ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নিপাত যাক সাম্প্রদায়িকতা ধর্মান্ধতা

গোপাল অধিকারী | প্রকাশিত: ১০:১৩ এএম, ২৪ জুলাই ২০২২

হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সব ধর্মই শান্তির। সব ধর্মই শান্তির বাণী প্রচার করে। ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে ‘অহিংসা পরম ধর্ম’। অন্যের ধর্মকে আঘাত করে ধর্ম পালনে বাধা রয়েছে সব গ্রন্থেই। সেবার কথা বলা হয়েছে সব ধর্মেই। তবুও থেমে নেই ধর্মের নামে অধর্ম প্রচার। নিরুৎসাহিত করা যায়নি আইনকে অমান্য করে নিজ হাতে আইন ভাঙার প্রবণতা।

নড়াইলের মির্জাপুরের ঘটনার রেশ না কাটতেই ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ফের লোহাগড়ায় হিন্দু বাড়িতে হামলা ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার (১৫ জুলাই) বিকেলে উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের সাহা পাড়ায় এ হামলার ঘটনা ঘটে। এক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের এক পোস্টের নিচে ধর্মীয় অবমাননামূলক মন্তব্য করার অভিযোগ তুলে তার বাড়িতে হামলা ও আগুন দেয় উত্তেজিত জনতা।

কয়েক বছর ধরে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার পোস্ট দেওয়া হয়েছে এই অজুহাত তুলে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রবণতা বাড়ছে। আবার ভুয়া তথ্য ফেসবুকে ছড়িয়ে হামলার ঘটনাও ঘটানো হচ্ছে। ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের ওপর ছোটবড় তিন হাজার ৫০০ হামলা হয়েছে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে এমন আঘাত আর যাই হোক সভ্য মানুষের কাম্য হতে পারে না।

ঘটে যাওয়া সেই সব ঘটনার শেষ পর্যন্ত দেখা যায় ধর্মীয় অবমাননার কোনো সত্যতা নেই। তারপরও কেন আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা কমছে না তা বোধগম্য নয়। তবে মিথ্যা অভিযোগে নির্মম হামলার কোন কি সুরাহা হয়েছে? হামলাকারীরা কি যথাযথ শাস্তি পেয়েছে?

২০১২ সালে রামুতে বৌদ্ধপল্লি ও মন্দিরে হামলা হয় উত্তম বড়ুয়া নামে এক যুবকের ধর্ম অবমাননার ফেসবুক পোস্টের কথা বলে। কিন্তু পরে তদন্তে ওই পোস্টের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নাসিরনগরে হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা হয় রসরাজ নামে এক তরুণের ফেসবুক পোস্টের অজুহাত তুলে। কিন্তু তদন্তে জানা যায় রসরাজ এক নিরক্ষর জেলে। তার নামে ভুয়া আইডি খোলা হয়েছিল।

২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হামলা হয় টিটু রায় নামে একজনের ফেসবুক পোস্টের অজুহাত তুলে। টিটু রায় থাকতেন নরায়ণগঞ্জে। ওই পোস্টেরও সত্যতা মেলেনি। ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা হয় ফেসবুক পোস্টের অজুহাত তুলে। পরে তদন্তে দেখা যায় বিপ্লব চন্দ্র দাস নামে একজনের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে ওই পোস্ট দেওয়া হয়েছিল।

২০২১ সালের ১৭ মার্চ সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁওয়ে ৯১টি হিন্দু বাড়িতে হামলা ও লুটপাট করা হয়। হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ঝুমন দাস নামের এক যুবকের কথিত ফেসবুক পোস্টে ধর্ম অবমাননার অজুহাত তোলা হয়। ওই পোস্ট যে ঝুমন দাস দিয়েছেন তার প্রমাণ এখনো মেলেনি।

গত বছরের ১৩ অক্টোবর কুমিল্লায় হামলা হয়েছিল ফেসবুকে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে। প্রতিটি ঘটনায় দেখা গেছে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কিন্তু ফেসবুক পোস্ট না দেওয়ার পরও ভুয়া অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, মামলা হয়েছে। তাদের কারাগারে যেতে হয়েছে।

ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে শুধু যে হিন্দু যুবকই গ্রেফতার হয়েছে তা নয়। ধর্ম অবমাননা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার অভিযোগে নওগাঁয় আবদুর রউফ মিঞা নামে এক কলেজ শিক্ষককে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। গত ১৭ জুন বৃহস্পতিবার রাতে নওগাঁ সদর উপজেলার কাঁঠালতলী এলাকায় নিজ বাসভবন থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি নওগাঁর রানীনগর মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।

