নতুন মেরুকরণের পথে বিশ্বরাজনীতি?
দুই বছরের বেশি সময় ধরে পৃথিবী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। ৪ জুলাই পর্যন্ত পৃথিবীজুড়ে ৫৫ কোটি ৪৩ লাখের মতো মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যুবরণ করেছেন ৬৩ লাখ ৬২ হাজারের মতো। সংক্রমণের হার এবং মৃতের সংখ্যা কমে এলেও করোনামুক্ত পৃথিবী কবে পাওয়া যাবে তা নিশ্চিত করে বলার মতো বিশেষজ্ঞ এখনো পাওয়া যাচ্ছে না।
করোনায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছে ধনী ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। প্রায় ৯ কোটির মতো মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এ পর্যন্ত। মৃতের সংখ্যা সাড়ে ১০ লাখ ছুঁই ছুঁই। করোনাভাইরাস শুরু হয়েছিল চীনে। পৃথিবীতে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েতের তিন দশকেরও বেশি সময় পরে চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয় মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে। তারপর অবশ্য এই দুই বড় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরস্পর সহযোগী না হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছে। দেশে দেশে বিপ্লব রপ্তানির প্রতিযোগিতায় নেমে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন সমাজতন্ত্রের উপকারের বদলে অপকার করেছে বলেই এখন বলা যায়। তবে সমাজতন্ত্র রপ্তানিতে সফল না হলেও চীন করোনাভাইরাস রপ্তানিতে পুরো সফল। চীনের ভাইরাসের ধকলে এখন পুরো পৃথিবী নাজেহাল।
চীনের হুয়ানে প্রথম করোনা বা কোভিড শনাক্ত হলেও নিজ দেশে চীন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে, সম্ভবত তার কর্তৃত্ববাদী দমনমূলক শাসনের কারণে। চীনের নাগরিকরা সরকারের নির্দেশ বিনা বাক্যব্যয়ে মানতে বাধ্য। কর্তৃত্ববাদী শাসন করোনা মোকাবিলায় সফল হলেও গণতন্ত্র করোনা মোকাবিলায় অসফল হয়েছে বলে মন্তব্য করলে কেউ হয়তো আবার এটাকে সরলীকরণ দোষে দুষ্ট আখ্যা দিয়ে বিতর্ক জুড়ে দিতে পারেন। তবে বেশি গণতন্ত্রের দেশগুলোতে করোনা যে বেশি দাপট দেখিয়েছে তা কি অস্বীকার করা যাবে?
গণতন্ত্র কিন্তু প্রতিযোগিতায় ক্রমাগত পিছু হটছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফিডম হাউসের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান বিশ্বের মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ সম্পূর্ণ মুক্ত বা গণতান্ত্রিক দেশের বাসিন্দা। বস্তুত স্ক্যানডেনেভিয়ান কয়েকটি দেশ ছাড়া আর কেউই নিজেদের সম্পূর্ণ মুক্ত বলে দাবি করতে পারে না। এক সময় যে যুক্তরাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক বিশ্বের বাতিঘর বলা হতো, সেই যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে সে দেশের গণতন্ত্রের বড় পরীক্ষা হবে।
এমন প্রশ্নও সামনে আসছে, আগামী পৃথিবী কি চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকবে? এখনই আমাদের গনকের ভূমিকায় যাওয়ার দরকার নেই। পরিস্থিতি আরও কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করাই সমীচীন হবে। তাৎক্ষণিকভাবে যারা ভবিষ্যদ্বাণী করেন, তাদের অনুমান প্রায়ই ভুল প্রমাণিত হয়। তবে কয়েকটি খবরের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। এগুলো তথ্য। এ থেকে যার যার মতো মতামত গঠন করা যেতে পারে, ভাবা যেতে পারে আমরা কোন নতুন দিনের দিকে যাচ্ছি। তবে, আমার উদ্দেশ্য হতাশা ছড়ানো নয়, তথ্য জানানো।
প্রথম খবরটি আবারও চীন থেকে। দেখা যাচ্ছে বড় ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী চীন এখন খবর তৈরিতেও এগিয়ে থাকছে। খবরটি হলো- ২০২০ সালের ৪ জুলাই চীনের ইনার মঙ্গোলিয়া অঞ্চলের একটি শহরের হাসপাতালে বিউবোনিক প্লেগ রোগ ধরা পড়েছে। এই রোগ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সে লক্ষ্যে সেখানকার স্বাস্থ্য কমিটি সতর্কতা জারি করেছে। শহরবাসীকে বন্যপশু শিকার ও এর মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে প্লেগ বা স্পষ্ট কারণ ছাড়াই কোনো জ্বরের ঘটনা ঘটলে ও কোনো অসুস্থ বা মৃত কাঠবিড়ালজাতীয় প্রাণীর দেখা মিললে সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
বিউবোনিক প্লেগ ১১০০ থেকে ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত সময়ে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে পরিচিত ছিল। এটা ইঁদুর, কাঠবিড়ালের মতো তীঘ্ন দাঁতের প্রাণীর মাধ্যমে ছড়াতে পারে এবং প্রায়শই প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। ২০১৮ সালেও এই রোগে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তাহলে চীনা নাগরিকদের খাদ্যাভাস কি প্রাণঘাতী রোগ বিস্তারে ভূমিকা রাখে? কঠোরভাবে তথ্য নিয়ন্ত্রণের কারণে চীনের সব খবর সব সময় বাইরের দুনিয়া জানতে পারে না, জানতে দেওয়া হয় না।
মনে রাখা প্রয়োজন যে, চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের শেষ দিকে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এবং দ্রুত দুনিয়াজুড়ে এর বিস্তার ঘটে। চীন যখন করোনাভাইরাসের সংকট কাটিয়ে উঠছে, যখন স্থানীয় সংক্রমণ প্রায় শূন্যের কোঠায়, তখন এই বিউবোনিক প্লেগের খবর অনেককে উদ্বিগ্ন করলেও পরে এ নিয়ে আর বড় কোনো খবর জানা যায়নি। জানা গেল।
দ্বিতীয় খবরটি হলো: করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এককোষী এ অণুজীবগুলো মস্তিষ্কে সংক্রমণ ঘটায়। বিবিসি জানিয়েছে, এই অণুজীবটির বৈজ্ঞানিক নাম নিগলেরিয়া ফোলেরি। এগুলো মস্তিষ্কখেকো নামে পরিচিত। এগুলো নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। তারপর মস্তিষ্কে সংক্রমণ ঘটায়। এ অণুজীবের সংক্রমণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর মৃত্যু ঘটে।
মস্তিষ্কখেকো অ্যামিবায় সংক্রমিত হলে জ্বর, বমিভাব ও বমির উপসর্গ দেখা দেয়। সংক্রমণের এক সপ্তাহের মধ্যে বেশির ভাগ রোগীর মৃত্যু ঘটে। ফ্লোরিডা ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘মনে রাখবেন, এটি একটি বিরল রোগ। কার্যকর প্রতিরোধমূলক কৌশলই পারে এটি প্রতিহত করতে’।
কি মনে হচ্ছে, চীনা রোগ বিশ্বব্যাপী ছড়ালেও আমেরিকান অ্যামিবা আমেরিকার বাইরে যাবে না? চীনের সম্প্রসারণবাদী ধারা প্রবল হলেও আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী নখরের থাবা বহু ব্যবহারে এখন কিছুটা ভোতা? মানব সভ্যতা কি বিরল সব রোগে এক নিউ নরমাল পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? অপেক্ষা করতে হবে এবং দেখতে হবে।
তৃতীয় খবরটি হলো : রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের প্রধানমন্ত্রী সি চিন পিং সারা জীবনের জন্য ক্ষমতায় থাকার পথ পাকাপোক্ত করেছেন। এই দুই নেতা আমেরিকার চোখের সামনে আগামী বিশ্ব ব্যবস্থা কার্যকরভাবে পুনর্নির্মাণ করছেন বলে ভূরাজনীতির বিশ্লেষকরা মনে করছেন। পুতিন এবং সি একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে এটা করছেন তা নয়। ট্রাম্পের তৈরি করা অনিশ্চয়তা ও অপরিণামদর্শিতা পুতিন এবং সি’র জন্য সহায়ক পরিস্থিতি তৈরি করছে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাইডেন নির্বাচিত হলেও তিনি বিশ্বকে আর আগের অবস্থায় নিতে সক্ষম হবেন বলে অনেকেই যে আশঙ্কা করেছিলেন, তা কি ধীরে ধীরে সত্য বলে মনে হচ্ছে না? ক্ষমতায় বসার পর থেকে বাইডেনের অর্জন কি? পুতিন ও সি নিজ নিজ দেশের ক্ষমতা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দুনিয়াজুড়ে ছড়ি ঘোরাবেন বলে কেউ মনে করতেই পারেন। তারা তাদের লক্ষ্যে দৃঢ়।
ট্রাম্প ছিলেন দোদুল্যমান, নিজের দলের ভেতর থেকেও সব সময় সহযোগিতা পাননি। বাইডেন নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েও পরিস্থিতি আমেরিকার জন্য আকাশ-পাতাল পরিবর্তন করতে পারছেন না। আমেরিকার শাসন ব্যবস্থা চীন এবং রাশিয়ার মতো নয়। চীন এবং রাশিয়া আলাদা আলাদাভাবে যে প্রভাব-প্রতিপত্তি গড়ে তুলছে, তা প্রতিহত করার সক্ষমতা ও দৃঢ়তা আমেরিকার বর্তমানে নেই, ভবিষ্যতে হবে বলেও মনে হয় না। ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে নতুন কোনো উপলব্ধি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে কি?
আমেরিকা নিয়ে পুতিন এবং সি’র ভেতরে ভিন্ন ভিন্ন রাগ-ক্ষোভ থাকাই স্বাভাবিক। এক সময় এই দুই দেশকেই লেজে ধরে নাচিয়ে মজা পেয়েছে আমেরিকা। পুতিনের সাবেক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করেছে আমেরিকা। একটু বদলা নেওয়ার সাধ যদি পুতিনের হয়, তা বড় দোষের হবে কেন? আমেরিকার সঙ্গে চীনের পিংপং কূটনীতি গত শতকের সত্তরের দশকে শুরু হয়েছিল। তবে চীন এখন বিশ্বপরিমণ্ডলে নিজেকে প্রধান হিসেবে দেখতে চাওয়ায় আমেরিকার সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত দেখা দিয়েছে। সি-ও তাই আমেরিকাকে ভোগাতে চান।
তাহলে কী দাঁড়াবে আগামীর বিশ্ব রাজনীতি? একদিকে করোনা মহামারি বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যত দ্রুত যুদ্ধের অবসান ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছিল, তা যে হচ্ছে না সেটা এখন স্পষ্ট। জ্বালানি ও খাদ্যের সংকট বাড়ছে। কোটি কোটি মানুষ বেকার হচ্ছে। খাদ্য সংকট প্রকট হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা– সবকিছুই ঝুঁকিতে। মন্দার বড় শিকার হবে নারী এবং কিশোরীরা। বৈষম্য বাড়বে। সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেবে।
বড় শক্তিগুলোর বড়াই ও লড়াইয়ের সুযোগ কোন দেশ কীভাবে গ্রহণ করবে এখন সম্ভবত তার ছক কষা চলছে। এর মধ্যেই জনসংখ্যারর দিক থেকে এগিয়ে থাকা ভারতও একটি বড় শক্তি হিসেবে মাথা তোলার আয়োজনে আছে। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত যদি রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকে সমান প্রশ্রয় পায় তাহলে খেলা জমে যেতে পারে।
এই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বিশ্ব দখলের রাজনীতিতে কোন শক্তি, কীভাবে, কোন দেশের সহযোগিতায় এগিয়ে থাকবে, তা এখনই হয়তো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে বিশ্বরাজনীতির নতুন মেরুকরণ শুরু হওয়ার আলামত স্পষ্ট হচ্ছে। কোন দেশ, কোন স্বার্থে চীনপন্থি, রাশিয়াপন্থি কিংবা আমেরিকাপন্থি হবে, কেউ আবার নতুন প্রেক্ষাপটে জোট নিরপেক্ষ বলয় তৈরিতে এগিয়ে আসবে কি না – এসবই এখন দেখার বিষয়। কোনো একটি ঘটনা দেখে উল্লসিত কিংবা বিষাদগ্রস্ত হওয়ার কারণ নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম