ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

কেন এত হতাশা?

শান্তা মারিয়া | প্রকাশিত: ১০:১০ এএম, ০৫ জুন ২০২২

একজন মানুষ বহুতল ভবনের ছাদ থেকে লাফ দিচ্ছে শূন্যের দিকে। সে পড়ছে কঠিন মাটিতে। ওই লাফ দেওয়ার মুহূর্ত আর কঠিন ভূমি স্পর্শ করার মুহূর্ত এর মাঝখানে হয়তো তিন-চার সেকেন্ডের ব্যবধান। ওই তিন-চার সেকেন্ডের কথা একটু ভাবুন। কি ভয়াবহ আতংক, কি ভয়ানক যন্ত্রণা। হয়তো এরই মধ্যে তার মনে হচ্ছে এই আমি কী করলাম!

সত্যিই এ কি করছে আমাদের সন্তানরা? রাজধানীর বহুতল ভবন থেকে লাফ নিয়ে আত্মহত্যাকারী ঢাবি ছাত্রীর মৃত্যুর খবরটি পড়ার পর থেকে মাথায় একই কথা ঘুরছে। কিছুদিন আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার কথাও মনে পড়ছে। আরও মনে পড়ছে চেনা জানা অসংখ্য মানুষের আত্মহত্যার করুণ ঘটনা।

আমার যখন ষোল-সতের বছর বয়স তখন এক সহপাঠী বন্ধু আত্মহত্যা করে গলায় ফাঁস দিয়ে। এর কাছাকাছি সময়ে আমারই বয়সী আরেক পরিচিত মেয়ে কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করে। আমি সেই বয়সে প্রায়ই ওদের কথা ভাবতাম। জানতে ইচ্ছা করতো কেন কি সেই কষ্ট, যা থেকে একজন অকালে বেছে নেয় মৃত্যুর পথ।

আমার তরুণ বয়সে চেনাজানা অনেকের আত্মহত্যার পেছনে ছিল প্রেম। সর্বনাশা প্রেম। হয়তো কারও প্রেমিক বা প্রেমিকা সম্পর্কের অবসান ঘটিয়েছে, প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেছে অন্যত্র কিংবা প্রেমিক আগের নারীকে ত্যাগ করে দ্বিতীয় নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছে।

এসব কারণে আত্মহত্যাকারী তরুণ-তরুণীদের বাবা-মায়ের আহাজারি শোনার দুর্ভাগ্যও হয়েছে অনেক। তখন একটি প্রশ্নই জেগেছে যে প্রেমিক-প্রেমিকা তোমাকে ছেড়ে অন্যত্র চলে গেল তার প্রতি ভালোবাসা অথবা ঘৃণা তোমার এতই বেশি হয়ে গেল যে তুমি ভুলে গেলে তোমার প্রতি বাবা-মা, ভাইবোন, বন্ধু এবং আরও সবার ভালোবাসা।

বাবা-মায়ের প্রতি অভিমানে আত্মহত্যা করতেও দেখেছি। সাংবাদিক হওয়ার একটি দুর্ভাগ্য হলো অনেক দুঃখজনক ঘটনার সংবাদ লিখতে হয়, জানতে হয়, রিপোর্ট করতে হয়। লিখিত সংবাদের সাংবাদিকের কোনো আবেগ প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু মনের ভিতরটা ক্ষত-বিক্ষত হয়।

এখানে বাবা-মা এবং অভিভাবকদের প্রতিও আমার কিছু বলার আছে। অধিকাংশ অভিভাবক সন্তানকে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জনের জন্য অনেক মানসিক চাপের মধ্যে রাখেন। শুধু লেখাপড়া নয়, নাচ গান ছবি আঁকা, ক্রিকেট খেলা সব কিছুতে সেরা হওয়ার জন্য তাদের প্ররোচিত করেন। কিন্তু সবাই তো সেরা হওয়ার জন্য জন্মায় না।

সবার ক্ষমতাও একরকম নয়। প্রত্যাশা যদি থাকে অনেক বেশি তাহলে বেশ খানিকটা প্রাপ্তিও অনেক কম বলে মনে হতে পারে। ‘অমুকের ছেলেমেয়ে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে, তোমাকেও পেতে হবে।’ ‘অমুকে বুয়েট, মেডিকেলে চান্স পেয়েছে, তুমি পাওনি, তুমি ব্যর্থ’ এসব কথা অনেক অভিভাবক বলেন। এগুলোও ছেলেমেয়েদের মনে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি করে। অনেকেই সন্তানকে শুধু সফল হওয়ার শিক্ষা দিচ্ছেন। কিন্তু ব্যর্থতাকে সহজভাবে মেনে নেওয়ার শিক্ষা দিচ্ছেন না।

অনেক সময় ব্যর্থতাকেও সেলিব্রেট করতে হয়। বলতে হয় আজকের ব্যর্থতাই কালকের সফলতার ভিত্তি। চলো আজকের ব্যর্থতাকেই সেলিব্রেট করি। সন্তানকে সাফল্য অর্জনে অনুপ্রাণিত করার পাশাপাশি ব্যর্থ হলে সেটাকে গ্রহণ করার জন্যও প্রস্তুত করতে হয়। শুধু লেখাপড়ার ব্যর্থতা নয়, প্রেমের ব্যর্থতাও যেন সে মেনে নিতে শেখে সেটাও দেখতে হবে।

আরও আছে মনের ওপর জোর খাটানোর প্রবণতা। হয়তো দেখছেন আপনার ছেলে বা মেয়েটি ভুল মানুষের প্রেমে পড়েছে। তখন তাকে কঠোরভাবে বাধা না দিয়ে কিংবা জোর করে সেই ব্যক্তির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা না করে সময় নিন। তার মনকে অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করুন। আপাতত তার পছন্দকে মেনে নিয়ে তাকে জীবন গড়ে তোলার পরামর্শ দিন। একপর্যায়ে তারা নিজেরাই ভুল বুঝতে পারবে।

আজকাল প্রায়ই দেখছি এবং শুনছি হতাশা ও বিষণ্ণতায় আত্মহত্যার কথা। বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন যে একটা রোগ এটা এখন অনেকেই জানেন। শুধু রোগ নয়, একটা ভয়াবহ রোগ যা মানুষকে ভিতর থেকে একদম শেষ করে দেয়। বিশ্বজুড়েই মানুষের ভিতর বিষণ্ণতা ক্রমশ বাড়ছে। আমার কাছে মনে হয়, মানুষে-মানুষে সরাসরি যোগাযোগের অভাবে হতাশা ও বিষণ্নতার সৃষ্টি হচ্ছে বেশি মাত্রায়। কারণ ভার্চুয়াল যোগাযোগ আর অ্যাকচুয়াল যোগাযোগ কখনও এক হতে পারে না। মানুষ শুধু কথা দিয়েই যোগাযোগ করে না তার সঙ্গে রয়েছে দৃষ্টি, স্পর্শ, বডি ল্যাংগুয়েজ। ভার্চুয়াল সহানুভূতি এবং অ্যাকচুয়াল সহানুভূতির মধ্যে অনেক পার্থক্য। আরও রয়েছে স্যোশাল মিডিয়ার প্রতিযোগিতা।

ফেসবুকে যখন দেখি একজন মানুষ দিব্যি দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে, দামি রেস্টুরেন্টে খাবার খাচ্ছে, রংবেরঙের পোশাক পরছে, এখানে সেখানে পুরস্কার-সম্মাননা পাচ্ছে তখন নিজেকে মনে হয় ব্যর্থ। কিন্তু আমরা ফেসবুকে একজন মানুষের খণ্ডিত জীবন দেখি। ওই আপাত সফল মানুষটিরও যে হতাশা, ব্যর্থতা অসুখ-বিসুখ আছে সেটা কিন্তু আমরা টের পাই না। তারও যে বাড়িতে মেজাজ খারাপ হয়, তরকারিতে নুন কম পড়ে, বসের কাছে ধমক খেতে হয়, সহকর্মীর বিদ্রুপের শিকার হতে হয় সেগুলো আমরা দেখতে পাই না। ফলে এক ধরনের সুপারম্যানের সঙ্গে আমরা নিজেদের তুলনা করে হতাশায় ভুগতে শুরু করি।

