ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বন্যা ও করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ

ড. প্রণব কুমার পান্ডে | প্রকাশিত: ০৯:৫৬ এএম, ২৪ জুন ২০২২

গত এক সপ্তাহের উপরের সময় ধরে সিলেট বিভাগের সিলেট এবং সুনামগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় মানুষের জীবনে নেমে এসেছে ঘোর অমানিশা। ভারতের চেরাপুঞ্জিতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় এবং সিলেট ও তৎসংলগ্ন পার্শ্ববর্তী এলাকায় অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি বৃষ্টি হওয়ার কারণে বন্যা পরিস্থিতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।

এই দুই জেলার বেশিরভাগ অঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে জনগণের চলাচলের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। প্রথম দিকে মানুষের প্রাণহানির ঘটনা তেমন না ঘটলেও, গত দু-তিনদিনে বেশ কয়েকটি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, যা সত্যিই কাম্য নয়।

বেশিরভাগ বাড়িঘর জলের তলায় তলিয়ে গেছে বিধায় মানুষের খাবারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বন্যার্ত মানুষকে উদ্ধারের জন্য সরকারের তরফ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পরিস্থিতির গভীরতা বিবেচনা করে সরকার জনগণকে উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিজেদের দক্ষতা এবং যোগ্যতা দিয়ে বন্যার্ত মানুষের সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের নিরলস প্রচেষ্টায় বন্যার্ত মানুষকে সহায়তা করার সব ধরনের কার্যক্রম চালু রয়েছে। একই সাথে বেসরকারি প্রশাসন সব সময় প্রস্তুত রয়েছে বন্যার্ত মানুষদের সহায়তার জন্য।

তবে, এ ধরনের পরিস্থিতি কখনোই কাঙ্ক্ষিত ছিল না বিধায় পরিস্থিতি মোকাবিলা করা অনেকটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্যার আকস্মিকতায় প্রশাসনসহ জনগণের মধ্যে অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বন্যায় মানুষের চলাচল এবং জীবিকা নির্বাহ কঠিন হওয়ার সাথে সাথে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যা পরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে খাদ্য চাহিদার ওপর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি ইতোমধ্যে বন্যার্ত মানুষদের অবস্থা দেখার উদ্দেশ্যে সিলেট ভ্রমণ করেছেন।

সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বেসরকারি উদ্যোগ বন্যার্ত মানুষের সাহায্য করছে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনসহ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বন্যার্ত মানুষের সাহায্য করার জন্য। একই সাথে সিলেট এবং সিলেট অঞ্চলের বাইরে ব্যক্তি উদ্যোগে মানুষ বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছে। এ যেন এক মানবিক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি আমরা আবার প্রত্যক্ষ করেছি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার মতো। যার যার জায়গা থেকে সবাই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বন্যার্ত মানুষদের সাহায্য করার জন্য।

বর্তমানে দুটি ঘটনা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। একটি হচ্ছে ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন, যার জন্য গোটা দেশ আনন্দে উদ্বেলিত। ঠিক একইভাবে সিলেট এবং সুনামগঞ্জ অঞ্চলে বন্যার্ত মানুষদের দুর্বিষহ অবস্থা বাংলাদেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। এই দুটি সাথে সাথে যুক্ত হয়েছে করোনার ঊর্ধ্বগতি।

আমি যখন আজ লেখাটি লিখছি তখন অর্থাৎ ২২ জুন বাংলাদেশের করোনার শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। গত পাঁচ মাসের মধ্যে আজই প্রথম শনাক্তের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে। গত দুদিনে একজন করে মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। আজ সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান মৃত্যুবরণ করেছেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে।

শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ঢাকায় রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রায় ৮০ শতাংশ রোগী ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার। এই ধরনের চিত্র আমরা আগেও লক্ষ্য করেছি। সংক্রমণ প্রথম শুরু হয় ঢাকায় এবং তার পরে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের সব অঞ্চলে। সিলেটের বন্যা এবং পদ্মা সেতুর উদ্বোধন এর মাঝে এ খবরটি তেমন গুরুত্বের সাথে বিবেচনা না হলেও জনগণের মধ্যে কিছুটা হলেও আতঙ্কের সৃষ্টি করছে।

ইতোমধ্যে আমরা চীন এবং উত্তর কোরিয়ায় করোনা পরিস্থিতি খারাপ হতে দেখেছি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের করোনা পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। পাশাপাশি পাকিস্তান এবং ভারতের কয়েকটি প্রদেশে করোনার ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে। ফলে এটি খুবই স্বাভাবিক যে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে করোনা পরিস্থিতি খারাপ হলে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি খারাপ হবে। কারণ বিপুল সংখ্যক মানুষ বিভিন্ন কারণে ভারত ভ্রমণ করতে যায়।

তবে করোনা পরিস্থিতির ঊর্ধ্বগতির মূল কারণ সাধারণ মানুষের করোনা বিষয়ে উদাসীনতা। গত ফেব্রুয়ারির পরে করোনা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে এলে মানুষের মধ্যে এক ধরনের উৎফুল্লতা পরিলক্ষিত হয়। গত দুই বছরের করোনার ভয়াল থাবা থেকে বের হয়ে মানুষ স্বাভাবিক জীবনে বসবাস শুরু করে। কিন্তু সেই বসবাসকালীন সময়ে করোনা সুরক্ষা বিধি একেবারেই মেনে চলছে না বেশিরভাগ মানুষ। ফলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে করোনা পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে।

মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১ শতাংশ থেকে ১৩ শতাংশ নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। আমাদের সবার মাথায় রাখতে হবে যে, আগামী জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কোরবানির ঈদ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সেই সময় বিপুল সংখ্যক মানুষ ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায় পরিবারের সঙ্গে ঈদ করার জন্য। ফলে শনাক্তের হার একই হারে চলতে থাকে এবং ঈদের সময় যদি বিপুল সংখ্যক মানুষ ঢাকার বাইরে যায়, তাহলে ঈদের পরে পরিস্থিতি অনেক জটিল আকার ধারণ করবে- এ বিষয়ে অনুমান করার জন্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।

গত বছরের শেষ দিকে করোনার যে ঢেউ বাংলাদেশসহ পৃথিবীতে এসেছিল সেটি মূলত ছিল করোনার অমিক্রণ ভেরিয়েন্টের আঘাত। অমিক্রণ তুলনামূলকভাবে ডেল্টা বা অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে অনেক দুর্বল ছিল বিধায় আমাদের দেশে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।

তাছাড়া সরকার অত্যন্ত সফলতার সাথে দেশের প্রায় ৭০ শতাংশের ওপর মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসার জন্য মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি কমানো সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া গত বছর যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল তাদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংখ্যা কম ছিল বিধায় মৃত্যু কম ছিল।

ইতোমধ্যে অমিক্রণের পরবর্তী আরেকটি ভ্যারিয়েন্ট যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন। পাশাপাশি মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে যে ঢাকায় আক্রান্ত হওয়া বেশিরভাগ রোগী ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত।

বাংলাদেশের ৭০ শতাংশের ওপরে মানুষ টিকা গ্রহণ করলেও বিপুল সংখ্যক মানুষ করোনায় পুনরায় আক্রান্ত হলে তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যাবে। তাছাড়া আমরা এখনো জানি না করোনার টিকা নতুন ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে কতটা সুরক্ষা প্রদান করতে পারবে। ফলে বেশি সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হলে এবং হাসপাতালে ভর্তি হলে হাসপাতালে সেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

করোনার প্রকোপ কমলেও করোনা সুরক্ষা বিধি মেনে চলার ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বারবার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কারণ আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে করোনা খুব অল্পসময়ের মধ্যেই নির্মূল হবে না। তবে এটি বিভিন্ন ভেরিয়েন্টে পরিবর্তিত হতে হতে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়বে।

ফলে যতদিন না পর্যন্ত এটি সাধারণ ফ্লুতে পরিণত না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত জনগণকে করোনা সুরক্ষা বিধি মেনে চলার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সরকারের তরফ থেকে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে মানুষের মধ্যে সুরক্ষা বিধি মেনে চলার ব্যাপারে উদাসীনতা দেখা দেওয়ার ফলে বেশিরভাগ মানুষই মাক্স না পরে কিংবা সামাজিক দূরত্ব বিধি না মেনে চলাচল করেছে, যার প্রভাব আমরা ইতিমধ্যে দেখতে শুরু করেছি।

আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি যে, সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়া শুরু হলেও আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন চট্টগ্রামে প্রচুর বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানে অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে আবার যদি সিলেটের মতো পরিস্থিতি হয় এবং পাশাপাশি করোনা পরিস্থিতি আরও যদি খারাপ হতে থাকে তাহলে সার্বিকভাবে দেশের জন্য একটি বড় দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে। ফলে সরকারের তরফ থেকে এখনই কিছু শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। একই সাথে জনগণের উচিত উদাসীনতা দূর করে করোনা সুরক্ষা বিধি মেনে চলা উচিত।

আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, করোনা অতিমারির প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও বিশ্ব অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে বিশ্বব্যাপী এক ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যেই শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির ধসের বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছি।

অনেকেই বলার চেষ্টা করেছিলেন যে শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থা দ্রুতই বাংলাদেশে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত অবস্থানে রয়েছে বিধায় সে ধরনের শঙ্কা নেই। তবে পুনরায় যদি করোনা পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায় এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে যদি আরও বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় তাহলে সেটি হবে অর্থনীতির ওপর একটি বড় চাপ।

সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে সরকার এবং জনগণসহ সবার উচিত করোনার ঊর্ধ্বগতির বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা। করোনা সুরক্ষা বিধি মেনে চলার বিষয়ে একদিকে যেমন জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, পাশাপাশি জনগণ যে সুরক্ষা বিধি মেনে চলছে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে পুনরায় কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা যেতে পারে সরকারের তরফ থেকে।

করোনার কারণে শুধু স্বাস্থ্য খাত ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। এর সাথে শিক্ষা ব্যবস্থারও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অতএব অর্থনীতি, মানুষের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা ব্যবস্থা যেন পুনরায় করোনার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য সবাইকে এগিয়ে এসে একসঙ্গে করোনা মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে একমাত্র করোনা সুরক্ষা বিধি মানার মাধ্যমেই করোনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।

এইচআর/ফারুক/এমএস