ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

করোনার ঊর্ধ্বগতি এবং মাঙ্কিপক্স

ড. মো. হাসিনুর রহমান খান | প্রকাশিত: ০৯:৫১ এএম, ১৮ জুন ২০২২

মাঙ্কিপক্সের জুজুর ভয় আর বিগত দুই বছরের বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনের আড়ালে মে মাসের মাঝামাঝি হতে দেশে আবারও করোনা একটু একটু করে বাড়তে শুরু করেছে। আনুবীক্ষণিক চোখেই কেবল এত দিন এই বৃদ্ধি ধরা পড়ছিল, কিন্তু গত এক সপ্তাহর বেশি ধরে এই বৃদ্ধি স্বাভাবিক চোখেই ধরা পড়ছে।

করোনা শনাক্তের হারের সাপ্তাহিক গড় অনুযায়ী এপ্রিলের শেষ এবং মে মাসের প্রথম এই দুই সপ্তাহে করোনা শনাক্তের সাপ্তাহিক হার সর্বনিম্ন ০.৫ শতাংশ পর্যায়ে ছিল। যা বৃদ্ধি পেয়ে মে মাসের মাঝামাঝিতে ০.৬ শতাংশে এবং শেষের দিকে দশমিক ৮ শতাংশে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে সাপ্তাহিক গড় হার বৃদ্ধি পেয়ে ১.২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

গত ৬ জুন দৈনিক শনাক্তের হার ১% অতিক্রম করে এবং তা মাত্র ৬ দিনের ব্যবধানে বৃদ্ধি পেয়ে ১২ ই জুন ২ দশমিক ০৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমান এই ধারা বজায় থাকলে জুন মাস শেষ হবার আগেই করোনা শনাক্তের হার দশের ঘর অতিক্রম করতে পারে, এবং জুলাইয়ের মাঝামাঝি হতেই করোনার মৃদু ঢেউ আসতে পারে এমন সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। নিবিড় ভাবে করোনার ট্রাজেক্টরি পর্যবেক্ষণ করার কারণে ব্যক্তিগতভাবে এমন আশঙ্কার কথা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। জুলাই এর শেষে বা আগস্ট এর শুরুতে আরেকটি ঢেউ আসার সম্ভাবনার পেছনে অনেকগুলি যৌক্তিক কারণ রয়েছে।

ব্যাপক টিকাদান কর্মসূচি চললেও, টিকার কারণে অর্জিত হাইব্রিড ইমিউনিটি কিংবা করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাকৃতিক ইমিউনিটি ধরে রাখার সক্ষমতা মোটামুটি ছয় মাসের ব্যবধানে তলানিতে নেমে আসে, গবেষণার ফলাফলে এমনটি জানা যাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় পড়তে যাচ্ছেন আমাদের দেশের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ, যাদের সর্বশেষ টিকা (টিকার যেকোনো ডোজই হোক) দেয়া হয়েছে ৪ বা ৫ মাস আগে এবং যারা এখনো টিকা নেননি।

সীমাহীন স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করবার কারণে জনসংখ্যার এই অংশটি সামনের দিনগুলিতে আক্রান্ত হতে পারে বেশি বেশি করে। ফলে একটি দীর্ঘ মেয়াদী মৃদু মহামারী আসার উচ্চ সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনি সময়ের ব্যবধানে ক্রমাগতভাবে ব্যাপক টিকা প্রদানের কারণে একটি বড় জনগোষ্ঠীর শক্তিশালী ইমিউনিটি থাকার কারণে ব্যাপক মহামারী আসারও সম্ভাবনা একেবারেই কম রয়েছে। নতুন কোন ভয়ঙ্কর ভেরিয়েন্ট না আসলে অমিক্রণ এর চলমান অন্যান্য ধরন বা উপধরন তেমন কোন বেকায়দায় ফেলতে পারবে না বা নতুন কোনো অভিঘাতেরও সৃষ্টি করতে পারবে না, এটা এখন বলা যায়।

তবে সাম্প্রতিক এই ঊর্ধ্বমুখীর জন্য কোন কোন ভেরিয়েন্ট দায়ী তা খুঁজে বের করতে প্রয়োজনীয় জেনোম সিকোয়েন্সিং করা দরকার। এর সাথে টেস্টের সংখ্যা বাড়িয়ে করোনা বিস্তারের সঠিক মাত্রা জানাও দরকার। বি এ ৪ এবং বি এ ৫ এই দুটি অমিক্রন এর নতুন উপধরন অনেক দেশে দ্রুত বিস্তার লাভ করছে।

বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পর্তুগাল সহ ইউরোপের অনেক দেশে। আমাদের দেশেও তা পাওয়া গেলে এদের যথাযথ লক্ষণ এবং চিকিৎসা পদ্ধতি গুলি সম্পর্কে এখন থেকেই মানুষদেরকে অবহিত করা দরকার। আর বুস্টার ডোজ এর জন্য অপেক্ষাধীন বড় সংখ্যক মানুষকে যত দ্রুত বুস্টার ডোজ দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ঢেউ আসার আগেই।।

গত ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি গবেষণা হতে জানা যায় কভিডে গুরুতর অসুস্থ এবং মৃত্যুর জন্য ক্রোমোজোম ৩- এর একটি জিন ক্লাস্টার দায়ী যা নিয়ান্ডারথাল থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৫০% এবং ইউরোপের প্রায় ১৬% লোকের দ্বারা বহন করা হয়। বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ক্যারিয়ার ফ্রিকোয়েন্সি ঘটে, যেখানে অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা (৬৩%) নিয়ান্ডারথাল ঝুঁকি হ্যাপ্লোটাইপের অন্তত একটি কপি বহন করে। আফ্রিকা অঞ্চলে এর উপস্থিতি একেবারেই নেই, ফলে সেখানে মৃত্যু ঘটেছে অনেক কম। অন্যদিকে জেনেটিক ঝুঁকির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশে কভিডের কারণে মৃত্যু হার অনেক কম। তবে এর প্রকৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশের করোনা মহামারির প্রকোপ উঠানামার সাথে ভারতের মহামারির প্রকোপ এর সম্পর্কের একটি সরল সমীকরণ ছিল। ডেল্টা করোনা মহামারি পর্যন্ত এই সম্পর্কের স্পষ্ট ধারণা আমরা পেয়েছিলাম। তবে অমিক্রন মহামারির ক্ষেত্রে সেটা অনেকটাই অস্পষ্ট ছিল। ভারতে গত ৮-১০ দিন ধরে উদ্বেগজনক ভাবে করোনা শনাক্তের সংখ্যা বাড়ছেই, যা বাংলাদেশের চেয়েও দ্রুতগতিতে বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যান্য দেশে এমনটি না ঘটলেও ভারত এবং বাংলাদেশের হঠাৎ এমন করোনা শনাক্তের ঊর্ধ্বমুখী হার, দেশ দুটিতে আবারো একটি আসন্ন মহামারির পূর্বাভাস দিচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

বৈশ্বিকভাবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছুদিন ধরে করোনার ব্যাপক ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। অমিক্রন এর বিএ ৪ এবং ৫ এর দ্রুত বিস্তার ঘটছে। সেখানে এখনো প্রতিদিন শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে। ব্রাজিল, জার্মানি, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ইতালি, স্পেইন, রাশিয়াসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে এখনো প্রতিদিন শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে। চীন, উত্তর কোরিয়া, এবং তাইওয়ান এর করোনা মহামারি এযাবত কালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। তথ্যের ঘাটতি থাকায় প্রকৃত সংখ্যা জানা না গেলেও সেখানেও শত শত মানুষ প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

করোনা পরিস্থিতি সামলে উঠতে না উঠতেই চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রায় প্রতিটি দেশকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানোর যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছে। ইউক্রেনে উৎপাদিত মিলিয়ন মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য ইউক্রেন রপ্তানি করতে পারছেনা এছাড়াও কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় সার রাশিয়াও রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে।

সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে রাশিয়া সার সরবরাহ না করায় অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট মহামারী এবং দুর্ভিক্ষের সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মাংকিপক্স নামক নতুন একটি মহামারীর কথা জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। ফলে সামনের দিনগুলিতে বিশ্বব্যাপী মানবজাতির মানবিক এবং স্বাস্থ্যের ব্যাপকভাবে অবনতি ঘটে যাওয়ার একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

করোনা মহামারি গত একশ বছরে সপ্তম মহামারি। গত এক দশকে ৩ টি: ইবোলা, জিকা এবং করোনাভাইরাস। আগামী শতকেও এরকম মহামারীর সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পাবার বড় সম্ভাবনা রয়েছে। এরকম সম্ভাবনার কথা বলতে বলতে অষ্টম মহামারি হিসেবে মাংকিপক্স মহামারির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

