ঈদ যেন আনন্দ আনে, ভোগান্তি নয়
মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুটি- ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আজহা। বাংলাদেশের মুসলমানদের কাছে এই দুই ঈদের দুটি নাম- একটি রোজার ঈদ আরেকটি কোরবানির ঈদ। দুই ঈদেই বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে আনন্দের বান ডাকে। একমাস সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ আসে বাঁধভাঙা আনন্দ নিয়ে। তবে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদের আনন্দ অন্যরকম। কারণ এই ঈদের মূল অনুষঙ্গ হলো আল্লাহর নামে পশু কোরবানি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রিয় জিনিস কোরবানির যে মহিমা, তা ঈদের আনন্দে যোগ করে নতুন মাত্রা।
তবে বাংলাদেশে ঈদ এলেই আমার ভয় লাগে। ঈদের সাথে আসে ভোগান্তি। তিন দশক ধরেই আমাদের পুরো পরিবার ঢাকাবাসী। তাই ঈদে আমাদের বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া নেই। কিন্তু নিউজরুমে বসে ঈদে মানুষের বাড়ি ফেরার ভোগান্তি দেখি আর আফসোস করি, হায় নির্বিঘ্নে ঈদের আনন্দ করার অধিকারও বুঝি আমাদের নেই। ঈদে বাড়ি ফেরার যে দুর্ভোগ, তা কিন্তু হঠাৎ করে বা এক-দুদিনের নয়। বছরের পর বছর একই দুর্ভোগের পুনরাবৃত্তি হয়। কিন্তু কারও যেন কিছু যায় আসে না।
বাংলাদেশ ছোট একটি দেশ। জনসংখ্যার চাপে ন্যুব্জ এই দেশটিকে আরও অসুস্থ মনে হয়, কারণ বাংলাদেশের সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, পড়াশোনা, প্রশাসন- সবকিছু ঢাকাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। ফলে মানুষ সুযোগের অপেক্ষায়, ভাগ্য বদলানোর আশায় ছুটে আসেন ঢাকায়। ঢাকায় বাস করে দুই কোটিরও বেশি মানুষ। আমার অফিস কারওয়ান বাজারে। মধ্যরাতে কারওয়ান বাজারে যত মানুষ আসে পৃথিবীর অনেক দেশের মোট জনসংখ্যা তারচেয়ে কম। কাজের খোঁজে, ভাগ্য বদলাতে ঢাকায় ছুটে আসা মানুষের শেকড় থাকে গ্রামে, যেখানে তাদের নাড়ি পোঁতা। তাই সুযোগ পেলেই তারা ফিরে যেতে চান গ্রামে।
বিশেষ করে ঈদের আনন্দটা তারা ভাগ করে নিতে চান প্রিয়জনের সঙ্গে। কিন্তু এই আনন্দটুকু পেতে আমাদের যে লম্বা দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তার দাম অনেক বেশি। গত ২-৩ দিন যারা কমলাপুরের দিকে গেছেন, তারা জানেন বাড়ি ফেরার আনন্দের মূল্য আসলে কত। অনলাইনে ট্রেনের টিকিট পাওয়া আর লটারির টিকিট পাওয়া সমান কথা।
মন্ত্রী জানেন, অনলাইনে সাধারণ মানুষ টিকিট পায় না। কিন্তু এই সমস্যা সমাধানের কোনো চেষ্টা বা উদ্যোগ নেই। অনলাইনে টিকিট পাবেন না জেনে যারা স্টেশনে ছুটে আসেন, তাদের দুঃখ চোখে দেখা যায় না। ৩০ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও টিকিট না পাওয়ার বেদনা নিয়ে যে ভাইটি ফিরে যান, তার দুঃখ বোঝার মতো মন কি আছে আমাদের রেলমন্ত্রীর।
আগাম টিকিটের কারণে ট্রেনের ভোগান্তিটা একটু আগে শুরু হয় বটে, কিন্তু পরিবহনের অন্য মাধ্যমগুলোও দুর্ভোগের লম্বা উপায় নিয়ে অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগে গত কয়েক বছরে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। তারপরও মানুষের পছন্দের শেষ তালিকায় থাকে বাস। ট্রেনের টিকিট না পেলেই সবাই বাসের দিকে ছোটেন। ততদিনে বাসের টিকিট সোনার হরিণ। বাড়তি ভাড়া আদায় তো আছেই, বাড়ি ফিরতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকতে হয়।
আমরা রাস্তা বানিয়েছি বটে, কিন্তু নিজেদের রাস্তার মানে তুলতে পারিনি। তাই তো কে কার আগে যাবে, এই প্রতিযোগিতায় সবাই রাস্তায় বসে থাকি। বড় বড় মহাসড়কে উল্টো দিক থেকে রিকশা, টমটমের আসাটা ঠেকানো যায়নি কিছুতেই। মহাসড়কগুলোতে যেন ঈদের সময় মৃত্যুর উৎসব হয়। প্রতিবার ঈদে কত পরিবারের আনন্দ যে সারাজীবনের জন্য ফুরিয়ে যায়, আমরা সব গল্প জানিও না।
পদ্মা সেতু চালু হয়ে যায়, এবার লঞ্চের ওপর চাপটা একটু কম পড়বে বলেই আশা করা যাচ্ছে। তবে যে পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের এত স্বপ্ন, এত আবেগ; সেই পদ্মা সেতু নিয়ে এখনই শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। পদ্মা সেতু আর এক্সপ্রেসওয়ে মিলে দফায় দফায় টোল দিতে গিয়ে বারবার আটকে যাচ্ছে গতি। ১ জুলাই থেকে এক্সপ্রেসওয়ের টোল চালুর পর ৬ মিনিটের পদ্মা সেতু পার হওয়ার স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে যাচ্ছে। এত ভালো রাস্তা, এত চমৎকার সেতু; টোলেই যদি কেটে যায় সময়, এক্সপ্রেসওয়ের দুই প্রান্তেই যদি বসে থাকতে হয়; তাহলে আর লাভ কি হলো।
পরিবহনের এ সমস্যাগুলো আমরা জানি, আমাদের মন্ত্রীরা জানেন। দুর্ভোগ বেশি হলে তারা ভদ্রতা করে একটু সরিও বলেন। কিন্তু সমাধান করেন না। তারা জানেন, বছরে দুবার এই ভোগান্তি মানুষ মনে রাখবে না। তাই ঈদযাত্রার সমস্যা সমাধানে তাদের কোনো চেষ্টা নেই। আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়ে বসে থাকেন।
একসময় বাংলাদেশে ঈদুল আজহার সময় ভারত থেকে গরু আসতো। কিন্তু ভারত পশু আসার ব্যবস্থা বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশে সংকট সৃষ্টি হয়। কিন্তু সমস্যাই সমাধানের পথ বাতলে দেয়। বাংলাদেশের খামারিরা, উদ্যোক্তারা দ্রুতই এই সমস্যাকে সম্ভাবনায় বদলে দিলেন। বাংলাদেশে এখন পর্যাপ্ত পশু কোরবানির জন্য তৈরি থাকে। তবে পশুর হাট, পশু পরিবহন নিয়ে নানারকম সমস্যা থাকে।
বিশেষ করে এবার দেশের বেশ কয়েকটি জেলা এখনও বন্যাকবলিত। কয়েকটি জেলা বন্যা-পারবর্তী সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। বন্যাকবলিকত জেলাগুলোয় গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মানুষ। নিজেদের খাওয়ারই যেখানে নিশ্চয়তা নেই, সেখানে গবাদিপশুকে বাঁচিয়ে রাখাই মুশকিল। কোরবানির হাটে ভালো দাম পাওয়ার আশায় রাখা পশু অনেকেই কম দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
কোরবানির ঈদের সাথে জড়িয়ে আছে চামড়া শিল্পও। বাংলাদেশের চামড়ার চাহিদার সিংহভাগই মেটে কোরবানির ঈদে। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই চামড়া শিল্পে ভয়ঙ্কর দুর্দিন চলছে। অথচ চামড়া আমাদের অন্যতম রপ্তানি পণ্য। সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলে চামড়া শিল্প হতে পারে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম বড় উৎস।
ঈদ আসে আনন্দ নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশে ঈদ যেন আসে ভোগান্তি নিয়ে। তবে সরকার আন্তরিকভাবে চাইলে এই দুর্ভোগের অনেকটাই লাঘব করতে পারে। এটুকুই শুধু আমাদের প্রত্যাশা। ঈদ যেন শুধু আনন্দই নিয়ে আসে, দুর্ভোগ নয়।
৩ জুলাই, ২০২২
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম