ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

পদ্মা সেতু— উন্নয়নের বিশ্বনন্দিত ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ মডেল

ড. মতিউর রহমান | প্রকাশিত: ১০:১৭ এএম, ১৯ জুন ২০২২

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি বেশকিছু মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো ‘পদ্মা সেতু নির্মাণ’ প্রকল্প। এটি বাংলাদেশিদের জন্য একটি স্বপ্ন হিসেবে চিত্রিত বা রূপায়িত হয়েছিল। এই স্বপ্নের রূপকার ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ফলে এবং তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক যখন ২৯ জুন ২০১২ সালে পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করে এবং অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীও সরে দাঁড়ায় তখন ওই বছরই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃঢ় মনোভাবের বাস্তব রূপায়ণই আজকের স্বপ্নের পদ্মা সেতু। আমাদের মতো আমজনতার এটা জানা নেই যে, তিনি কিসের ভিত্তিতে, কোন ভরসায় এরকম একটি বড় সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন।

তবে এ ঘটনার পরপরই আমরা দেখতে পেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর মানবিক উন্নয়ন দর্শনের একজন নিস্বার্থ ছাত্র ও স্বনামধন্য গবেষক অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত পদ্মা সেতু নিয়ে গভীর বিশ্লেষণধর্মী ও প্রায়োগিক একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যা ওই সময় সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। বৃহৎ গবেষণাপত্রটির শিরোনাম ছিল ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু: জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সুযোগ’।

গবেষণাপত্রটি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি কর্তৃক আয়োজিত ‘নিজ অর্থে পদ্মা সেত ‘ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে মূল প্রবন্ধ হিসেবে ১৯ জুলাই ২০১২ সালে ড. আবুল বারকাত কর্তৃক পঠিত হয়। ওই গবেষণাপত্রেই তিনি উল্লেখ করেন ‘বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল অনৈতিক ও মহা অন্যায়; তবে তা বাংলাদেশের জন্য এক মহা আশীর্বাদ (blessing in disguise)’। বিস্তারিত হিসাব-পত্তর করে তিনি দেখান যে, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সদিচ্ছা থাকলে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব। তাও একটি নয় চার-চারটি। তার এই গবেষণাপত্র উপস্থাপনের পরে দেশ-বিদেশের অনেক বিজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তি তীব্র সমালোচনা করেন। এমনকি সেসব সমালোচনায় অধ্যাপক বারকাতকে ব্যক্তিগতভাবেও আক্রমণ করা হয়।

ওই সময় প্রবন্ধটি একটি পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়। ২০১২ সালে গবেষিত ও প্রকাশিত ড. আবুল বারকাতের ওই গবেষণা পুস্তিকাটি একটি নতুন সংযোজিত অধ্যায়সহ ২০২১ সালে গ্রন্থাকারে দ্বিতীয়বার প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির শিরোনাম ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু: জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সুযোগ‒ ২০১২ সালে গবেষণায় প্রমাণিত‒ ২০২১ সালে দৃশ্যমান বাস্তবতা’। এই গ্রন্থের ‘কৃতজ্ঞতা’ অংশে অধ্যাপক বারকাত কর্তৃক নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু সংক্রান্ত গবেষণার প্রেক্ষাপট, বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।

অধ্যাপক বারকাত উল্লেখ করেছেন, ‘২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এ বিজয়ে ভূমিকা রেখেছিল নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রণীত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার‒ ‘দিন বদলের সনদ’। ‘সনদ’ রচনার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০৬-০৭ সালের দিকে। এ প্রক্রিয়ায় আমি সম্পৃক্ত ছিলাম। তখন আমার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভাবনাজগতে চারটি বিষয় ছিল সর্বাধিক গুরুত্ববহ: ১. দেশে বৈষম্য-দারিদ্র্য দূর করতে হবে‒ যথাদ্রুত সম্ভব, ২. মানুষের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দেখভালের দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকে‒ সংবিধানের বিধান মান্য করে, ৩. মানুষের জন্য শোভন কাজ ও মানবিক আবাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং ৪. উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রকৃতির শক্তিকে মান্য করে প্রয়োজনীয় বড় ধরনের অবকাঠামোগত প্রকল্পের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন-বিনির্মাণ করতে হবে‒ ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে‒ নিজস্ব অর্থায়নে।

এসব কারণেই বৈশ্বিক পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-করপোরেট জুলুমবাজি এবং এই জুলুমবাজির ‘দক্ষ এজেন্ট’‒ বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা ধরনের প্রতিষ্ঠানের বহুপ্রতিকূল ও দীর্ঘ মেয়াদে দেশের সার্বভৌমত্ববিরোধী শর্তাবিষ্ট ঋণজালের খপ্পর থেকে দেশকে মুক্ত করে অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালন করতে হবে‒ নিষ্ঠা ও দূরদর্শিতার সাথে। বিশ্বব্যাংকের কোনো ঋণ ও খবরদারি ছাড়া দেশের অর্থে-দেশের সম্পদে পদ্মা সেতু‒ উন্নয়নের এই সমীকরণ দেশে ব্যাপক জনসম্মতি পেয়েছিল। ২০১১-১২ সালের দিকে এই জনসম্মতি-জনমতের দৃশ্যমান প্রতিফলন ঘটেছিল যখন নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু বিনির্মাণের প্রশ্ন হাজির হলো।

সে কারণেই ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বিনির্মাণ’ প্রসঙ্গ এলে প্রথমেই নিঃসঙ্কোচ-নিঃশর্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে এ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে। আমি দেশের আপামর সাধারণ মানুষের প্রতি মস্তকাবনত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি‒ একই সাথে দুই কারণে প্রথমত, তারা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বিনির্মাণে পূর্ণ সম্মতি দিয়েছিল এবং একই সাথে ‘পদ্মা সেতু স্বেচ্ছা অনুদান সহায়তা’ ফান্ডে ব্যক্তিগত অনুদান দেওয়া শুরু করেছিল। দ্বিতীয়ত, তারা জনগণের উন্নয়নে সাম্রাজ্যবাদী জুলুমবাজি এজেন্ট‒ বিশ্বব্যাংকসহ অনুরূপ সবকিছু প্রত্যাখান করেছিল।

২০১১ সালের দিকে যখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো মেগা-অবকাঠামো বিনির্মাণ-সম্ভাবনা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছিলাম, তখন ‘ভদ্রলোক ক্লাবের’ উপকারভোগী ক্ষমতার অনুগত সেবক ‘বুদ্ধিজীবীদের’ অনেকেই বিষয়টি নিয়ে তেমন ভাবেননি। এসব ভদ্রলোকের কেউ কেউ বলা শুরু করেছিলেন যে বিশ্বব্যাংকের ঋণ ছাড়া নিজ শক্তি-সম্পদ দিয়ে‒ এ কাজ অসম্ভব; অনেকেই বলা শুরু করলেন, এসব কল্পনা বিলাস; অনেকেই এসবে ইতিমধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি-সম্ভাবনা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা শুরু করেছেন (ভাবখানা এমন যে বিশ্বব্যাংক মহৎ প্রতিষ্ঠান‒ দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান)। এমন ধরনের বাস্তবতায় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বিনির্মাণ যে সম্ভব‒ এ ভাবনা-চিন্তা ছিল রীতিমতো স্রোতবিরুদ্ধ— কথিত কল্পনাপ্রবণ। এমনই স্রোতবিরুদ্ধ যা যুক্তি দিয়েও প্রকাশ্যে উচ্চারণ করা সম্ভব ছিল না।

এ ধরনের এক স্রোতবিরুদ্ধ পরিস্থিতি-পরিবেশে আমি নিজ অর্থে পদ্মা সেতু নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করি। সংশ্লিষ্ট তথ্যানুসন্ধানের কাজটিও শুরু করি। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বহু অঙ্গনের বিশেষজ্ঞদের সাথে যোগাযোগ করে বড় ব্রিজের নির্মাণসংশ্লিষ্ট বহুমাত্রিক বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান করি। এসবই করি একান্তে-নিভৃতে। এ প্রক্রিয়ায় একপর্যায়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে আমরা নিজস্ব শক্তিতে‒ নিজ সম্পদে‒ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বিনির্মাণ করতে সক্ষম। পাশাপাশি একই সাথে এ সিদ্ধান্তেও উপনীত হই যে এ বিনির্মাণকাজে বিশ্বব্যাংকসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠানের ঋণ নেওয়া হবে হিতেবিপরীত।

