চীনের দশম সৌরপদে রীতিনীতির বৈচিত্র্য ও অরোরা প্রসঙ্গ
Aurora (অরোরা) শব্দটি ল্যাটিন; অর্থ ‘ঊষা’ বা ভোর। আবার একজন রোমান দেবীর নামও ছিল অরোরা। তিনি ছিলেন ঊষাদেবী বা ভোরের দেবী। কথিত আছে, এই দেবী প্রতিদিন পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত ভ্রমণ করতেন এবং মর্ত্যবাসীকে সূর্যের আগমনী বার্তা শোনাতেন।
ইংরেজিতে এখনও ‘অরোরা’ শব্দটিকে ঊষা বা ভোর অর্থে ব্যবহার করা হয়। তবে, এ শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয় আকাশে দৃশ্যমান একধরনের বিশেষ প্রাকৃতিক আলোকচ্ছটাকে বোঝাতে। বাংলায় এই অসাধারণ সুন্দর আলোকচ্ছটাকে বলে ‘মেরুপ্রভা’ বা ‘মেরুজ্যোতি’। প্রাচীনকালের কোনো কোনো উপকথায় এই মেরুপ্রভা-কে বলা হয়েছে ‘ঈশ্বরের সেতু’।
আবার কোনো কোনো অঞ্চলের মানুষ বিশ্বাস করতেন যে, তাদের পূর্বপুরুষরা আকাশে নৃত্য করেন বলেই আকাশের রঙ বদলে যায়, সৃষ্টি হয় রঙিন আলোকচ্ছটার। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান বলে, সূর্যের বিভিন্ন কণার সাথে আমাদের পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র ও বায়ুমন্ডলের বিভিন্ন গ্যাসের ঘর্ষণের ফলে সৃষ্টি হয় অরোরা বা মেরুপ্রভা। বিজ্ঞানীরা আরও বলছেন, মেরুপ্রভার সবুজ রঙের জন্য দায়ী বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন এবং লাল ও নীল রঙের জন্য দায়ী নাইট্রোজেন।
অরোরা সম্পর্কে লিখিত যত ইতিহাস পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরাতনটি হচ্ছে একটি চীনা উপকথা। এই উপকথা লেখা হয়েছিল যীশু খ্রিস্টের জন্মের ২৬০০ বছর আগে। উপকথায় বলা হয়েছে: (যীশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ২০০০ বছর আগে) এক শরৎকালে, ফুপাও (Fubao) নামের এক তরুণী একটি জলাভূমির কাছে একাকী বসে ছিল। তখন সে হঠাৎ আকাশে আশ্চর্যজনক, সুন্দর, ও চলমান আলোকচ্ছটা দেখতে পায়। এই স্বর্গীয় আলোকচ্ছটার প্রভাবে ফুপাও গর্ভবতী হয় এবং পরে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়। তাঁর এই পুত্রই পরে সম্রাট সুয়ানইয়ুয়ান (Xuanyuan) হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। উপকথা অনুসারে, এই সম্রাটই চীনা সংস্কৃতির স্রষ্টা ও আধুনিক চীনাদের আদিপুরুষ।
প্রাচীন চীনা ধ্রুপদি গ্রন্থ শানহাইচিং (Shanhaijing)-এও অরোরা সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যীশু খ্রিস্টের জন্মের ৪০০ বছর আগে এই গ্রন্থটি রচিত বলে ধারণা করা হয়। এতে শত শত পর্বত এবং নদী-নালার বর্ণনা আছে; আছে বহু আশ্চর্যজনক পশু-পাখির কথাও। তেমন একটি বিচিত্র পশুর নাম ‘শিলুং’ (Shilong)। গ্রন্থে বলা হয়েছে, এটি একটি লাল ড্রাগন যা রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করে এবং এর দেহ হাজার মাইল দীর্ঘ। বলা বাহুল্য, প্রাচীন চীনে মেরুপ্রভা বা অরোরা বোঝাতে কোনো নির্দিষ্ট শব্দ ছিল না, বিভিন্ন আকৃতির অরোরা-কে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হতো। তেমন কয়েকটি নাম হচ্ছে: থিয়েনকৌ (আকাশ কুকুর), তাওসিং (তরবারি তারকা), ছিঅওছি (ছিঅও ব্যানার), থিয়েন খাইইয়ান (আকাশের খোলা চোখ), সিং ইয়ুন রু ইয়ু (বৃষ্টির মতো তারার পতন), ইত্যাদি।
সাধারণত উঁচু অক্ষাংশের এলাকাগুলোতে আরোরা বা মেরুপ্রভা দেখা যায়। অরোরা-কে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা হয়: অরোরা অস্ট্রেলিস (aurora australis) এবং অরোরা বোরিআলিস (aurora borealis)। প্রথম ধরনের অরোরা দেখা যায় মূলত অ্যান্টার্কটিকা, চিলি, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউ জিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায়। আর দ্বিতীয় ধরনের অরোরা দেখা যায় আলাস্কা, কানাডা, আইসল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও রাশিয়ায়।
চীনেও অরোরা বা মেরুপ্রভা দেখা যায়। তবে, অসাধারণ সুন্দর মেরুপ্রভা দেখতে হলে আপনাকে চীনে আসতে হবে দশম সৌরপদে। অনেকেই জানেন, চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে বছরকে ভাগ করা হয় ২৪টি সৌরপদ (solar terms)-এ। প্রাচীন চীনে হলুদ নদীর অববাহিকায় এই ২৪ সৌরপদের উৎপত্তি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই ২৪ সৌরপদ ‘চীনের পঞ্চম মহান আবিষ্কার’ (Fifth Great Invention of China) হিসেবে স্বীকৃত। ইউনেস্কোও একে মানবজাতির অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রতিটি সৌরপদের আছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য।
চীনে হাজার হাজার বছর আগে এই সৌরপদ-ব্যবস্থার উৎপত্তি। প্রাচীনকাল থেকেই চীনারা সৌরপদ অনুসারে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কৃষিকাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছে। বছরের কোন সৌরপদে আবহাওয়া কেমন থাকবে— তা নামগুলো দেখলেই বোঝা যায়। সৌরপদ অনুসারে চীনারা তাদের খাওয়া-দাওয়ায়ও পরিবর্তন আনে, পরিবর্তন আনে পোশাক-আশাকে। এখন চলছে চীনের দশম সৌরপদ। এ সৌরপদের নাম ‘সিয়াচি’; বাংলায় আমরা বলতে পারি ‘উত্তরায়ণ’। ইংরেজিতে একে ডাকা হয় Summer Solstice। এ সৌরপদের ব্যাপ্তিকাল ২১শে জুন থেকে ৬ জুলাই পর্যন্ত।
দশম সৌরপদের প্রথম দিন বছরের দীর্ঘতম দিন। উত্তর গোলার্ধে এদিন বছরের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সূর্যালোক পাওয়া যায়। পরের দিন থেকে দিন ক্রমশ ছোট হতে থাকে এবং তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে। উত্তরায়ণের প্রথম দিন সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সূর্যালোক পাওয়া গেলেও, এসময় সবচেয়ে বেশি গরম পরে না; সর্বোচ্চ গরমের জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও ২০ থেকে ৩০ দিন।
চীনের সবচেয়ে বড় দিন কতোক্ষণ স্থায়ী হয়? প্রায় ১৭ ঘন্টা। চীনের দীর্ঘতম দিনের সঙ্গে পরিচিত হতে আপনাকে যেতে হবে দেশটির হেইলুংচিয়াং প্রদেশের ‘মো হ্য’ (Mohe) শহরে। জায়গাটি চীনের সর্বউত্তরে অবস্থিত। বছরের দীর্ঘতম দিনটি এখানে দেখা যায় বলে একে অনেকে ডাকেন ‘চীনের নিন্দ্রাহীন শহর’ বলে। এই ‘নিন্দ্রাহীন’ শহরেই চীনের সবচেয়ে সুন্দর অরোরা বা মেরুপ্রভারও দেখা পাবেন। আর মেরুপ্রভা দেখার জন্য সবচেয়ে উত্তম সময় হচ্ছে সিয়াচি (Xiazhi) সৌরপদ।
প্রাচীন চীনে সিয়াচি’র প্রথম দিনে সরকারি ছুটি থাকতো; দিনটি পালিত হতো গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হিসেবে। হান রাজবংশ আমলেও (খ্রিস্টের জন্মের আড়াই শ বছর আগে) সিয়াচি উত্সব ছিল মধ্য-শরৎ উৎসব ও ছুং ইয়াং উৎসবের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছিং রাজবংশ আমলের (১৬৪৪-১৯১১) আগ পর্যন্তও সিয়াচি-তে একদিনের সরকারি ছুটি থাকতো।
সুং রাজবংশ আমলের (৯৬০-১২৭৯) রেকর্ড অনুসারে, সিয়াচি সৌরপদে সরকারি কর্মকর্তারা তিন দিনের ছুটি নিতে পারতেন। তখন সিয়াচি উৎসব পালন উপলক্ষ্যে নারীরা একে অপরকে রঙিন হাতপাখা ও সুগন্ধিচূর্ণযুক্ত থলে উপহার দিত। হাতপাখা ব্যবহার করা হতো গা শীতল করার জন্য এবং সুগন্ধিচূর্ণযুক্ত থলে ব্যবহার করা হতো মশা তাড়াতে ও গায়ে সুগন্ধির আমেজ আনতে।
চীনের ইয়ুননান প্রদেশ বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছে অবস্থিত। দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের এই প্রদেশটির মোচিয়াং কাউন্টি হানি জাতি-অধ্যুষিত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। এই অঞ্চলটি উত্তর অয়নবৃত্তে (northern tropic) অবস্থিত। আর, প্রতিবছর সিয়াচি সৌরপদের প্রথম দিনে সূর্য কর্কটক্রান্তির (Tropic of Cancer) ঠিক উপরে অবস্থান করে। এর পর থেকেই সূর্য ক্রমশ উত্তর থেকে দক্ষিণে সরতে থাকে। এ সময়টা মোচিয়াংয়ের হানি মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ জাতির মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই সূর্যের পূজা করে আসছে। সিয়াচি সৌরপদে তাঁরা সূর্যের বিশেষ পূজা করে থাকে।
চীনের শানতুং প্রদেশে একটি কথা প্রচলিত আছে: মকরক্রান্তি বা দক্ষিণায়ণে ডাম্পলিং খাও এবং কর্কটক্রান্তি বা উত্তরায়ণে খাও নুডলস। সিয়াচি-তে শানতুংয়ের বিভিন্ন এলাকার মানুষ ঠাণ্ডা নুডলস খায়। বেইজিংসহ চীনের অন্যান্য অঞ্চলেও এ সময় বিশেষভাবে নুডলস খাওয়ার রীতি প্রচলিত আছে।
চীনে চান্দ্রপঞ্জিকার পঞ্চম মাসের পঞ্চম দিনে ড্রাগন নৌকা উৎসব পালিত হয়। তবে, চীনের চ্যচিয়াং প্রদেশের শাওসিং-এ ড্রাগন নৌকা উৎসব পালিত হয় দশম সৌরপদে। মিং রাজবংশ আমল (১৩৬৮-১৬৪৪) ও ছিং রাজবংশ আমল (১৬৪৪-১৯১১) থেকেই এটা চলে আসছে। তবে, ড্রাগন নৌকা উত্সবের বৈশিষ্ট্য ও আমেজ পুরোপুরিই পাওয়া যায় এতে। স্থানীয় বিশেষ জলবায়ুর কারণেই সিয়াচি-তে শাওসিং-এর বাসিন্দারা ড্রাগন নৌকা উৎসব পালন করে থাকে বলে জানা গেছে।
চীনের একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ বা লোকোক্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সিয়াচি সৌরপদের নাম। এসম্পর্কিত একটি গল্প বলে আজকের লেখার ইতি টানব। গল্পটি পাওয়া যাবে ‘ফ্যংসুথং’ (Fengsutong) নামক একটি গ্রন্থে। এতে চীনের বিভিন্ন প্রথা ও রীতিনীতির বর্ণনা আছে। গ্রন্থটি রচনা করেন পূর্বাঞ্চলীয় হান রাজবংশ আমলের (২৫-২২০) ঈং শাও (Ying Shao)। তো, গল্পটি এমন: একবার তুসুয়ান নামের এক ব্যক্তি সিয়াচি সৌরপদ উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক ভোজে অংশ নেন। তাঁর চায়ের কাপে দেয়ালে ঝুলানো একটি ধনুকের ছায়া পড়ে।
তিনি ছায়াটিকে মনে করেন সাপ এবং ভয়ে ভয়ে সেই চা পান করেন। ভোজের পর তিনি বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন। অনেক ডাক্তার-কবরেজ দেখিয়েও তাঁর ব্যথার উপশম হলো না। শেষ পর্যন্ত যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, কাপে সাপ পড়েনি, বরং ধনুকের ছায়া পড়েছিল, তখন তিনি সুস্থ হলেন। এই ঘটনার পর থেকে সন্দেহপ্রবণ ও ভীত লোকদের সম্পর্কে যে-লোকোক্তিটি চালু হয়ে যায়, সেটি হচ্ছে: ‘পেইকুংশ্যঈন’ (Beigongsheying), যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়াবে ‘অতি সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তি’।
লেখক: বার্তাসম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি), বেইজিং।
[email protected]
এইচআর/এমএস