মাঙ্কিপক্স এ আক্রান্ত রোগীকে অনেক বছর ধরেই পাওয়া যাচ্ছে আফ্রিকার কিছু কিছু দেশে। কিন্তু এটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানোর সক্ষমতার কথা কিছুদিন আগ পর্যন্তও জানা যায়নি। এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই এটি এখন সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে। এবং এক ধরনের ভয়ের জায়গা তৈরি করেছে কারণ বয়স্কদের জন্য না হলেও শিশুদের, কম বয়সীদের, ইমিউনো কম্প্রোমাইজ মানুষদের এবং প্রসূতি নারীর ক্ষেত্রে মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, ডেনমার্ক এবং ইউরোপের অনেকগুলি দেশে একসাথে মাঙ্কিপক্সের বিস্তারের কথা জানা যায় মে মাসের শেষ সপ্তাহে। এই বিস্তার একই সাথে ইতিমধ্যেই কয়েক সপ্তাহ আগেই ঘটেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। শুরুতে আক্রান্তের সবাই সমকামিতার মাধ্যমে পরস্পরের সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে এবং এটির উৎস হলো স্পেন। বস্তুত আক্রান্তের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসলেই এখন যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে। শারীরিক ফ্লইড, শ্লেষ্মা ঝিল্লি, মুখের ড্রপলেট, যেকোনো কন্টামিনিটেড পদার্থের ছোঁয়ার মাধ্যমে।

মুখের বড় ড্রপলেট এ এই ভাইরাসটি থাকে বলে বাতাসে বেশিক্ষণ অবস্থান করে তা অন্যকে ছড়ানোর ক্ষমতা একেবারে কম। কেউ আক্রান্ত হলে ১ বা ২ সপ্তাহের মধ্যেই সেরে ওঠেন। এই ভাইরাসটি আমাদের বহুল পরিচিত চিকেন পক্সের একই গ্রুপের হওয়ায় স্মল পক্সের টিকাই এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে ৮০% সুরক্ষা দিতে পারে।

জৈবিক যুদ্ধ মোকাবেলার কৌশলের অংশ হিসেবে উন্নত দেশগুলি এই টিকার মজুদ অনেক আগে থেকে করলেও অধিকাংশ দেশেই এর মজুদ নেই। এই ভাইরাসের উপস্থিতি না থাকায় আমাদের দেশেও আশির দশকের শুরুতেই এই টিকা দেওয়া বন্ধ হয়। তবে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হলে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা সকল ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে টিকা দিলেই বিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়।

গত ২৩ মে পর্যন্ত মানুষ থেকে মানুষ এর মাধ্যমে ছড়ানোর মধ্য দিয়ে ১৪৮ জনের আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেলেও বর্তমানে তা ছড়িয়েছে ৩২ টি দেশে এবং ১১ জুন পর্যন্ত শনাক্তের সংখ্যা প্রায় ১৫০০ তে দাঁড়িয়েছে। এটি করোনাভাইরাস এর মতো দ্রুত ছড়াতে পারেনা। যতদূর জানা গেছে মাঙ্কিপক্সের দুটি ভেরিয়েন্ট রয়েছে। একটি হল কঙ্গো বেসড যার মৃত্যু হার ১০%, অন্যটি হলো পশ্চিম আফ্রিকার যার মৃত্যু হার ১ শতাংশ।

মাঙ্কিপক্সের ভাইরাস ডিএনএ বেসড ভাইরাস, আর যেকোনো ডিএনএ বেসড ভাইরাসের মিউটেশন এর হার বেশি হতে পারে না। মাংকিপক্স প্রতিবছর সাধারণত এক বা দুইটি বেস পিয়ারে মিউটেশন হয়। ১৯৭৮ সালের আগ পর্যন্ত নাইজেরিয়ায় মাঙ্কিপক্স এর উপস্থিতি থাকলেও ২০১৭ সাল পর্যন্ত কেউ আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। নাইজেরিয়াতে ২০১৭ সালে ১১ বছরের একটি বালকের শরীরে আবারো মাঙ্কিপক্স দেখা মেলে। এবং পরবর্তীতে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০০ জন লোক এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন।

বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন এই ২০১৭ হতে ২০২২ পর্যন্ত এই ভাইরাসের প্রতিবছর প্রায় ৪৭ টি বেস পিয়ারে মিউটেশন হয়। ফলে এই সময়ের মধ্যে এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে অথবা মানুষ থেকে পশু হয়ে আবারো মানুষে আসার মধ্য দিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে এতগুলি মিউটেশন কেন এবং কিভাবে হয়েছে এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা সুনির্দিষ্ট কোনো কিছু এখনো বের করতে না পারলেও এই সময়ের মধ্যে জিনোম সিকোয়েন্সিং করে একটি সার্ভিলেন্স সিস্টেম কোন দেশই গ্রহণ করেনি বলে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করেছে। এই ব্যর্থতার দায় সুনির্দিষ্ট ভাবে কেউ না নিলেও তাই আসন্ন মহামারি মোকাবেলায় সব দেশকে একত্রে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, ফলিত পরিসংখ্যান, আই এস আর টি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ও সভাপতি, আই এস আর টি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন নির্বাহী কমিটি।

এইচআর/এমএস