কলেজ কর্তৃপক্ষ, পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গ্রেফতারের তিনদিন আগে আবদুর রউফ তার ফেসবুক আইডি থেকে ধর্ম অবমাননা করে একটি পোস্ট করেন। বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। শুরুতে কলেজ কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে স্থানীয় আলেম-ওলামাসহ একদল জনতা ওই শিক্ষকের বিচারের দাবিতে কলেজে অবস্থান নেয়। বিকেলে আবদুর রউফকে কলেজ কর্তৃপক্ষ কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলে তারা কলেজ প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেন। এরপর আবদুর রউফকে তার নিজ বাসভবন থেকে আটক করে পুলিশ।

সুতরাং ধরে নেওয়া যায় ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে একটি ভাবধারার মানুষ অতি আবেগে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অধর্ম কায়েম করছে। তাদের কাছে শিক্ষক, পিতা-মাতা, সমাজ-রাষ্ট্র বলে কিছু নেই। ধর্মীয় লেবাসে তারা রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করছে এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

গত ১৮ জুন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মাকে সমর্থন করে এক হিন্দু শিক্ষার্থী ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন- এমন অভিযোগ তুলে কলেজে পুলিশের সামনেই শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অপদস্থ করা হয়। গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় ওই শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন স্বপন কুমার। মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজে এ নিয়ে দিনভর চলে উত্তেজনা। নড়াইলে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরানোর পর ঘটনা ঘটেছে, যা সব ধর্মের শিক্ষকদের বিবেককে নাড়া দিতে দেখেছি।

বিবিএসের করা বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে মুসলিম জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার ৮৮ দশমিক ৪ শতাংশ। হিন্দু এবং অন্য ধর্মাবলম্বী ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১১ সালের আদমশুমারির হিসাবে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ।

সরকারি হিসাবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৪৬ লাখের হিসাবে তাদের সংখ্যা ১ কোটি ৭৪ লাখ। সুতরাং দেশে বসবাস ও সব প্রকার রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার অধিকার রয়েছে সবার। একটি নাগরিককে আইন অমান্য করতে বাধা প্রদান না করলে তা যেমন আইনের শাসন হয় না ঠিক তেমনি একটি নাগরিকের শান্তি প্রতিষ্ঠায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তা না দিলে তা আইনের শাসন হয় না।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় ভেদ লুপ্ত করে এক জাতি তৈরি করতে চান কীভাবে? প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু, বলেছিলেন, কেন আমার ডাকে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সব বাঙালি সাড়া দেয়নি? প্রশ্ন ছিল তখন তারা সাড়া দিয়েছে একটি সংগ্রামের ডাকে। কিন্তু জাতি গঠনের ডাকে তারা সাড়া দেবে কি?

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তিতে বাংলাদেশে বাঙালি নামক এক জাতি গড়ে তুলব।’ বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন সার্থক হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশেও মুসলমানরা মুসলমানই রয়ে গেছে, হিন্দুরা হিন্দুই রয়ে গেছে, আদিবাসীরা আদিবাসীই রয়ে গেছে। এক বাঙালি জাতি গঠন সম্ভব হয়নি।

একটি ঘটনার সুষ্ঠু ও কঠোর শাস্তি দাবিয়ে দিতে পারে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার নামে বিশৃঙ্খলাকারী গোষ্ঠীর অপরাধ প্রবণতাকে। একটি সুষ্ঠু সমাধান উপযুক্ত উদাহরণ হতে পারে আইন অমান্য করে মিথ্যার জালে জড়িয়ে যারা ধর্ম রক্ষার নামে বাড়িঘর পুড়িয়ে মারছে। তদন্ত শেষে দোষী সাব্যস্ত হলেও রাষ্ট্রের দায় থাকে অপরাধীর শাস্তির মুখোমুখি করা।

যেখানে অহরহ ভুয়া আইডি খুলে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে সেখানে বার বার ভুয়া আইডির তথ্য দেখে কেন আইন হাতে তুলে নেওয়া হচ্ছে বোধগম্য নয়। ফিরে পেতে চাই একাত্তরের সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনা। বৃদ্ধি পাক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে জড়িয়ে থাকার প্রবণতা। নিপাত যাক সাম্প্রদায়িক চেতনার ধর্মান্ধতা।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম