ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

হিজাব কিংবা খোলামেলা থাকা দুটোরই স্বাধীনতা থাকা উচিত

মাসুদা ভাট্টি | প্রকাশিত: ১০:৫৩ এএম, ০৭ জুন ২০২২

বাংলাদেশে একটি ঘটনা ঘটে এবং তা নিয়ে কিছুদিন আলাপ চলে পক্ষে-বিপক্ষে এবং তারপর কোনো রকম সিদ্ধান্ত কিংবা সমাপ্তি ছাড়াই দ্রুত আরেকটি ঘটনা নিয়ে আলোচনার মোড় ঘুরে যায়। একটি ছোট্ট দেশে ১৬-১৭ কোটি মানুষের বসবাস, এখানে মানুষের জন্ম এবং মৃত্যুর মতোই ঘটনার জন্ম এবং মৃত্যুও আলোড়নহীন এবং ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনাও মানুষের কাছে সমানমাত্রায় সহনীয়।

গণমাধ্যম যে বিষয়টিকে আলোচনায় নিয়ে আসে তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সোশ্যাল মিডিয়ায়ও কোনো আলোচনাই স্থায়ী হয় না। সেটা বড় কোনো দুর্ঘটনা হোক কিংবা ভয়ঙ্কর কোনো সামাজিক বৈষম্য হোক। মানুষ আসলে কোনো কিছুতেই দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না, তা সে যতো বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই হোক না কেন। অথচ কিছু কিছু ঘটনা রয়েছে, যা নিয়ে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন এবং এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণও জরুরি। আজ এমনই একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই, আর সেটি হলো নরসিংদী রেলস্টেশনে ঘটে যাওয়া নারী অবমাননার ঘটনা।

একটু দেরিতে আলোচনার সুবিধে হলো, বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা দেখে ও জেনে-বুঝে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া যে তরুণীকে এই রেলস্টেশনে হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে তিনি বুদ্ধিমান এবং দেশের আলোচিত একটি বিদ্যায়তনের ছাত্রী। ফলে তিনি তার পোশাক বিষয়ে সচেতন এবং তিনি খুব ভেবেচিন্তে পোশাক নির্বাচন করেন বলেই আমরা ধরে নিতে চাই। ফলে যে পোশাকের জন্য তাকে হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে তা নিয়ে তার কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না বলেই তিনি রাস্তায় বেরিয়েছেন এবং বন্ধুদের সঙ্গে গেছেন নরসিংদীতে।

একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক নিজ দেশের ভেতর ভ্রমণ করবেন তাতে তিনি কোনো প্রকার হেনস্তার শিকার হবেন না, এটাই সভ্য দেশের দস্তুর। কিন্তু না, এই তরুণী শুধু হেনস্তার শিকার হয়েছেন তাই-ই নয়, তাকে শারীরিক আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে এবং তিনি তার জীবনে এই ‘পাবলিক হ্যারাসমেন্ট’র ট্রমা বা ভীতি থেকে কখনও বের হতে পারবেন বলে মনে হয় না। অর্থাৎ তার মানসিকতায় একটি স্থায়ী ভীতি তৈরি হয়েছে এবং এ ক্ষতি অপূরণীয়। অন্য কোনো সভ্য দেশ হলে তিনি এই ক্ষতিপূরণের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে পারতেন এবং রাষ্ট্র তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হতো।

আমরা দেখতে পেলাম যে, একদল মানুষ আলোচ্য এই তরুণীর পোশাক নিয়ে তাকে কটাক্ষ করে তার ওপর হামলা করছে। তরুণীর সঙ্গী পুরুষকেও হেনস্তা করছে এবং তাকেও শারীরিক ভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে। এই খবর দ্রুত গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং এ ঘটনার বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ঘটনার পক্ষে ও বিপক্ষে দুটি দল তৈরি হয় এবং এখনও যেহেতু এদেশে আইন-আদালত রয়েছে, সরকার যেহেতু কখনও কখনও জনমতকে ধর্তব্যে নেয়, সেহেতু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়ে প্রথমে একজন পুরুষ আক্রমণকারীকে গ্রেফতার করে এবং পরে তার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মার্জিয়া নামের এক নারীকে গ্রেফতার করে।

এই গ্রেফতারের ঘটনায় দেশে-বিদেশে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রশংসিত হলেও যারা এ ঘটনায় আক্রান্ত তরুণীকেই দোষী মনে করেন তাদের পক্ষ থেকে পাল্টা সমাবেশ করে গ্রেফতারকৃত মার্জিয়ার মুক্তি দাবি করেন। ফলে এখন নরসিংদীর ঘটনায় স্পষ্টতই দুটি পক্ষ লক্ষ্যমান, যারা মনে করেন যে, বাংলাদেশে পোশাকের স্বাধীনতা থাকবে না অর্থাৎ কেউ বা আরও স্পষ্ট করে বলা ভালো কোনো নারী তার ইচ্ছামাফিক পোশাক পরে রাস্তায় বের হতে পারবেন না।

আরেকপক্ষ এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলতে চাইছে যে, হিজাব পরা যদি ব্যক্তি স্বাধীনতা হয় তাহলে হিজাব না পরা অথবা ইচ্ছেমতো যে কোনো পোশাক পরারও স্বাধীনতা থাকতে হবে। এরই মধ্যে আদালতের এক রায়েও বলা হয়েছে যে, হিজাব পরার স্বাধীনতা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে আদালত অন্য কোনো পোশাক পরার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা নিয়ে কিছু বলেননি। বাংলাদেশে হিজাব পরার কারণে কোথাও কেউ হেনস্তার শিকার হয়েছে বলে জানা নেই, ভারতে এরকম বিতর্ক শুরু হলেও বাংলাদেশে এটা হয়নি, যদিও বলা হচ্ছে যে, হিজাব পরতে বাধা দেওয়ার কারণেই কোনো সংক্ষুব্ধ পক্ষ আদালতের দ্বারস্থ হলে আদালত এ সিদ্ধান্ত দেন।

এখন তবে এমন কাউকে আদালতে গিয়ে বলতে হবে যে, বাংলাদেশে যে কোনো নারী তার ইচ্ছেমতো পোশাক পরে বাইরে যেতে কেন পারবেন না সে বিষয়টি আদালতকে স্পষ্ট করে দিতে হবে? কিংবা নারী কোন পোশাক পরে বাইরে বেরুতে পারবেন আর কোন পোশাক পরে পারবেন না সেটিও তাহলে আদালতকে বলতে হবে। নাহলে রাস্তাঘাটে আবারও কোনো তরুণীকে পোশাকের কারণে হেনস্তা হতে হবে এবং এ নিয়ে শুধু পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা সমালোচনাই সার হবে, সিদ্ধান্ত কিছুই হবে না।

আমাদের সংবিধানে স্বাধীন নাগরিক সত্তার ওপর জোরারোপ করা হয়েছে। ফলে আদালত নিশ্চয়ই নারীর এই স্বাধীন সত্তার বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না, কারণ তা হবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই সংঘর্ষ নিশ্চয়ই কাম্য হতে পারে না। ফলে আমরা এটা ধরে নিয়েই এগোতে চাই যে, বাংলাদেশের নাগরিকের পোশাকের স্বাধীনতা রয়েছে। এক্ষেত্রে সমাজ হয়তো একটি ‘শালীন’ বা ‘অশালীনের’ প্রশ্ন তুলতে পারে কিন্তু সেটাও ধর্তব্য নয় কারণ একজনের চোখে যা শালীন আরেকজনের চোখে তাই-ই অশালীন হতে পারে।

যেহেতু এর কোনো সঠিক নির্ণায়ক নেই, তাই ব্যক্তি নিজে যা শালীন মনে করবেন সেটি পরেই তিনি পথে বের হবেন। আর ব্যক্তি নিজে যাকে অশালীন মনে করবেন তা তিনি পরবেন না। কিন্তু অন্য যদি সেটা পরে? সেক্ষেত্রে কী হবে? সেক্ষেত্রেও তিনি এ বিষয়ে নিজের মতামতকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেবেন না। শালীন কিংবা অশালীন নির্ণয়ের দারভার তাকে কেউ দেয়নি এবং এ বিষয়ে অন্যকে জ্ঞান দেওয়া, হেনস্তা করা কিংবা শারীরিক আক্রমণের অধিকারও তিনি রাখেন না। বরং এসব যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ সেটিই রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনে পোশাকের কারণে তরুণী আক্রান্ত হওয়ার পর গ্রেফতারদের শাস্তি এজন্যই নিশ্চিত করা জরুরি যে, এই আক্রমণের ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারতো, ‘মব’-কে খেপিয়ে তুললে তরুণী গণপিটুনির শিকার হতে পারতো এবং হয়েওছে তাই। ভিডিওতে দেখা গেছে যে, মার্জিয়া বার বার অকথ্য ভাষায় তরুণীকে গাল দিচ্ছে এবং তাকে কোণঠাসা করে ফেলছে এবং মার্জিয়ার সঙ্গে আরও কিছু লোকজন যুক্ত হয়ে তরুণীকে আক্রমণ করছে। তরুণী ভয় পেয়ে স্টেশনমাস্টারের রুমে গিয়ে আশ্রয় নিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারছেন না। এই ভীতি এবং আক্রমণ যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ তা কাউকে বলে দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তবে যারা মার্জিয়ার মুক্তি চাইছেন তারা বিষয়টি জানেন না বলেই লেখাটিতে আবার সেটি মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে।

বাংলাদেশে একটি ধর্মবাদী রাজনীতি রয়েছে, যার শিকার সব সময় আসলে নারী, এক্ষেত্রেও সেই রাজনীতিকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি। ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীর পোশাককে অশালীন আখ্যা দিয়ে একদল মানুষ এগিয়ে এসে নারীকে আক্রমণ করে, কখনও মৌখিক, কখনও শারীরিক এবং অনেক সময় সেটা পরিবার ও সমাজ পর্যন্ত গড়ায়। ঢাকা শহরে তো বটেই ঢাকার বাইরেও নারীকে এই পোশাকের জন্য আক্রমণের শিকার হওয়ার ঘটনা আকছার ঘটে এবং ঘটছে। এই ভীতি নারীকে ঘরবন্দি করেতো বটেই, বরং নারীর শিক্ষাদীক্ষা এবং পেশাজীবী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও বিশাল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এদেশে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে বলে আমরা মাঝে মাঝেই আনন্দ করি কিন্তু ক্ষমতায়নের পথে এই পোশাক-রাজনীতি যে কত ভয়ংকর একটি বাধা তা এদেশের নারীমাত্রই জানা আছে। এখানে পুরুষের পক্ষে এর গভীরতা অনুধাবন মোটেও সম্ভব নয়।

উপজেলা কিংবা জেলা শহরে জন্ম নিয়ে রাজধানী শহর পর্যন্ত আসতে একজন নারীকে কতটা মূল্য চুকাতে হয় তা জানা থাকলে পুরুষ মাত্রেরই লজ্জা পাওয়ার কথা, কিন্তু সে লজ্জা পুরুষের যেমন নেই তেমনি আমরা দেখতে পাই যে, পুরুষতন্ত্রের নর্দমার মধ্যে বড় হওয়া নারীর মধ্যেও সে লজ্জাবোধ তৈরি হয়নি। পুরুষের বেঁধে দেওয়া গণ্ডির ভেতর নিজে যেমন ঢুকে বসে আছে তেমনই অন্যকেও টেনে নিতে চায় এসব নারীরা। তারা এটা বুঝতে চান না যে, তিনি বাধ্য হয়েই হোক কিংবা স্বেচ্ছায়ই হোক যে পোশাকটি তিনি পরেছেন সেটা যেমন তার ‘চয়েস’ কিংবা সম্প্রতি আদালতের দেওয়া নির্দেশমতে তার ‘অধিকার বা স্বাধীনতা’ তেমনই পাশের নারীটি যা পরেছেন সেটাও সেই নারীর ‘চয়েস’, অধিকার কিংবা স্বাধীনতা।

তিনি যদি হিজাব পরার জন্য আক্রান্ত না হতে চান তাহলে তার মতে ‘অশালীন’ বা ‘খোলামেলা’ পোশাক পরিহিতা নারীটিরও অধিকার আছে এগুলো পরে নিশ্চিন্তে চলাফেরার। পোশাকের জন্য কোনো পক্ষই যদি কারও দ্বারা আক্রান্ত হন তাহলে সেটা ফৌজদারি অপরাধ এবং রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনেই তার জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। এটুকু বুঝলেই কিন্তু নরসিংদীর মতো ঘটনা এদেশে আর ঘটবে না কোনোদিন। প্রশ্ন হলো, এদেশের পোশাক-রাজনীতি কিংবা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কিংবা পুরুষতন্ত্রের জঠরে বেড়ে ওঠা নারী-পুরুষরা সেটা বুঝবেন কি না। বুঝলে ভালো, না বুঝলে মার্জিয়ার মতো আইনি শাস্তির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখাও উচিত হবে তাদের।

ঢাকা ৬ জুন, সোমবার ২০২২
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/জেআইএম