বাংলাদেশে লঙ্কাকাণ্ড কিংবা আরব বসন্তের প্রত্যাশা হাস্যকর
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশসহ আঞ্চলিক রাজনীতির অন্যতম আলোচনার বিষয় হচ্ছে শ্রীলঙ্কায় ঘটে যাওয়া অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিপর্যয়। ২০২২ সালের প্রথম দিক থেকেই এই বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে রয়েছে। এই আলোচনা রয়েছে দুটি ধাপ। প্রথম ধাপটি হচ্ছে এ বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস যখন শ্রীলঙ্কা সরকার নিজেদেরকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছিল। অর্থনৈতিক সঙ্কট এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছিল যে সরকারের পক্ষে দেউলিয়া ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। ঠিক তেমনিভাবে দেশে জ্বালানিসহ খাদ্যশস্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির ফলে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ফলে গণআন্দোলনের মুখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মহিন্দা রাজাপক্ষে পদত্যাগ করলেও তার ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবার পরেই তার অত্যন্ত আস্থাভাজন রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবার পরেই রনিল বিক্রমাসিংহে বিভিন্ন দেশ এবং আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকেন শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য। কিন্তু তিন মাসের অধিক সময়কাল অতিবাহিত হলেও তিনি তেমন কোনো ইতিবাচক অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় মানুষ পুনরায় রাস্তায় নেমে আসে।
ফলে শ্রীলঙ্কায় দ্বিতীয় বারের মত অস্থিরতা দেখা দেয়। এবারে জনগণের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। অর্থাৎ তাদের একটাই দাবি ছিল রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ। এ বিষয়টি আঁচ করতে পেরে রাষ্ট্রপতি প্রাসাদ থেকে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে বিমান বন্দর এবং নৌপথ দিয়ে দেশ থেকে পালাতে ব্যর্থ হয়ে তিনি সামরিক বাহিনীর একটি বিমানে চড়ে পার্শ্ববর্তী দেশ মালদ্বীপে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
গত কয়েক মাস ধরেই বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এবং সুশীল সমাজের একটি অংশ শ্রীলঙ্কার ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রত্যাশা করতে শুরু করেছে যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে শ্রীলংকার মতো অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। পাশাপাশি তারা এও প্রত্যাশা করেছিল যে সেই অবস্থা তৈরি হলে বাংলাদেশের জনগণ শ্রীলঙ্কার জনগণের মতো মাঠে নামবে সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য। কিন্তু তাদের সেই সমস্ত অমূলক ধারণা একেবারেই সত্য প্রমাণিত হয়নি। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর থেকেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার শক্তভাবে যে যুক্তি উপস্থাপন করেছে তা হল শ্রীলঙ্কার সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিস্তর ফারাক রয়েছে।
তাছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও বারবার বলা হয়েছে যে বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হবার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। যারা এই ধরনের অমূলক কল্পনা করে তাদের প্রথমে বাংলাদেশের অর্থনীতির সাথে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির মৌলিক পার্থক্যটা ভালোভাবে বুঝতে হবে। শ্রীলংকার অর্থনীতি মূলত পর্যটন শিল্পের উপর নির্ভরশীল।
গত দুই বছরের অধিক সময় ধরে চলমান কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্পে একেবারে ধস মেনে যায়। ফলে, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকে এবং জ্বালানি তেলসহ অন্যান্য সামগ্রী আমদানি করার ক্ষেত্রে সরকার বেগ পেতে শুরু করে। একটা পর্যায়ে সরকার বাধ্য হয়ে সকল প্রকার আমদানি বন্ধ করে দেয়। ফলে মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দেয়।
কিন্তু, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ হচ্ছে গার্মেন্টস এবং প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক শক্ত অবস্থানে রয়েছে। কোভিড-১৯ অতিমারির প্রথমদিকে অনেকে ধারণা করেছিল যে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার পাঠানোর মাত্রা কমে যাবে কারণ অনেক প্রবাসী চাকুরি হারিয়েছিল অতিমারির প্রাথমিক পর্যায়ে। তবে, সরকারের কূটনৈতিক সফলতার কারণে আবার বাংলাদেশের শ্রমিকরা অল্প সময়ের ব্যবধানে তাদের কর্মস্থলে ফিরে গেছেন এবং একই হারে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন।
তাছাড়া উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ব্যয় নির্বাহের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে যে ঋণ নিয়েছে সেই ঋণের কিস্তি প্রদানের জন্য খুব বেশি বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হচ্ছে না। আমাদের দেশে ঋণের কিস্তি প্রদানের জন্য যে পরিমাণ খরচ করতে হয় সেটি শ্রীলঙ্কা শ্রীলঙ্কা তুলনায় অনেক কম।
