ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

স্থানীয় নির্বাচন যে জাতীয় বার্তা দিল আওয়ামী লীগকে

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | প্রকাশিত: ১০:০২ এএম, ১৮ জুন ২০২২

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা যখন কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতের কষ্টকর বিজয়ে উল্লসিত তখন আরও দু-একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের নৌকার লজ্জাজনক পরাজয় ঘটেছে। খোদ গোপালগঞ্জে নৌকা পরাজিতই শুধু হয়নি, হয়েছে পঞ্চম। জেলার মুকসুদপুর পৌরসভা নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।

নৌকার প্রার্থী ও বর্তমান মেয়র মো. আতিকুর রহমান মিয়া ৬০৪ ভোট পেয়ে হয়েছেন পঞ্চম। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধুলারসর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ১ হাজার ৩৫৯ ভোটে হারিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাফেজ আব্দুর রহিম। এটি আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্যের নিজের ইউনিয়ন।

কুমিল্লার নির্বাচন কাজী হাবিবুল আউয়ালের নির্বাচন কমিশনের প্রথম পরীক্ষা বলে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। কমিশন পাস না ফেল সে নিয়ে ব্যাপক বিশ্লেষণ চলছে। কিন্তু এই নির্বাচন আওয়ামী লীগকে কী বার্তা দিল সেটা জানা জরুরি। রিফাত পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০ ভোট, মনিরুল হক সাক্কু ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট। অর্থাৎ জিতেছেন মাত্র ৩৪৩ ভোটে। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কায়সার পেয়েছেন ২৯ হাজার ৯৯ ভোট।

সাক্কু ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করতে পারেননি তার দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায়। এরপরও সাক্কু প্রায় জিতেই গিয়েছিলেন বলা যায় নিজের দলীয় লোক কায়সার প্রার্থী না হলে। তারা দুজন মিলে ভোট পেয়েছেন ৭৮ হাজারের বেশি, যেখানে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী পেয়েছেন ৫০ হাজার ভোট। তাই এই জয় আওয়ামী লীগের জন্য যতটা না জয়, তারচেয়ে বেশি ভয়ের। আ ক ম বাহারউদ্দিনের মতো দাপুটে নেতার এলাকায় এত বেশি আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট পড়ল তার খোঁজ নেওয়া প্রয়োজন।

একটা কথা প্রায়ই বলা হয়, ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগকে হারানো কঠিন। যদি এ কথা সত্যি হয়, তাহলে কুমিল্লা সিটিতে ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগকে জিততে এত বেগ পেতে হলো কেন? স্থানীয় সরকার নির্বাচন যদি জাতীয় নির্বাচনের পথ প্রদর্শন করে তাহলে উপরে বর্ণিত তিনটি স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফলকে আওয়ামী লীগকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে।

অনেকদিন ধরেই দলের ভেতর থেকে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন কাদের দেয়া হচ্ছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তৃণমূল নেতারা জয় পেতে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত নেতাদের মনোনয়ন দেওয়ার কথা বলছেন। রাজনীতির সঙ্গে তেমন যুক্ত নন— এমন ব্যক্তিদের মনোনয়ন না দেওয়ার পক্ষে তারা। এছাড়া রাজনীতির বাইরের কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার পক্ষে নন তারা।

গোপালগঞ্জের মতো জায়গায় নৌকা হেরেছে, পটুয়াখালীতে এমপির ইউনিয়নে হেরেছে এবং কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই হেরেছে নৌকা। প্রান্তিক পর্যায়ে প্রায় জেলা, উপজেলা এবং বিভাগে শাসক দলের ভেতর বিবাদ এবং বিবাদকে কেন্দ্র করে সহিংস অবস্থা বিরাজ করছে বহুদিন ধরে। সারাদেশেই এখন আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ। কোনো জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগ আর এক আছে বলে মনে হয় না। এক আওয়ামী লীগে অসংখ্য ভাগ। উপদলীয় কোন্দলে আওয়ামী লীগ ক্ষত-বিক্ষত। মুখে যদিও বলা হয়, তারা সবাই বঙ্গবন্ধুর সৈনিক, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী কিন্তু বাস্তবে তারা অনুসরণ করেন স্থানীয় কোনো না কোনো নেতাকে। এবং এই নেতাকেন্দ্রিক ক্ষমতাচর্চা থেকেই দলের ভেতর পক্ষ ও প্রতিপক্ষ।

আওয়ামী লীগের কলহ-কোন্দল সংঘাতে রূপ নিচ্ছে সর্বত্র। আহত-নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে খবর থাকছে। বিরোধী দল দুর্বল, তাই দলের ভেতর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যেই বিবাদে জড়াচ্ছেন নেতাকর্মীরা। কুমিল্লায়ও আওয়ামী লীগের বিভাজন নিয়ে অনেক কথা আছে, যা এখানে উল্লেখ করতে চাই না।

বরাবরই বাংলাদেশের রাজনীতি মানেই হলো সহিংসতা। এক দলের প্রতিপক্ষ আরেক দল এবং সেটাকে কেন্দ্র করে লড়াই ও সংঘর্ষ। কিন্তু এক দলের ভেতর যখন অনেক দল গড়ে ওঠে তখন পরিস্থিতি বেশি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বেগ পেতে হয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে। এ অবস্থা আমরা দেখছি বিভিন্ন জনপদে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়েছে, কারণ সবাই চায় মার্কার দখল নিতে। আধিপত্য বিস্তারের জন্য নেতাদের যে উদগ্র বাসনা তার মধ্যেই নিহিত আছে সহিংসতা। সংঘাত ও সহিংসতা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি, ব্যক্তি বনাম গোষ্ঠী, গোষ্ঠী বনাম গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বনাম সম্প্রদায়, জাতি বনাম জাতি— এসব নানাভাবে হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ। এসব দ্বন্দ্ব নিরসন করতে গিয়ে রাষ্ট্রকে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু সহিংসতা যদি সরকারি দলের রাজনৈতিক অনুশীলন হয়ে দাঁড়ায় তখন সেটা থামানো কঠিন।

শক্ত সাংগঠনিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ এখন টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায়। কিন্তু সেই সাংগঠনিক শক্তিই এখন প্রশ্নের মুখে। বেশি দিন ক্ষমতায় থাকায় দলের ভেতর সংহতির শক্তিতে বেশ ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। জন্ম নিচ্ছে দল, উপদল। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন নেতা ও তাদের গোষ্ঠী। এর সুযোগ নিচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি। সরকারি দলের নেতাকর্মীরা যতটা ক্ষমতার চর্চা করছে, ততটা করছে না রাজনৈতিক চর্চা। এতে করেই ভেতর থেকে মেধাশক্তি এবং চিন্তাশক্তির ক্ষয় ঘটছে, ত্যাগী নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে নিষ্ক্রিয় হচ্ছেন বা দল ছেড়ে যাচ্ছেন।

আওয়ামী লীগের মতো দলের ঐক্যবন্ধন এক বড় শক্তি। সেটা বহুদিন ধরেই আলগা হয়ে যাচ্ছে এবং বিপদটা এখানেই। আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে দলের ভেতর আওয়াজটা জোরের সাথে ওঠা দরকার। চিহ্নিত করা দরকার তাদের যারা ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করছে, যারা হিংসার আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতি বজায় রাখছে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।

এইচআর/এমএস/ফারুক