ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

প্রজাপতির ছন্দ তুলে নায়িকা প্রবেশ করলেন

মোকাম্মেল হোসেন | প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ২৪ জুন ২০২২

 

আলো ঝলমল রূপালি জগতে যারা বিচরণ করেন, তাদের কাজকর্ম স্বচক্ষে অবলোকন করার বাসনা দীর্ঘদিনের। সহকর্মী সিনে-সাংবাদিকের শরণাপন্ন হলাম। সে বলল-
: আরে ভাই! এইটা কোনো ব্যাপারই না; আমি ব্যবস্থা করতেছি।

তার দেওয়া পাস হাতে এফডিসিতে ঢুকে দেখি, একটা ফ্লোরে শুটিংয়ের প্রস্তুতি চলছে। বাংলাদেশের নবীন-প্রবীণ প্রায় সব নায়ক-নায়িকার নাম-চেহারা আমার মুখস্থ। এখানে তাদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। তথ্য পেলাম, যে সিনেমার শুটিং হওয়ার কথা, তার প্রযোজক উপস্থিত রয়েছেন। একজনের সহযোগিতায় তাকে চিহ্নিত করার পর সামনে গিয়ে বললাম-

: ভাই, শুনলাম, আপনে এই ছবির পরিচালক।
মাঝিরা নদীর বুকে লগি ফেলে যেভাবে জলের গভীরতা পরিমাপ করে, পরিচালক সাহেব ঠিক সেভাবে আমাকে মাপজোক করছেন। ভদ্রলোকের চাহনি ও ভাবসাব দেখে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। কোনো বেয়াদবি হয়নি তো! তাচ্ছিল্যের সুরে তিনি বললেন-

: শুনলাম মানে কী? চেহারা দেইখ্যা বুঝবার পারেন না, কে প্রোডাকশন ম্যানাজার, আর কে ডিরেক্টর? এই অবজারভেশন পাওয়ার লইয়া সাংবাদিক হইছেন? চন্দ্র আর সূর্যের তফাৎ যদি চক্ষের পলকে ক্যাচ করতে না পারেন, তাইলে এই লাইনে শাইন করবেন কেমনে! ডোন্ট মাইন্ড, আপনের ভালোর জন্যই বললাম।

: না-না, আমি কিছু মনে করি নাই। আইচ্ছা ভাই! আপনের ছবির ক্যামেরাম্যানরে দেখতেছি না!
: দেখবেন কেমনে! সে একটা টিভি চ্যানেলে গেছে।
: ওইখানে কী?
: ওই টিভি চ্যানেলের জন্য সে যে মেগা সিরিয়াল বানাইছে; সেইটার এডিটিং দেখবার গেছে।
: নায়ক-নায়িকা?

: আর বইলেন না! এদের লইয়া মহাঝামেলায় আছি। নায়িকা কিছুক্ষণ আগে ফোন কইরা জানাইছে, তার এক্স হাজবেন্ড তারে কিডন্যাপ করার হুমকি দিছে। পুলিশ না পাঠাইলে সে শুটিংয়ে আসতে পারবে না। আর নায়ক গেছে একটা পাঞ্জাবির দোকান উদ্বোধন করতে।
: আইচ্ছা, জনশ্রুতি আছে, আপনে আগে সীমান্তে ডিজেল চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পুলিশ আপনার বিরুদ্ধে তৎপর হওয়ার পর সিনেমার লাইনে আসছেন?

