ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

দাম বাড়ে চাপ কমে

মোকাম্মেল হোসেন | প্রকাশিত: ১০:৩৪ এএম, ১৭ জুন ২০২২

টেলিভিশনে সিনেমা দেখানো হচ্ছে। সিনেমার নাম- তুমি আমার গোলাপ ফুল। কাহিনি মোচড় খেতে খেতে এমন জায়গায় এসে ঠেকেছে, নায়িকার শিল্পপতি বাবা নায়ককে প্যাকেট করে চিরবিদায় স্টোরে পাঠানোর অর্ডার দিয়ে ফেলেছেন। পিতার এ পদক্ষেপের কথা জানতে পেরে প্রেমাস্পদকে রক্ষার জন্য নায়িকা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। তার পা ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে। মাথার চুল বাতাসে উড়ছে। বুকের বসন আলগা হয়ে যাচ্ছে।

কঠিন অবস্থা। তলপেটের প্রবল চাপ উপেক্ষা করে আতর আলী টেলিভিশনের সামনে বসে আছে। এরকম একটা কঠিন সময়ে আতরজান এসেছে বাজারের ব্যাগ নিয়ে! এর মানে কী? মনে হচ্ছে, কেয়ামতের আগে নারীজাতির জ্ঞান-বুদ্ধি আর বাড়বে না। হাশরের ময়দানে মাথার ৬ ইঞ্চি উপরে থাকা সূর্যের তাপে মগজ সিদ্ধ হয়ে উলট-পালট হওয়ার পর যদি এদের জ্ঞান-বুদ্ধি কিছুটা বাড়ে! আতর আলী তেরছা চোখে আতরজানকে এক নজর দেখে টেলিভিশনে নিমগ্ন হলো। আতর আলীর পিঠে হাত রেখে নরম গলায় আতরজান বলল-

: সিনেমা রাইখ্যা উডুইনছে।
আল্লাহপাক পুরুষের পাঁজরের হাঁড় দিয়ে নারীজাতিকে সৃষ্টি করে ভুল করেছেন। মারাত্মক ভুল। নিজের শরীরের অংশ না হলে আতরজানকে কঠিন কিছু কথা বলা যেত। আফসোস! টেকনিক্যাল এ সমস্যার জন্য তার বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেয়া যাচ্ছে না। নিজেই নিজের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়া চরম বোকামি। আতর আলী এতটা বোকা নয়। বোকা হলে আতরজান এখন শক্ত উষ্ঠা খেত- এ কথা নিশ্চিত।

আতর আলী এবার ঘাড়ে চাপ অনুভব করল। তলপেটের চাপের তুলনায় মেহেদি লাগানো নরম হাতের চাপ হাওয়াই মিঠাই। আতর আলী হাওয়াই মিঠাইকে গুরুত্ব দিল না। চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ তুলে আতরজান বলল-
: কী অইল, কথা কানে যাইতেছে না! উডুইন।

নাহ! নারীজাতি সম্পর্কে ফয়সালা হয়ে গেছে। গরুকে খৈল-ভুসি খাওয়ানোর সিস্টেমে ঘণ্টায়-ঘণ্টায় এদের নাক ডুবিয়ে তরল ভিটামিন খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেও আক্কেল আর হবে বলে মনে হচ্ছে না! নায়কের এখন জীবন-মরণ সমস্যা চলছে অথচ ঘটনার বিষয়বস্তুর প্রতি অবুঝ নারীজাতির কোনো খেয়াল নেই। সে ‘উডলাইনা-উডলাইনা’ বলে কানের কাছে বেহালা বাজাচ্ছে। আতর আলী টেলিভিশনের পর্দা থেকে চোখ না সরিয়ে বলল-
: ইট্টু পরে।
: পরে-পরে করলে চলব? রান্ধনের কুনু বাও নাই। কুমবালা বাজার আনবাইন, কুমবালা রানবাম!

: কুমবালা রানবাম মানে? তোমার তো অহন আর গোপাল পালের মণ্ডা কারখানার মতো লাকড়ি দিয়া চুলা সাজাইতে হয় না! গ্যাসের চুলায় ফতফতি আগুন জ্বলতেছে। চুলার উপরে ডাইন হাতে পাতিল রাখবা, বাম হাতে নামাইবা। ব্যস, মামলা ডিসমিস!
এ সময় বিদ্যুৎ চলে গেল। আতরজান হাততালি দিয়ে বলল-
: আল্লাহর মাইর-দুনিয়ার বাইর। অহন কেমুন অইল?

বিদ্যুৎ যাওয়ার ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বেছে বেছে ঠিক এমন একটা সময়ে বিদ্যুৎ কেন এরকম বিটলামি করল? আতর আলীর মনে হলো, তার বিরুদ্ধে ঘরে-বাইরে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। এ অবস্থায় মাথা ঠিক রাখা শক্ত কাজ। আতর আলী বিদ্যুতের অপেক্ষায় কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকার পর ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করতে করতে বাজারের পথ ধরল। বাজারে মাংসের দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আতর আলীর কানে এলো-
: অই গ্যাস...
গ্যাস আবার কারও নাম হয় নাকি? বিষয়টা একটু পরই পরিষ্কার হলো। আতর আলী বুঝতে পারল, গ্যাস বলে যাকে সম্বোধন করা হয়েছে, তিনি গ্যাস কোম্পানির স্থানীয় অফিসে চাকরি করেন। গ্যাস নিয়ে কারবার- তাকে গ্যাস বলা যেতেই পারে। এতে দোষের কিছু নেই। সম্বোধনকারী গ্যাসের পাশে এসে দাঁড়াতেই তাকে চিনতে পারল আতর আলী। তার নাম আফলাজ মণ্ডল। আফলাজ মণ্ডল অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। বাসা আকুয়া মণ্ডল বাড়ি। আফলাজ গ্যাস ভদ্রলোকের উদ্দেশে বললেন-
: বক্কইরা, কী খবর?
: ভালো।
: গোস কিনবা?
: হুঁ।
: ভালা কইরা দেইখ্যা লইও। ব্যাটারা এক টুকরা গোস দিয়া তিন টুকরা হাড্ডি ঢুকাইয়া দেয়।
: ঢুকানি-ফুকানির কোনো চান্স নাই। পুরা খাসিই প্যাক করতেছি।
: পুরা খাসি! মেজবানি আছে নাকি?
: আর কইও না! বাসায় তিনবেলা বিরানি চলে। আমার বউ বিরানি ছাড়া অন্যকিছু খাইতে পারে না। পোলাপানগুলাও তার মায়ের তরিকা ধরছে। ফলে টুকাইন্যা মাংস দিয়া আমার চলে না; বস্তা ভইরা কিনন লাগে।
: রেগুলার বিরানি খাওয়া তো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ!
: এইটা আমার বউয়েরে কে বোঝাবে? প্রথমে আণ্ডা দিয়া বিরানি উৎসবের সূচনা হইছিল। কিছুদিন পর মুরগি ঢুকল। এরপর গরু। বর্তমানে খাসি চলতেছে। রুচির বিবর্তনে খাসির পরে হয়তো উটের আগমন ঘটবে। তখন আমাকে উটের মাংস কেনার জন্য দৌড়াইতে হবে, হা-হা-হা।

আফলাজ মণ্ডল হাসিতে যোগ না দিয়ে বললেন-
: তোমরা উটের বিরানি খাবা, বাঘের দুধ পান করবা-এইটাই তো স্বাভাবিক। অহন কওছেন, গ্যাসের দাম বাড়ল কীজন্য?
: না বাড়াইয়া উপায় কী? গ্যাস খাতে সরকার ব্যাপক লস খাইতেছে।
: কী জন্য লস খাইতেছে!

: আরে! পাবলিক বেহুদা রাইত-দিন গ্যাসের চুলা জ্বালাইয়া রাখে। এতে গ্যাসের মারাত্মক অপচয় ঘটতেছে। অপচয়জনিত লস কাটাইতে হইলে দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প নাই।
: আমার জানা মতে, বর্তমানে মানুষ অনেক সচেতন হইছে। তারা অকারণে গ্যাসের চুলা জ্বালাইয়া রাখে না। বড় কথা হইল, গৃহস্থালি কাজে মাত্র ১-২ পার্সেন্ট গ্যাস ব্যবহৃত হয়। সব দোষ জনসাধারণের কান্ধে চাপাইতেছ কীজন্য? আসল চোর হইলা তোমরা।
আতর আলী বাজার শেষ করে বাসায় ফিরে দেখল, আতরজান গালে হাত দিয়ে বসে আছে। বাজারের ব্যাগ রান্নাঘরের দরজার সামনে রাখার পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আতরজান বলল-

: বাজার আনছুইন!
: হুঁ।
: বাজার তো আনলাইন; চুলার চাপ এক্কেবারেই কইমা গেছে। একটা কাম করবাইন তো। বিকালে আমারে এক ব্যাগ মাটি আইনা দিবাইন।
: মাটি দিয়া কী করবা?
: চুলা বানাইবাম। গ্যাসের যে অবস্থা দেখতেছি, মনে অইতেছে, মাটির চুলা ছাড়া গতি নাই।
আতর আলী অবাক হয়ে বলল-
: মাটির চুলা কী দিয়া জ্বালাবা? লাকড়ি পাবা কই?
: নান্দিনা থেইক্যা ট্রেনে কইরা লাকড়ি মমিসিং শহরে আহে না!
: কেমনে আইব? গোলাপী তো দেশে নাই।
: দেশে নাই! কই গেছে?

: আরে! তুমি দেখতেছি কুনু খবরই রাখ না। গোলাপী তো অহন লন্ডনে। যে চিত্র পরিচালক ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ নামে ফিল্ম বানাইছিল, সে এই খবর জানার পরে গোলাপী এখন বিলেতে নামে পুনরায় আরেকটা ফিল্ম বানাইয়া সংশোধনী দিছে।
: লাকড়িও নাই, চুলায় গ্যাসের চাপও নাই-ক্যামনে কী করবাম!
চাপের কথা শুনে আতর আলীর মাথায় একটা ধাঁধাঁর জন্ম হলো। সে আতরজানের উদ্দেশে বলল-
: দাম বাড়ে চাপ কমে-এই ধাঁধাঁর উত্তর কে দিতে পারে?
আতর আলীর কথায় আতরজান মুচকি হাসল। তারপর দু’চোখে প্রশয়ের হাসি মেখে বলল-
: দাদারে আদা পড়া শিখাইতে আইছুইন! কুনু লাভ অইব না। আমি আপনের মতো টেলিভিশনে শুধু সিনেমা লইয়া পইড়া থাকি না। আমি টেলিভিশনে খবর দেখি, টক শো শুনি। চুলায় যে গ্যাসের চাপ নাই- এই খবর তো আপনে আমার কাছেই পাইছুইন। ঠিক কি না?

লেখক: সাংবাদিক, রম্যলেখক।
[email protected]

এইচআর/এমএস