ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই মানসম্মত শিক্ষক

প্রফেসর ড. মোহা. হাছানাত আলী | প্রকাশিত: ১০:০১ এএম, ০৩ আগস্ট ২০২২

দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা এখনো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারেনি। তবে অনেকটা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তা আজও আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শহর থেকে গ্রামের শিক্ষার্থীরা অনেকটা পিছিয়ে পড়ছে। দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি শিক্ষিত মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু মেধাবী ও যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা কতটা বেড়েছে এটি বলা বেশ দুষ্কর।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে ছাত্রসংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার গুণগত মানের ব্যাপক অবনতি হয়েছে। এদিকে নতুন করে দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের মোট ২ হাজার ৭১৬ বেসরকারি নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার আগে কর্মরত শিক্ষকদের যোগ্যতা ও মেধা কীভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে বা আদৌ করা হয়েছে কি না সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। তাছাড়া দেশে এতো অধিক সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি না সেটাও আজ বড় প্রশ্ন। এসব প্রতিষ্ঠান মানসম্মত শিক্ষা প্রদানে কতটা ভূমিকা রাখছে তা সময়ই বলে দেবে।

স্বাধীন বাংলাদেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় হ-য-ব-র-ল অবস্থার কারণে অনেক মেধাহীন, ক্ষেত্রবিশেষে অযোগ্য ব্যক্তি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। বলতে দ্বিধা নেই একজন শিক্ষক যোগদান করার পর থেকে ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত তিনি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা প্রদান করেন। একজন মেধাহীন শিক্ষক কোনোভাবেই একটি মেধাবী জনগোষ্ঠী তৈরি করতে পারে না।

অন্যদিকে সরকারি পলিসির কারণে বহু বেসরকারি স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে এমন শিক্ষকও ছিলেন যারা ক্লাসরুমে মানসম্মত শিক্ষাপ্রদানে অক্ষম। অনেকের আবার মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের ন্যূনতম যোগ্যতা ও মেধা আছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। মূলত তাদের অনেকেই প্রতিযোগিতামূলক কোনো পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হননি। তাদের অনেকেই নিয়োগ পেয়েছিলেন ম্যানেজিং কমিটির অনুকম্পায়। এক্ষেত্রে অনৈতিক অর্থ লেনদেনের বিস্তর অভিযোগও সমাজে রয়েছে।

শিক্ষার গুণগত মানের নিম্নমুখীধারা দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা কিছুদিন আগেও গভর্নিং বডি বা ম্যানেজিং কমিটির ওপর ন্যস্ত ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় সংসদ সদস্য বা তাদের মনোনীত আত্মীয়স্বজনরাই ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় মনোনীত এমন ব্যক্তি শিক্ষার উন্নয়নে যতটা না আগ্রহী তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি আগ্রহী ছিলেন অনিয়ম, দুর্নীতি ও সীমাহীন স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ প্রদান করে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার প্রতি।

গত দুই দশকে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগের নামে অনেক ক্ষেত্রে মেধাহীন ও অযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। বিভাগের প্রথম স্থান অধিকারী শিক্ষার্থীর মেধাকে অবজ্ঞা করে অনিয়ম, দুর্নীতি ও দলীয় বিবেচনায় এমন ব্যক্তিকেও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে, যাদের শিক্ষক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতাই ছিল না।

সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটাপ্রথা বাতিলের দাবিতে দেশে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজপথে রক্ত ঝরেছে, মিছিল মিটিং হয়েছে, সভা সমাবেশ হয়েছে। কোটাবিরোধী আন্দোলন দেশে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। একপর্যায়ে সরকার কোটাপ্রথা বাতিল করেছিল। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাপ্রথা এখনও চালু রয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে বিদ্যমান নোরী কোটার কারণে অনেক মেধাবী এবং যোগ্যতাসম্পন্ন পুরুষ ব্যক্তি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন না, তুলনামূলকভাবে কম মেধাবী ও কম যোগ্যতাসম্পন্ন নারী প্রার্থী কোটার সুবিধা গ্রহণ করে সহজেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছেন।

এতে করে শিক্ষাক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে অচিরেই কোটাপ্রথা বাতিল করা জরুরি। লিঙ্গবৈষম্য নয় বরং যোগ্য লোক মেধার ভিত্তিতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ হোক সেটাই প্রত্যাশিত। অন্যথায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেধাহীন শিক্ষকে ভরে যাবে। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় আমূল পরিবর্তন আনা জরুরি। এখনও অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষসহ কিছু কিছু নিয়োগের ক্ষমতা ম্যানেজিং কমিটির হাতে ন্যস্ত রয়েছে।

নিয়োগে স্বচ্ছতা আনায়ন, দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধ এবং যোগ্য প্রতিষ্ঠান প্রধান/ শিক্ষক নিয়োগে ম্যানেজিং কমিটির সব নিয়োগ প্রদান সংক্রান্ত বিদ্যমান ক্ষমতা রহিতকরে পিএসসি’র আদলে বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগ কমিশন গঠন করে সব নিয়োগের দায়িত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত করা গেলে তা শিক্ষাক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে।

মনে রাখতে হবে যে, একমাত্র যোগ্য শিক্ষকই পারে মেধাসম্পন্ন একটি জাতি গঠন করতে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভোটার নয় বরং যোগ্য ও মেধাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগই পারে শিক্ষার ক্রমাবনতি রোধ করতে। শিক্ষক নিয়োগে নারী কোটাসহ সব প্রকার কোটা প্রথা বাতিল করে সম্পূর্ণ মেধারভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ করা না হলে শিক্ষার মানোন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভবপর হবে না।

কিছুদিন আগ পর্যন্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের সর্বময় ক্ষমতা গভর্নিং বডি/ ম্যানেজিং কমিটির ওপর ন্যস্ত ছিল। নিয়োগ প্রদানে তারাই ছিল সর্বেসর্বা। অথচ গভর্নিং বডি/ ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি এবং সদস্য হওয়ার জন্য ন্যূনতম কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতার বালাই ছিল না।

যদিও বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সভাপতির শিক্ষাগত যোগ্যতা ডিগ্রি পাস পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করি দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষিত, মার্জিত এবং শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি গভর্নিং বডির সদস্য হবেন। শিক্ষানুরাগী প্রতিটি মানুষ এটা প্রত্যাশা করে। গভর্নিং বডির সভাপতিসহ সব সদস্যের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা এখন সময়ের দাবি।

শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় গভর্নিং বডির সভাপতিসহ অন্যান্য সদস্য নিয়োগপ্রাপ্ত হলে তারা শিক্ষা উন্নয়নের চেয়ে নিয়োগ, শিক্ষক হয়রানি, প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ করার মতো অনৈতিক কাজে বেশি মনোযোগী হবেন। কিন্তু একজন শিক্ষিত মানুষ কোনোভাবেই শিক্ষা উন্নয়নের পরিবর্তে শুধু ব্যক্তিগত আখের গোছানোর জন্য তিনি কাজ করবেন না। এ বিষয়টি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা বোর্ডের কর্তাব্যক্তিরা সঠিকভাবে তদারকি করবেন বলে আশা করতে চাই। কোনোভাবেই সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, অর্থ আত্মসাৎকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যেন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে না আসতে পারেন তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে।

মনে রাখতে হবে একটি দেশের যদি সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায় কিন্তু যদি সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা মানসম্মত হয় তাহলে একদিন না একদিন সেই জাতি অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। কিন্তু যদি সব ঠিক থাকে আর শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে সে জাতি আর কখনোই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। এই চিরন্তন সত্য কথাটি মাথায় রেখে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগে মনোনিবেশ করতে হবে। মেধার সাথে কোনো আপস নয় বরং শিক্ষক নিয়োগে সর্বাবস্থায় মেধা ও যোগ্যতাকে গুরুত্ব দিতে হবে।

আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে দেশের অনেক মাদরাসায় প্রচুর ধন-সম্পদ রয়েছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের ধন সম্পদের সঠিক ব্যবহার বা তদারকি কোন কোন ক্ষেত্রে একেবারেই হচ্ছে না। গভর্নিং বডির সভাপতি বা ক্ষেত্রবিশেষে অসৎ ও দুর্নীতিপরায়ণ কিছু অধ্যক্ষ প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ করছেন, মাদরাসার সম্পদ নিজেদের স্বার্থের জন্য ব্যয় করছেন। এজন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার মাদরাসা, স্কুল, কলেজে যেসব সম্পদ দানশীল ব্যক্তিরা সওয়াবের আশায় দান করে গেছেন তার সঠিক এবং উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য গভর্নিং বডি এবং সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের আরও তৎপর হতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনিয়মের লাগাম টেনে ধরার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর রয়েছে। শিক্ষা কর্মকর্তা রয়েছে কিন্তু তাদের জনবল স্বল্পতা ও একশ্রেণির কর্মকর্তাদের দুর্নীতিপরায়ণ মনোভাবের কারণে সরকার তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ অর্জন করতে পারছে না।

দেরিতে হলেও সরকার স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে একটি অভিন্ন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। কারিকুলাম তৈরি করা হয়েছে, যা ২০২৩ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে কার্যকরী হবে। শিক্ষানীতি সুচারুরূপে বাস্তবায়ন করতে হলে সর্বাগ্রে মেধাবী শিক্ষকের প্রয়োজন। প্রয়োজন যোগ্য শিক্ষকের।

আগেই বলেছি দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মানের ক্রমাবনতি হয়েছে, যা দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগ, মেধার পরিবর্তে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগই এমন ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতির জন্য দায়ী।

এছাড়া শিক্ষা প্রশাসনের দুর্নীতি আজ অনেকটা ওপেন সিক্রেট। সম্প্রতি টিআইবি ‘মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা কার্যপরিচালনা করেছে। তাদের গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটিতে অশিক্ষিত মানুষ অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় শিক্ষকদের সঙ্গে কমিটির সমস্যা ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে, শিক্ষার গুণগতমানের ক্রমাবনতি ঠেকাতে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক বিবেচনা নয় বরং মেধা ও যোগ্যতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষকদের গবেষণা ও প্রশিক্ষণে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। তাহলেই দেশের শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি ঠেকানো সম্ভবপর হবে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ'র প্রফেসর।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/জেআইএম