লইয়া অপেক্ষা করতে থাকে। ‘ইউ’ মানে হইল উপহার। মন্ত্রীরে উপহার দেওন লাগব না? এই ক্যাটাগরির লোকেরা উপহার কেনার পয়সাকড়ি জোগান দিবে।
বাক্কাসের কথা শেষ হতেই আমি বললাম-
: এই যে এত লোকের কাছ থেইক্যা আমরা টাকা-পয়সা আনবাম; সব কি খরচ কইরা শেষ করন যাইব?
বাক্কাস তেরছা চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল-
: মন্ত্রীসাবরে লইয়া উচ্ছ্বাস দেখাইতে গিয়া সব টাকা খরচ কইরা ফেলবাম- এই কথা তরে কে কইছে?
: তাইলে?
: অনুষ্ঠান বাবদ টাকা খরচ করবাম মাত্র টোয়েন্টি পার্সেন্ট। বাকি এইট্টি পার্সেন্ট টাকা আমরার। কথাটা খুব খেয়াল কইরা- এই মিয়া যতদিন মন্ত্রী থাকবেন, তারে সামনে রাইখ্যা আমরার এইট্টি-টোয়েন্টির কারবার চলতেই থাকব।
হিসাবটা বুঝতে পারলাম। বললাম-
: কারবারই যদি করবাম, তাইলে আরেকটু ডিপে নাইম্যা টাকা-পয়সার বিষয়টারে সর্বজনীন কইরা ফেলি!
: কী রকম?
: মন্ত্রীসাব তো লিস্টে থাকা মাত্র কয়জনের সম্পদ না। পুরা জেলার সম্পদ। জেলার এই কৃতী সন্তানরে সেলামি দিয়া ধন্য হওয়ার সুযোগ থেইক্যা জেলাবাসীরে কীজন্য বঞ্চিত করবাম?
: কী করবার চাস?
: বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে বড় বড় পিতলের ডেকচি বসাইয়া তার ওপর মন্ত্রীর একটা ছবি ফিট কইরা লেইখ্যা দিবাম- মন্ত্রীর নামে মুক্তহস্তে ক্যাশ প্রদান করেন।
কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থেকে বাক্কাস বলল-
: ডেকচি পাহারা দেওয়া আরেক ঝামেলা। তার চাইতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর জন্য আমার মোবাইল নম্বর উল্লেখ কইরা সেই নম্বরে টাকা জমা দেওয়ার জন্য পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন মাইরা দেই।
: চলে।
মন্ত্রীকে উপহার প্রদান ও তার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের হাজির হওয়া নিয়ে ইতঃপূর্বে অনেক সমালোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রশ্ন তুলতেই বাক্কাস রহস্যময় হাসি উপহার দিয়ে বলল-
: সোনালি অতীত-রূপালি ভবিষ্যৎ।
: মানে?
: সোনা লইয়া পাবলিক আবোল-তাবোল কথা কয়। সেইজন্য আমরা সোনারে অতীতের জাদুঘরে নিক্ষেপ কইরা রূপালি ভবিষ্যতের দিকে হাত বাড়াইবাম। মন্ত্রীরে সোনার তৈরি কোনো জিনিস উপহার দিবাম না; যা দিবাম সবই হইব রুপার তৈরি।
: অল্প দামের রুপায় মন্ত্রীর মন ভরবে?
: অসুবিধা কী? পরিমাণে বাড়াইয়া দিবাম।
: উপহার বিষয়ে নতুন একটা সিস্টেম চালু করলে কেমন হয়? এতে ব্যাপক রোজগার হবে।
: কী সিস্টেম?
: পীরসাহেবদের ওরস উপলক্ষে আশেকান-জাকেরানরা যেমন গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ইত্যাদি লইয়া দরবারে হাজির হয়, মন্ত্রীরে সামনে রাইখ্যা আমরা যদি এই নিয়ম চালু করি?
: মন্ত্রীরে হাঁস-মুরগির লেবেলে নামাইয়া আনাটা উচিত হইব না! গরু-ছাগল ঠিক আছে। কেউ চাইলে উটও দিবার পারে, সমস্যা নাই।
: কিন্তু সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের হাজির না করার ব্যাপারে যে সার্কুলার জারি হইছে, সেই সমস্যা কেমনে মিটবে?
: এই বিষয়ে টেনশন করার কিছু নাই। আমি একটা নতুন ফর্মুলা আবিষ্কার করছি।
: কী ফর্মুলা?
: সংবর্ধনায় আমরা স্কুলের কোমলমতি শিশুদের আনবাম না; আনবাম তাদের মা-খালাদের। বাচ্চাদের স্কুলের ভিতরে ঢুকাইয়া দেওয়ার পর মা-খালারা তো গল্প-গুজব কইরাই সময় পার করে। আমি অমুক বিদ্যালয়ের অমুক শিক্ষার্থীর আম্মা, আমি তমুক বিদ্যালয়ের তমুক শিক্ষার্থীর খালা- তাদের হাতে এই ধরনের স্টিকার ধরাইয়া দিবাম। তারা এই স্টিকার হাতে লইয়া রাস্তায় দাঁড়াইয়া থাকবে। এতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নামও ফাটব, আর মা-খালারাও একটু নড়াচড়া করার সুযোগ পাইব।
এ সময় দলের প্রবীণ সদস্য ইব্রাহিম হাত তুলে বলল-
: আমার একটা সাজেশন আছে।
বাক্কাস তার দিকে তাকিয়ে বলল-
: কী সাজেশন?
- কিছুদিন আগে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এক মন্ত্রীর বিড়ি খাওয়া লইয়া কথা উঠছিল। আমরার মন্ত্রী তো গপগপি পান খায়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তারে মুখে ঠোয়া লাগানোর ব্যবস্থা করন লাগব।
পান-সমস্যাকে বাক্কাস ততটা গুরুত্ব দিল না। বলল-
: পান করলে সমস্যা; তবে পান খাইলে কোনো সমস্যা নাই।
কয়েকদিনের মধ্যে সারা শহর পোস্টার, ফেস্টুন ও তোরণে ঝলমল করতে লাগল। একটা পোস্টারে দেখলাম- জনৈক মরহুমের পক্ষ থেকে মন্ত্রীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। সাধারণত মৃতব্যক্তির পক্ষ থেকে তার পরিবারের কেউ পাবলিক-আত্মীয়স্বজনের দোয়া কামনা করে। শুভেচ্ছা বিতরণ মৃতব্যক্তির কাজ নয়। শুভেচ্ছা পেয়ে মন্ত্রী খুশি হলেও কবরে তার কোনো প্রভাব পড়বে না। মন্ত্রীর খুশি-অখুশিতে কবরের ফেরেশতাদের কিছু যায় আসে না। এ ব্যাপারে বাক্কাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই সে বলল-
: কবরবাসী লাভবান না হইলেও তার স্ত্রী-পুত্র, ভাই-ভাতিজা, আত্মীয়স্বজনরা লাভবান অইব। মূলত এইজন্যই রাজনীতিতে মরহুমরা মরহুম হইয়াও বিশেষ গুরুত্ব পায়। আমরার মন্ত্রীর কথাই ধর। মরহুম হওয়ার পর মন্ত্রীর বংশধরেরা উনার একটা ছবি সামনে রাইখ্যা যুগের পর যুগ খাওয়ার কাম চালাইয়া যাইতে পারবে।
: লগে লগে আমরাও।
: ঠিক কইছস।
আজ দুপুরের পর মন্ত্রী শহরে প্রবেশ করবেন। আমরা প্রস্তুত। মন্ত্রী আসার পর তার গলায় ফুলের মালা ঝুলিয়ে দিয়ে বাক্কাস বলল-
: লিডার, আপনেরে খুব ফ্রেশ লাগতেছে!
মন্ত্রী হেসে উত্তর দিলেন-
: ফ্রেশ তো লাগবই। মন্ত্রী হওনের পর শরীরের মধ্যে আলাদা একটা জোশ আইছে না? তবে বাক্কাইচ্যা...
: কন!
: মনে কোনো সুখ পাইতেছি নারে!
: কীজন্য!
: বুড়াকালে মন্ত্রী হইলাম! বুড়াকালে বাপ হওয়ায় সুখ আছে; কিন্তু মন্ত্রী হইয়া সুখ নাই। এই বয়সে দুনিয়াদারির চিন্তা করবাম না আখেরাতের চিন্তা করবাম-বুঝবার পারতেছি না!
লেখক: সহকারী সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/এমএস