ফলে বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজমান রয়েছে সে অবস্থায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। তাছাড়া শ্রীলঙ্কায় রাজা এবং তার আত্মীয়-স্বজনদের দুর্নীতির মাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছালেও সরকারের তরফ থেকে তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। ফলে, জনগণের মধ্যে বিপুল ক্ষোভ ছিল।
বাংলাদেশে কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও সেরকম কোন অবস্থা তৈরি হয়নি। এছাড়া বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় না। ফলে জনগণের মধ্যে এ বিষয়ে কোন ক্ষোভ নেই। ফলে এটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে অদূর ভবিষ্যতে শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা বাংলাদেশে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই।
বিরোধী এই গোষ্ঠী শ্রীলঙ্কার মানুষের বাস্তায় নেমে আসা এবং কয়েক বছর আগে মিশরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে আন্দোলনের বিষয়টিকে মাথায় রেখে দিবা স্বপ্ন দেখতে ব্যস্ত ছিল এই ভেবে যে বাংলাদেশের জনগণ হয়তো খুব দ্রুতই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাবে। তাদের এই স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যাবে।
আমরা যদি শ্রীলঙ্কা এবং মিসরের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখা যাবে সে উভয় দেশের জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। বাংলাদেশের জনগণ এমন কোন অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে পড়েনি যে তাদেরকে রাস্তায় নেমে এসে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে। এখানে বলে রাখা ভালো যে গত দুই বছর ধরে কোভিড-১৯ অতিমারির তাণ্ডবে পৃথিবীর বড় বড় দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
কারণ কোভিড এর প্রভাব শুধুমাত্র স্বাস্থ্য খাতের উপরই পড়েনি, অর্থনীতি ও শিক্ষাসহ অন্যান্য সকল খাতকে বিপর্যস্ত করেছে। এরপরেও বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে আমরা একদিকে যেমন কোভিডের স্বাস্থ্যঝুঁকি খুব সফলভাবে মোকাবেলা করতে পেরেছি, ঠিক তেমনিভাবে আমাদের অর্থনীতিকে একটি শক্ত ভিত্তির উপর রাখতে সক্ষম হয়েছি।
কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। সেই বিষয়টিকে মাথায় রেখে সরকারের উচিত কিছু আর্থিক সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেওয়া। আশার কথা হল ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারের পক্ষ থেকে বেশকিছু অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে বৈশ্বিক মন্দার বিষয়টিকে মাথায় রেখে। ফলে জনগণ রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামাবে-এই ধরনের প্রত্যাশা অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পূরণ হবার সম্ভাবনা নেই।
যে কোন দেশের সরকার পরিবর্তন হয় মূলত দুটি উপায়ে। একটি হচ্ছে ভোটের মাধ্যমে এবং অপরটি হচ্ছে জনগণের আন্দোলনের মাধ্যমে। বাংলাদেশে গত সাড়ে তের বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার যে পরিমাণ উন্নয়ন অর্জন করেছে তার প্রেক্ষিতে খুব স্পষ্ট ভাবেই বলা যায় যে আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রাখবে।
এছাড়া নির্বাচন জিতে ক্ষমতায় আসার জন্য একটি রাজনৈতিক দলের যে পরিমাণ সাংগঠনিক শক্তি প্রয়োজন হয়, বর্তমান বিরোধী দলগুলোর সে অবস্থা নেই। অনেক লম্বা সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকার ফলে এবং জাতিকে কোন ব্যতিক্রমী স্বপ্ন দেখাতে ব্যর্থ হওয়ার ফলে বাংলাদেশের জনগণ বিরোধী রাজনীতি উপরে আস্থা হারিয়েছে। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে অন্য কোনো পন্থায় ক্ষমতায় যেতে চাইছে।
অন্যদিকে জনগণ আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটাবে- এই ধরনের কোনো আশঙ্কা বাংলাদেশে নেই কারণ বর্তমান সরকারের উপর জনগণের আস্থা রয়েছে। সরকার দেশে এমন কোন অনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে নি যাতে জনগণ রাস্তায় নেমে আন্দোলন করবে। পাশাপাশি বিরোধী দলগুলোর এমন কোনো সক্ষমতা নেই যে তারা জনগণকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পারবে। যদিও তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রোপাগাণ্ডা চালিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু, বাংলাদেশের জনগণ তাদের সেই মিথ্যাচারকে আস্থায় নিবে না।
বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং জোটের একটি বিষয় অনুধাবন করা উচিত যে রাজনীতি করতে হলে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে রাজনীতি করতে হয়। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বিরোধীদল বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারা থেকে অনেকটা ছিটকে পড়েছে- এটাই বাস্তবতা। অতএব তাদের উচিত জনগণকে আস্থায় নিয়ে জনগণের উন্নয়নের জন্য গঠনমূলক রাজনীতি করা।
কোন দেশে কি ঘটনা ঘটেছে, সেই বিষয় মাথায় নিয়ে সে রকম ঘটনা বাংলাদেশের ঘটবে- এই ধরনের দিবাস্বপ্ন যারা দেখে তাদের সেই স্বপ্ন কখনো বাস্তবে রূপ নিবে না। একমাত্র গঠনমূলক রাজনীতির মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করা যায়- এ বিষয়টি সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উপলব্ধি করা উচিত।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।
এইচআর/জেআইএম