কথা কম বলে কাজে প্রমাণ দিন
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সম্প্রতি নির্বাচনকালীন সহিংসতা প্রসঙ্গে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা আত্মঘাতী ও অপরিণামদর্শী। এমন বক্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহার করা উচিত। জাতি সিইসির কাছে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য কোনোভাবেই প্রত্যাশা করে না। সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের ‘তলোয়ারের বিপরীতে রাইফেল নিয়ে দাঁড়ানো’ বক্তব্যে গোটা জাতি হতাশ হয়েছে। তার এই বক্তব্য নিয়ে ইতোমধ্যে সর্বমহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়ে সহিংসতাকে উসকে দেওয়ার মতো এমন বক্তব্য কোনোভাবেই দিতে পারেন না। জাতি তা প্রত্যাশাও করে না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায়, রোববার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরুর দিনে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) সঙ্গে সংলাপে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, সব দল সহযোগিতা না করলে আমরা সেখানে ব্যর্থ হবো। আপনাদের সমন্বিত প্রয়াস থাকবে, কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়, আপনাকে রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আপনি যদি দৌড় দেন, তাহলে আমি কী করবো?
গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এমন সংবাদে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ গভীর বিস্ময় ও হতাশা প্রকাশ করেছে। নির্বাচন কমিশন একটি দায়িত্বশীল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রের নির্বাচনসমূহ স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও সবার জন্য সমান ক্ষেত্র নিশ্চিত করার দায়িত্ব তার ওপর ন্যস্ত। কিন্তু নির্বাচনে সবার সহযোগিতা চাইতে গিয়ে সম্ভাব্য সহিংসতা প্রসঙ্গে সিইসি যে তলোয়ারের বিপরীতে তলোয়ার বা রাইফেল ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন- প্রকান্তরে তা সহিংসতাকেই উসকে দেবে। এধরনের বক্তব্য যেকোনো নাগরিকের জন্য যেখানে অপরাধ প্রবণতার শামিল, সেখানে সিইসির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত থেকে এমন বক্তব্য আত্মঘাতী, অপরিণামদর্শী ও অগ্রহণযোগ্য।
সিইসির এমন বক্তব্য নির্বাচনকেন্দ্রিক পেশিশক্তির ব্যবহার, বুথ দখল কিংবা ভোটারদের ভোট দিতে বাধা প্রদান, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধাদান, জোরপূর্বক বাক্স ভরার মতো ঘটনা, অরাজকতা বিগত কয়েকটি নির্বাচনকে যেখানে শুধু আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করেছে, সেখানে এমন বক্তব্য এই প্রবণতাকে আরও উৎসাহিত করবে।
জাতি আশা করে সিইসি তার এমন বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেবেন ও তলোয়ারের বিপরীতে রাইফেল বা তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ানোর পরামর্শটি জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রত্যাহার করে নেবেন। মূলত কথা কম বলে স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজন করাটা ইসির অঙ্গীকার হওয়া উচিত। কিন্তু নির্বাচনকালীন সহিংসতাকে রোধের নামে পাল্টা সহিংস আচরণের এই পরামর্শ সহিংসতা ঠেকানোর জন্য কোনোভাবেই যথোপযুক্ত কৌশল হতে পারে না।
এধরনের বক্তব্য সহিংসতারোধে কার্যকরী কৌশল প্রণয়নে কমিশনের ব্যর্থতাকে স্পষ্ট করে দেয়। একই সঙ্গে তা নির্বাচনের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার বা রাজনৈতিক দলগুলোকে বা তাদের ছত্রচ্ছায়ায় স্বার্থান্বেষী মহলকে সহিংসতা বেছে নিতেই উৎসাহিত করবে। জাতি আশা করে, কমিশন এ ধরনের সহিংসতা সহায়ক প্রস্তাবের পথ পরিহার করে নির্বাচনকালীন সম্ভাব্য সহিংসতা রোধে কার্যকর কর্মকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবে।
পাশাপাশি কোনো ধরনের সহিংসতা বিশেষত নির্বাচনকালীন সহিংসতাকে উসকে দেয় এমন কোনো বক্তব্য দেওয়া থেকে কমিশন নিজেকে বিরত রাখবে বলেও সচেতন নাগরিকরা আশা প্রকাশ করে। আমার একটা বিষয় কোনোভাবেই মাথায় ঢুকছে না যে, যারাই নির্বাচন কমিশনে যান তাদের বিবেক বুদ্ধি ও স্বাভাবিক বিচার বিবেচনা কি লোপ পেয়ে যায়? নাকি যাদের বিচার বিবেচনাবোধ খুবই কম তারাই কমিশনে নিয়োগ পান। নির্বাচন কমিশন কাজের চেয়ে কথা বলাটাকে যে কেন বেশি পছন্দ করেন তা মোটেই বোধগম্য নয়। কমিশন কি জনগণের মনের ভাষা বুঝতে ব্যর্থ? নাকি তারা বুঝতেই চান না।
ভোটাররা কথা নয় নির্বাচন সহায়ক দৃশ্যমান কাজ দেখতে চায়। যেখানে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে এই মুহূর্তে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে ব্যাপক বাক্যযুদ্ধ চলমান। কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে তা এখনও অমীমাংসিত, ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত। নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কেমন হবে তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তখন ইসির এমন দায়িত্বনহীন বক্তব্য কতটা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক হবে তা আজ সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে।
যেখানে মানুষ নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করে সেখানে এমন বিতর্কিত বক্তব্য রাজনৈতিক সংকটকে আরও সংকটাপন্ন করে তুলবে। জনগণ আশা করে নির্বাচন কমিশন যতদূর সম্ভব কম কথা বলবে। বিতর্ক সৃষ্টি হয় এমন কাজ বা কথা বলা থেকে বিরত থাকবে। জাতি কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন পুনরায় দেখতে চায় না। আশা করতে চাই কমিশন সরকারি দলের নয় বরং প্রকৃত ভোটারদের মনোভাবটা জানার বা বোঝার চেষ্টা করবে। তাহলেই তারা সফল হবেন।
লেখক: আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/এএসএম