তবু হৃদয়ে তাদের বাংলাদেশ
দেশভাগের সময় আমার জন্ম হয়নি, দেখিনি দেশভাগের কাল। কিন্তু পরিণতিটা দেখলাম। ভাগ-বাটোয়ার আগুনে জ্বলছে মানুষ। ভাবা যায়! ৭৫ বছরেও জ্বলা শেষ হয়নি। মনে হয় না শত বছর পরও শীতল হবে সেই পোড়া মানুষের হৃদয়। কী দুর্বিষহ জীবনযন্ত্রণা তাদের।
১৯৪৭-এ দেশভাগের পর ধর্মপরিচয়ে ভিন্নতার কারণে মানুষগুলোকে পূর্বপুরুষের ভিটে ছাড়তে হয়েছে। তারপর তাদের পথ অনুসরণ করেছে অসংখ্য মানুষ, তার পেছনেও কারণ ওই একটাই। ধর্মীয় সংখ্যালঘু হওয়া। মুসলমানের দেশে হিন্দুদের থাকতে নেই। মাটির মায়া ত্যাগ করতে না পারলে তাদের ত্যাগে বাধ্য করার উদাহরণ তো এখনও দেখছি। কেমন আছে দেশত্যাগী এই মানুষগুলো?
সম্প্রতি কলকাতার কিছু এলাকা সফরকালে তেমন মানুষগুলোর সঙ্গ পাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। আমি যাদের সংস্পর্শে গিয়েছি সবাই সচ্ছল, কেউ বা অনেক ধনসম্পদের মালিক এবং উচ্চশিক্ষিতও। বাড়ি-গাড়ির মালিকও বটে। অধিকাংশই মনে করেন, পিতৃভূমিতে থাকলে হয়তো তাদের এই পরিবর্তন নাও হতে পারতো। এরপর তো তাদের আফসোস থাকার কথা নয়, ফেলে যাওয়া দেশটার প্রতি মমতা থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
আমার লেখা ‘বাংলাদেশের জনযুদ্ধ’ ও যৌথ সম্পাদনায় ‘কালের প্রবাহে বাংলাদেশ’ নামের দুটি বইসহ বাংলাদেশ বিষয়ে পাঁচটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে কলকাতা গিয়ে দেখে এসেছি সেই মানুষগুলোকে তাদের বসতি এবং তাদের বাংলাদেশ প্রীতিও।
ষাটের দশকে গড়ে ওঠা একটি জনপদের কথা বলি। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বিমানবন্দর থেকে ১৫ মিনিট দূরত্বে তখন ছিল বিশাল পরিত্যক্ত ভূমি। সেখানেই তখন পূর্ববঙ্গ থেকে যাওয়া বাস্তুচ্যুত মানুষগুলো কলোনি বানিয়ে বসতি করে। ঘুরে দেখলাম অধিকাংশই বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার মানুষ। পুকুরপাড় নামে একটা পাড়া আছে একটি পুকুরকে ঘিরে। পুকুর লাগুয়া একটি বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম বাংলাদেশের শেরপুরকে। বাড়ির নাম ‘শেরপুর ভবন’।
একটু এগিয়ে একটি বাড়ির সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াই। গেটের পাশে দর্শনীয় তিনটি স্মৃতিপ্রস্তর। ওয়াল কেবিনেটের মতো ভিতরে ঢুকে গেছে কিছু অংশ। তিনজনের নামফলক। জন্ম নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহে। দেশত্যাগী এই মানুষগুলোর একজন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন ওয়ার রিপোর্টার দিলীপ চক্রবর্তী। তিনি বললেন, ‘জানেন বছর কয় আগে দেশে গিয়েছিলাম’।
কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি তার দিকে। বললেন, ‘আমার নিকটাত্মীয়ের সহযোগিতায় গিয়েছিলাম জন্মভিটায়। আহ! কী শান্তি। নিজ গাঁয়ের বাতাস, নিজ গাঁয়ের মানুষ, কত আপনজন। একজনকে পেলাম প্রতিবেশী, অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। কদমবুসি করলেন। বললেন, নিজের ভিটায় কি ফিরে আসা যায় না? বলেন কী জবাব দেব তাকে? জবাব দিতে পারিনি। যেমনি আমার চোখ নামাতে পারিনি বাড়ির গাছগুলো, গাছে বসা পাখিগুলোর দিক থেকে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলাম প্রাণভরে, চোখ বন্ধ করে। কিন্তু কান খোলা। শুনলাম এক তরুণের কণ্ঠ।
আমার গ্রাম বেতাল এর নতুন প্রজন্মের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘চাচা দ্যাখেন মাটি আছে মাটির থানে। আর মাইনসে বৃষ্টির পানির লাহান গড়াইয়া যায়-একখান থাইকা অন্যখানে’। তিনি কথাগুলো আমাকে শোনালেন, সঙ্গে সঙ্গে তার লেখা বই ‘গারো পাহাড়ের লাল ফুল এবং…’ এর পাতা খুলে দেখালেন, ভেজা চোখে তিনি তার গ্রাম ছাড়ছেন।
তিনিও বৃষ্টির পানির লাহান গড়াতে গড়াতে আবারও পরিবর্তিত ঠিকানায় চলে যান। কিন্তু সঙ্গে নিয়ে যান নিজ জন্মভূমির মাটি। সযত্নে আছে তার সংরক্ষণে। সাংবাদিক দিলীপ চক্রবর্তী তার অনুভূতিগুলো বিভিন্ন লেখায় প্রকাশ করেছেন। প্রকাশ হয়েছে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায়। তার মানসিক অবস্থার বিষয়গুলো অনেকেই জানতে পারছে। কিন্তু অসংখ্য মানুষ আছে যাদের মানসিক যন্ত্রণাগুলো শেয়ার করার সুযোগ নেই। তাদের অব্যক্ত ভালোবাসাগুলো তাদের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায়।
এমনি একজনের কথা বলি। আমার অত্যন্ত প্রিয়জন সে। ঘনিষ্ঠতম বন্ধু আমার। অ আ ক খ থেকে শুরু করে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সময়কাল আমরা ছিলাম একে অন্যের ছায়া। পড়তাম একই স্কুলে একই ক্লাসে। বিকেলে খেলতামও একই মাঠে। সেই সতীনাথ দাসের কথা বলি। এর আগে দীর্ঘ প্রায় ৩৫-৩৬ বছর পর ২০১১ সালে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, ওর কলকাতার বাসায়। পুরো রাত গল্পে গল্পে কাটিয়ে দিয়েছিলাম।
বলেছিলাম চিকিৎসক তুই, বাড়ি আছে কলকাতায়, কী সুন্দর বাগান, বাড়িতে। শিক্ষক হিসেবেও নাম করেছিস। একটা মানুষের আর কী চাওয়া থাকতে পারে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল তার। জবাব এসেছিল- আমার সব আছে, জানিস আমার কিছুই নেই। রহস্যময় জবাব। বাকি অংশটুকুর জন্য দেখতে হলো ওইদিনের আনন্দবাজার পত্রিকা। জানালো-দেখ পত্রিকায় পাত্র চাই, পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনগুলো।
লেখা আছে পূর্ববঙ্গীয় ব্রাহ্মণ পাত্রীর জন্য পূর্ববঙ্গীয় ব্রাহ্মণ পাত্র চাই। বলতো আজ এত বছর পরও আমরা পূর্ববঙ্গীয়ই রয়ে গেলাম। জানিস কী! আসলেও আমরা পূর্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। মনমানসিকতা চালচলন সবই অবিকৃত রয়ে গেছে আমাদের। আমরা কোনোভাবেই ভুলতে পারি না, আমাদের সেই গ্রাম, সেই জনপদ। বড় টান সেই মাটির সঙ্গে। তোকে বলেছিলাম আমাদের বাড়ি থেকে এক মুঠো মাটি আনতে। সেই মাটি থাকবে আমার পূজার ঘরে। দেবতার পাশে।
সপ্তাহকাল আগে আবার দেখা হয় সতীনাথের সঙ্গে। কয়েক ঘণ্টা ছিলাম তার বাড়িতে। রেকর্ডের মতো চলছিল ওর কথা। হিসাব করছিলাম, আমার হারানোর পরিমাণ আর তার হারানোর পরিমাণ বিষয়ে। আমি হারিয়েছি একজন বন্ধু। আর ও হারিয়েছে তার আত্মীয়-স্বজন, ভিটে মাটি, গ্রাম পরিবেশ সব।
সুতরাং সেদিন শুধু তার কাছ থেকে শুনেছি বেশি। আমি যা বলেছি তাও ছিল তার প্রশ্নের জবাব। বাংলাদেশে তার প্রতিবেশীদের কথা, তার বাড়ির কথা, তার পুকুরপাড়ের কথা এমনই সব। আমাকে বিদায় জানাতে গাড়ির দরজা খুলে স্থবির হয়ে গিয়েছিল তার হাত। ছলছল করছিল ওর চোখ। আকড়ে ধরে রেখেছিল আমাকে। খুব কষ্ট হয়েছিল তাকে ছেড়ে আসতে।
এমনি আরেকটা উদাহরণ দিই। সোমনাথ দাস থাকে কলকাতা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে দুর্গাপুরে। ২০১১ সালেই গিয়েছিলাম ওর বাসায়। খাওয়া শেষে ওর অ্যাপার্টমেন্টে একদিকে নজর যায়। তার পূজার মূর্তির পাশে দেখি, পিতলের ঘট একটা। ছোটই আকারে। সোমনাথ এগিয়ে আসে। বলে, ‘জানো হোসেনদা এই ঘটের ভিতর কি? নিশ্চয়ই আমার জানার কথা নয়। তাই চুপ করে থাকি। সোমনাথ জানায়, এর ভিতর আমার বাড়ির মাটি আছে। প্রতিদিন আমি বের হওয়ার সময় আমার মাটিটুকু প্রণাম করি। আমার বাড়ির ছোঁয়া নিই’।