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বিনির্মাণ সম্ভব— আমার এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণে একদিকে সহায়ক হয়েছিল বিশ্বের মেগা-অবকাঠামো বিনির্মাণ ইতিহাস— মিশরের পিরামিড থেকে শুরু করে চীনের দুঃখ হোয়াংহো নদীর বাঁধ নির্মাণ হয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে দ্রুত বিদ্যুতায়ন আর অন্যদিকে দৃশ্যমান অভিজ্ঞতা— আমাদের দেশের অনেক শ্রমজীবী মানুষ যারা বিদেশে মেগা প্রকল্পে কাজ করেছেন এবং দেশের মধ্যেই তুলনামূলক বড় ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করছিলেন (বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছিলাম স্বচক্ষে হানিফ ফ্লাইওভারের কাজ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগে)।

এ প্রক্রিয়ায় অর্থায়নসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি আমার নিজ রাজনৈতিক-অর্থনীতি জ্ঞান-উদ্ভূত বলা চলে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট জটিল টেকনিক্যাল হিসেবপত্তর, যেমন- cash flow analysis, cost-benefit, internal rate of return, debt servicing (সুদাসল পরিশোধ)– এসব বিষয়ে আমাকে নিরন্তর-নিঃশর্ত সহায়তা দিয়েছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের তৎকালীন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট সেকশনের দায়িত্বে নিয়োজিত মহাব্যবস্থাপক মো. দাউদ আহমদ শিকদার, উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. মাহ্ফুজুর রহমান এবং প্রিন্সিপাল অফিসার ইঞ্জিনিয়ার মো জাকিউর রহমান।

পদ্মা সেতুর বিনির্মাণ সম্ভাবনা নিয়ে দেশে যখন তুমুল তর্ক-বিতর্ক চলছিল ঠিক সে সময়েই ২০১২ সালের ১৯ জুলাই বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ‘নিজ অর্থে পদ্মা সেতু’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করে। সেই সেমিনারে একক বক্তা হিসেবে আমি প্রথমবারের মতো সংশ্লিষ্ট টেকনিক্যাল বিষয়াদিসহ সবধরনের হিসেবপত্তর ৩৯ পৃষ্ঠার মুদ্রিত একটি দলিল দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমের উপস্থিতিতে উত্থাপন করি, যার শিরোনাম ছিল ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু: জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সুযোগে’।

ওই গবেষণায় আমি উল্লেখ করি যে, পদ্মা সেতু নির্মাণ বিষয়টি এখন আর কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই‒ তা রূপান্তরিত হয়েছে গণ-আকাঙক্ষায়। বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল অনৈতিক এবং মহা অন্যায়, তবে তা বাংলাদেশের জন্য এক মহা আশীর্বাদ। ১৯৭২-৭৩ সালের বাংলাদেশ অর্থনীতি আর ২০১২ সালের অর্থনীতি এক কথা নয়। এখন আমাদের অর্থনীতি অনেকগুণ বেশি শক্তিশালী; জনগণ অনেকগুণ বেশি আত্মশক্তি-আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। পদ্মা সেতু নির্মাণে জনগণ এখন অনেকগুণ বেশি ত্যাগ স্বীকারে সর্বাত্মক প্রস্তুত‒ জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি ও তা সুসংহতকরণের এখনই শ্রেষ্ঠ সময়।

যেহেতু আগামী চার বছরে পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে আনুমানিক ২৪ হাজার কোটি টাকা; আর ঠিক একই সময়ে ১৪টি বিভিন্ন উৎস থেকে সম্ভাব্য অর্থ সংস্থান হতে পারে ৯৮ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা, সেহেতু পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ পরিকল্পিতভাবে এ মুহূর্তেই শুরু করা সম্ভব। অর্থ সংস্থানের ক্ষেত্রে বিশেষ জোর দিতে হবে সুদবিহীন উৎসসমূহে‒ যেসব উৎস থেকে সম্ভাব্য আহরণ হতে পারে মোট ৪৯ হাজার ১৫০ কোটি টাকা অর্থাৎ দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয়ের সমপরিমাণ অর্থ।

সেই সাথে জোর দিতে হবে নিজস্ব অর্থায়নের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণসংশ্লিষ্ট খাতসমূহে; এক্ষেত্রে করণীয় হবে নিম্নরূপ: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি করা; প্রবাসীদের প্রেরিত হুন্ডিকৃত অর্থ উত্তরোত্তর অধিক হারে ব্যাংকিং চ্যানেলে আনা; পদ্মা সেতু বন্ড (৮ থেকে ৩০ বছর মেয়াদি), সার্বভৌম বন্ড ও পদ্মা সেতু আইপিওতে প্রবাসী-বিদেশিদের বিনিয়োগে আগ্রহী করা; টাকার অংকের উদ্বৃত্ত অর্থ (৪ বছরে মোট ৭৪ হাজার ২২৫ কোটি টাকা) উৎপাদনশীল বিনিয়োগ করে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করা; অর্থনৈতিক কূটনীতির ফলপ্রদতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগীসহ বিদেশের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে সহজ শর্তে স্বল্প সুদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সংগ্রহ করা এবং ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে অনুদান সংগ্রহ করা।

করণীয় বিষয়াদির মধ্যে গুরুত্বসহ বিবেচনা করতে হবে: ১. তিনটি উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন‒ সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ও বাস্তবায়ন সমন্বয়কারী কমিটি হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে পদ্মা সেতু ইন্টিগ্রিটি কমিটি, আর সাথে থাকবে অর্থায়ন-অর্থ সংস্থান কমিটি এবং কারিগরি-প্রযুক্তি কমিটি, ২. ‘পদ্মা সেতু পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি’ গঠন করে তার মাধ্যমে বাজারে আইপিও ছাড়া, ৩. পদ্মা সেতুসহ বৃহৎ অবকাঠামোর জন্য নির্মাণসামগ্রী (যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ, কাঁচামাল) উৎপাদননিমিত্ত শিল্প স্থাপনে পদক্ষেপ নেয়া, ৪. সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের (দেশে-বিদেশে অবস্থানরত) হালনাগাদ তালিকা প্রণয়ন ও সংরক্ষণসহ জরুরি ভিত্তিতে এবং নিয়মিত তাদের পরামর্শ গ্রহণের জন্য জীবন্ত-রিয়েলটাইম ওয়েবসাইট চালু রাখা, ৫. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘Friends of Padma Bridge, Bangladesh’ চেতনায় উদ্বুদ্ধ সংগঠন গড়ে তোলা, ৬. গণ-অবহিতকরণ কার্যক্রমসহ সংশ্লিষ্ট প্রচারব্যবস্থা শক্তিশালী করা।

পদ্মা সেতু নির্মাণের ৩০ বছরের মধ্যেই নির্মাণ ব্যয় উঠে আসবে; ১০ম বছর থেকে যেহেতু ঘাটতি থাকবে না, সেহেতু বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে পদ্মা সেতুর জন্য আর বরাদ্দ রাখার প্রয়োজন হবে না; সেতু চালু হওয়ার ৪০তম বছরে নিট ক্যাশ ফ্লো ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে, আর ১০০তম বর্ষে তা ছাড়িয়ে যাবে ২ লাখ কোটি টাকা; উন্নত কানেক্টিভিটি সমগ্র অর্থনীতির (শুধু দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের নয়) চেহারা আমূল পাল্টে দেবে। সুতরাং নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বিনির্মাণ বিষয়টি হতে পারে উন্নয়ন আন্দোলনের (development as movement) বিশ্বনন্দিত ‘Made in Bangladesh’ মডেল।”

এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, পদ্মা সেতু এ দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ উন্নত দেশে রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে ও জাতীয় একতা বৃদ্ধিতে এই সেতু মেলবন্ধ হিসেবে কাজ করবে। এক্ষেত্রে ড. বারকাত কর্তৃক ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু: জাতীয় ঐক্যের শ্রেষ্ঠ সুযোগ’, গবেষণা কর্মটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলেই প্রতীয়মান হয়।

পরিশেষে বলা যায়, দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে, কুচক্রী মহলের সমালোচনা ব্যর্থ প্রমাণ করে ও তীর্যক মন্তব্য উপেক্ষা করে পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান বাস্তবতা। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্যা কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অসীম সাহসিকতা ও সুদৃঢ় প্রত্যয়ের সোনালি ফসল, ১৭ কোটি বাঙালির গর্ব ও অহংকার পদ্মা সেতু আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। দেশের আপামর জনগণ তাদের টাকায় প্রমত্তা পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত এই সেতুর ওপর দিয়ে যাতায়াতের অপেক্ষায় এখন অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব অধ্যাপক আবুল বারকাতের গবেষণা কর্মটি সত্যে পরিণত হয়েছে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

এইচআর/ফারুক/এমএস