: সত্য কথা। তবে তার চাইতেও বড় সত্য হইল, আমি ডিজেল পাচারকারী ছিলাম বইলাই ইন্ডাস্ট্রি আমার মতো একজন পরিচালক পাইছে। আমি কাঁচাবাজারে আলু-পটলের ব্যবসা রাইখ্যা ফিল্ম লাইনে আসি নাই। যে কয়টা ছবি রিলিজ দিছি, সবগুলাই সুপার-ডুপারহিট।

: কিন্তু আপনের ছবিগুলো সম্পর্কে তো নকলের অভিযোগ আছে!
: আপনের এই কথাটা আমি মানতে পারলাম না। বিভিন্ন দেশের ছবি দেইখ্যা অভিজ্ঞ হওয়ার পর আমার ইন্টেলেকচুয়্যালিটির জোরে অনুধাবন করছি- কী করা দরকার? এরপর যথাযথ ফর্মুলা প্রয়োগ কইরা সেইভাবে ছবি মেইক করছি।
এসময় হন্তদন্ত হয়ে এক ভদ্রলোক সেটে প্রবেশ করলেন। জিজ্ঞেস করে জানলাম, তিনি ছবির প্রযোজক। নায়ক-নায়িকা না আসার খবর পেয়ে প্রযোজক ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন। দেখলাম, এই সুযোগ। তার সামনে গিয়ে বললাম-
: হিরো-হিরোইন আসার আগে আপনের সঙ্গে একটু কথা বলি?
: কথা আর কী কমুরে ভাই। সেটে ঢুইক্যাই মন-মেজাজ খিঁচা মারছে। বলেন, কী জানতে চান?
: আপনের বর্তমান ছবির কাহিনি...
: এক মিনিট, এক মিনিট! বর্তমানে আমার আন্ডারে ৯টা ছবির শুটিং চলতেছে। কাজেই বর্তমান বললে পাবলিক কনফিউজড হইতে পারে। বলেন, এই ছবির...
: এই ছবির কাহিনি কিসের ওপর ভিত্তি কইরা গইড়া উঠছে?
: আমার এই ছবিটার কাহিনি প্রাচীন একটা লোকগাথার ওপর ভিত্তি কইরা গইড়া উঠছে। তবে লোকগাথা হইলেও ছবিতে সবকিছুর সমন্বয় ঘটানো হবে।
: কী রকম?

: যেমন পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক সংঘাত, অর্থনৈতিক অভিঘাত, রাজনৈতিক কষাঘাত ইত্যাদির সঙ্গে এই ছবিতে থাকবে স্বর্গীয় প্রেম, কলিজা ঠান্ডা করা ভায়োলেন্স, শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান ইত্যাদি। আপনের মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতাদের আগাম জানাইয়া দিতে চাই- অভিযানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই প্রথম ফাইটার প্লেন ও সাবমেরিনের অ্যাকশন দেখানো হবে।
: লোকগাথাভিত্তিক ছবিতে ফাইটার প্লেন ও সাবমেরিন?

: সমস্যা কী? সবকিছু হইল সমন্বয়ের ব্যাপার। মিলনের সঙ্গে বিরহের। হাসির সঙ্গে কান্নার। আগুনের সঙ্গে পানির। জন্মের সঙ্গে মৃত্যুর। তলোয়ারের সঙ্গে মিসাইলের। ঘোড়ার সঙ্গে ফাইটার প্লেনের। কলার ভেলার সঙ্গে সাবমেরিনের। মাথায় যদি মসলা থাকে, তাইলে প্রাচীনের সঙ্গে আধুনিকতার সমন্বয় ঘটাইয়া যে কোনো ঘটনারে অনিবার্য পরিণতির দিকে ঠেইল্যা দেওয়া কোনো ব্যাপার নয়।

: শুনলাম, আপনে টেলিভিশনের জন্য সিরিয়াল নির্মাণ করছেন! ওইখানেও কি সমন্বয়টা এভাবেই ঘটাইছেন?
: কী ঘটাইছি, সেইটা মুখে বলতে চাই না। টিভি সেটের সামনে বসেন, সিরিয়াল দেখেন; তাইলেই বুঝতে পারবেন কী ঘটছে, আর কী ঘটে নাই!
হঠাৎ নায়কের আগমন ঘটল। পরিচালক সরোষে বলে উঠলেন-
: এতক্ষণে তোমার আসার টাইম হইল? এইভাবে চলতে থাকলে তো প্রোডাকশন বন্ধ কইরা পান-বিড়ির দোকান দেওন লাগব!
: স্যরি সেন্টু ভাই। অটোগ্রাফ শিকারিদের পাল্লায় পইড়া দেরি হইয়া গেল। পাবলিক যে আমার ব্যাপারে কী পরিমাণ ক্রেজ, সেইটা বাইরে গেলে বোঝা যায়!
নায়কের কথা শুনে বললাম-

: ভাই, কিছু মনে না করলে আমি একটা কথা বলতে চাই।
: কী কথা!
: আপনের অভিনীত ছবিগুলোর দর্শকপ্রিয়তা কিন্তু আপনের কথার বিপরীত চিত্র তুইল্যা ধরে!
: এতেই কি প্রমাণ হইয়া গেল, নায়ক হিসেবে আমি জনপ্রিয় নই? ছবি ফ্লপ করার হাজারটা কারণ থাকে। আমি মনে করি, আমার মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা আছে, তা ইন্ডাস্ট্রির কেউ কাজে লাগাইতে পারতেছে না।

নায়কের কথা শুনে পরিচালক ক্ষেপে গেলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-

: জাবিল, তোমার এই মন্তব্যের মধ্যে যদি আমি পইড়া যাই, তাইলে সেইটা হবে সিনেমার ইতিহাসে সবচাইতে হৃদয়বিদারক ঘটনা। পরশ পাথরের স্পর্শে লোহা যেমন সোনা হইয়া ওঠে, তেমনি আমার সংস্পর্শে আসার পর নায়ক-নায়িকারা পাকা অভিনেতা-অভিনেত্রী হইয়া ওঠে। একমাত্র আমিই ভুঁড়িওয়ালা ভিলেনকে নায়ক আর এক্সট্রা গার্লকে নায়িকা বানানোর মাধ্যমে তাদের অভিনয় প্রতিভার স্ফুরণ ঘটাইছি, যা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা।

এসময় প্রজাপতির ন্যায় ছন্দ তুলে উড়তে উড়তে সেটে নায়িকা প্রবেশ করলেন। কৈফিয়ত দেওয়ার সুরে পরিচালকের উদ্দেশে তিনি বললেন-
: ওফ! সেন্টু ভাই, ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম লাইফটারে কয়লা বানাইয়া ফেলছে। ওইদিনের মতো আইজকাও ভয়াবহ জ্যামে পড়ছিলাম। তাই আসতে দেরি হইল।
নায়িকার কথা শুনে মৃদুস্বরে বললাম-
: কিন্তু ম্যাডাম, আমরা তো শুনলাম আপনার সাবেক স্বামী...
: ওহ গড! কে এই লোক? আমারে অবান্তর প্রশ্ন করতেছে!
আমার দিকে কঠিন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নায়িকা বললেন-
: আপনেরে এই কথা কে বলছে! বলেন, কে বলছে?
: পরিচালক।
: তাই! আসলে আমার এই বিষয়টা লইয়া সবার মধ্যে একটা ভ্রান্ত ধারণা রইয়া গেছে। ঘটনা হইল, আমার বয়স যখন খুবই অল্প, তখন ওই লোকটার সঙ্গে আমার এনগেজমেন্ট হইছিল। ব্যাস, এইটুকুই, আর কিছু না।

: কিন্তু সে তো বলে, আপনেরা একত্রে অনেকদিন ঘর-সংসার করছেন!
: আপনে কি সাংবাদিক? ও মাই গড! সেন্টু ভাই, আমরা কি এইখানে শুটিং করতে আসছি, না প্রেস কনফারেন্স করতে আসছি?
পরিচালক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। অনুরোধ জানিয়ে আমাকে বললেন-
: ভাই, আইজকার মতো রিলিজ দেন। পরে একদিন অবসর টাইমে আসেন। কথা কমুনে...

লেখক: সাংবাদিক, রম্যলেখক।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/এমএস