আমি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কাজ করতে গিয়েছিলাম কলকাতায়। সব জায়গা চেনা নেই। স্থানীয় কারও সহযোগিতা পেলে কাজের সুবিধা হতো ভাবতে ভাবতে পেয়েও যাই। তরুণ বন্ধু একজন, দেবদ্যুতি দাশগুপ্ত নাম। ফেসবুকে পরিচয়, সেখানেই তার প্রতি দুর্বলতা তৈরি হয়। কারণ ভারতীয় এই তরুণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অনেক কিছু জানে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় সৈনিকদের নিয়ে তার বিশাল কাজ দেখেছি ফেসবুক পেজে। তাকে যখন বললাম কলকাতায় আমাকে সাহায্য করবে কি না। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়। বলে আমি ছুটি নিয়ে নেব অফিস থেকে।
সেই তরুণ ইঞ্জিনিয়ার ছায়ার মতো ছিল আমার সঙ্গে। প্রথম অবাক হয়ে যাই, যখন দেখি আমাদের বিজয় দিবস নিয়ে তার তৈরি ম্যুরাল। একজন ইঞ্জিনিয়ার অথচ শিল্পে তার আনাগোনা। তাও আবার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চিত্র। তার সংগ্রহে থাকা কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভিডিওচিত্র এবং স্থিরচিত্রও দেখলাম সেই সুবাদে। উইং কমান্ডার ক্লার বাসায় গিয়ে দেখলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সেই বিমানবাহিনীর কর্মকর্তার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বেশ। তরুণ ছেলেটি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে প্রতিদিন ২৫-৩০ কিলোমিটার মেট্রোরেল চড়ে এসে আমাকে সময় দিয়েছে।
কখনো ট্যাক্সিতে, কখনো উবারে, কখনো হেঁটে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেছে। কৌতূহলটা চেপেই রেখেছিলাম। একসময় কৌতূহল মিটে যায়, তার পারিবারিক পরিচয় জেনে। আদি নিবাস বরিশালের গৈলা গ্রামে। তার বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু জন্ম কলকাতায় হওয়ার পরও পিতৃস্থানের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে। ওরাও কলকাতায় স্থায়ী অধিবাসী। কিন্তু মনজুড়ে বাংলাদেশ তাদের।
বাংলাদেশত্যাগী এই মানুষগুলোর কাছ থেকে যখন বাংলাদেশপ্রেমের কথা শুনি, অবাক বিস্ময়ে সংবাদে দেখি, নড়াইলে হিন্দু বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, ভাঙচুর হচ্ছে এবং লুটপাট হচ্ছে। আর দেশে ফিরে যখন এই নিবন্ধ লিখি তখন পত্রিকায় সংবাদ দেখি, জনশুমারি অনুয়ায়ী বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ থেকে কমে ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ, বৌদ্ধ জনসংখ্যা শূন্য দশমিক ৬২ থেকে কমে শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ, খ্রিস্টান জনসংখ্যা শূন্য দশমিক ৩১ থেকে কমে শূন্য দশমিক ৩০ ও অন্যান্য ধর্মের জনসংখ্যা শূন্য দশমিক ১৪ থেকে কমে শূন্য দশমিক ১২ শতাংশে নেমে এসেছে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ীই বলে দেয়, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা আরও সংখ্যালঘু হচ্ছে। তারা ভালো নেই। কিন্তু কেন? জবাব একেকজন একেক রকম দিতে পারেন। পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরুর কাতারে মিশতে গিয়েও থেকে যায় সংখ্যালঘুই।
উপসংহারে একটাই আবেদন করব সবার কাছে, দয়া করে পাকিস্তানের দিকে তাকান, দেখুন এভাবেই ওই দেশটি প্রায় শতভাগ মুসলমানের দেশ হয়ে গেছে। পরিণতিটা দেখুন, একসময় অমুসলিমদের নির্যাতন করা হতো। তারা দেশত্যাগে বাধ্য হয়। পাকিস্তান হয়ে পড়ে প্রায় শতভাগ মুসলমানের দেশ। কিন্তু এখন মসজিদে বোমা পরে ঈদের জামাতে গুলি হয়, এমনকি জানাজার নামাজেও খুন হয়।
লক্ষণীয় হচ্ছে, যারা খুন হয় তারা মুসলমান আর যারা খুন করে তারাও মুসলমান। উপসংহারটা হতে পারে এমন, ধর্মান্ধতা যখন রক্তে মিশে তখন রক্তপানই তাদের নেশা হয়ে যায়। ওরা মানুষ খুন করতে করতে নিজ ধর্মাবলম্বীদেরও খুন করে, রক্তের নেশা মেটায়। যেমনটা পাকিস্তানে আমরা লক্ষ্য করি। এখন সংখ্যালঘু কাউকে পায় না ওরা। তাই নিজেরাই নিজেদের রক্তে লাল হয়। আমরা যেন সেদিকে না যাই।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/ফারুক/এমএস