আজকালকার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া নিয়ে যেমন প্রবল চাপের ভিতর থাকে, তেমনি তাদের অনেকটা সময় কাটে ভার্চুয়াল জগতে। আবার ফ্যাশন সামগ্রীর অতিরিক্ত প্রদর্শনী, প্রচার, লাইভ স্ট্রিমিং এবং সেটা সবসময় কিনতে না পারাও মনের মধ্যে এক ধরনের বিষণ্ণতা ও হতাশা সৃষ্টি করে। বিষণ্ণতা নিয়ে বেশ কিছু প্রচলিত ধারণা রয়েছে। যেমন মনে করা হয় এটি দুর্বল মনের লক্ষণ।

আবার মনে করা হয় যারা মুখে আত্মহত্যার কথা বলে তারা কখনও আত্মহত্যা করে না। আবার মনে হতে পারে অলসতার কারণে বিষণ্ণতা হয়েছে, ঘাড়ে কাজ চাপালে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিংবা মনে করা হয় বিয়ে দিলে বিষণ্ণতা কেটে যাবে ইত্যাদি। তবে এ ধারণাগুলো ভুল। এই ধারণাগুলো থেকে বের হয়ে আসা খুব জরুরি। বিষণ্ণতা হতে পারে ধনী-গরিব-মধ্যবিত্ত-শিক্ষিত-অশিক্ষিত-সব শ্রেণি, পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতার নারী-পুরুষের।

অনেক পরিবারে বিষণ্ণতা ‘ন্যাকামি’ বা ‘ঢং’ বলে অভিহিত করা হয়। সাধারণত নারীদের বা টিনএজ ছেলেমেয়েদের এমন সমস্যায় অভিভাবকরা অনেক সময় কড়া ব্যবহার করেন, যা রোগীকে আরও অসহায়ত্বের মধ্যে ঠেলে দেয়। মুশকিল হলো বিষণ্নতার এই রোগটির চিকিৎসা কেবল ওষুধ নির্ভর নয়। অনেকটাই কাউন্সেলিংনির্ভর। কাউন্সেলিং দেওয়ার মতো যথেষ্ট সংখ্যক মনোচিকিৎসক বাংলাদেশে নেই। জাতীয় বাজেটে মানসিক চিকিৎসা খাতের বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অনেকই কম।

ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা নামের ভয়াবহ রোগটি থেকে তরুণ প্রজন্মকে বাঁচানো দরকার। কারণ যারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তারা যদি শারীরিক ও মানসিকভাবে স্বাস্থ্যবান না হয় তাহলে কীভাবে আমরা দেশের সুন্দর ভবিষ্যৎ আশা করতে পারি? আগেও বলেছি আবার বলছি, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং কলে কারখানায়, অফিসে, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন কাউন্সেলিং সেন্টার। ছাত্র শিক্ষকদের মানসিক সাহায্য, পরামর্শ দেওয়ার জন্য কাউন্সেলিং সেন্টারে প্রশিক্ষিত কর্মী থাকতে হবে। নিয়মিত স্বাস্থ্য চেকআপের পাশাপাশি মানসিকভাবে কেউ কোনো অস্বস্তিতে ভুগছে কি না সেটিও যদি চেকআপ হয়, পরামর্শ দেওয়া হয় তাহলে অনেক অপমৃত্যু আমরা রোধ করতে পারব।

ফিরে আসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছাত্রী আত্মহত্যা করলো তার কথায়। সে তার সুইসাইড নোটে লিখেছে তার জীবন একটি ব্যর্থ জীবন। মাত্র ২২ বছর বয়সেই জীবনের কতটুকু দেখে তার মনে হলো জীবন ব্যর্থ? জীবন তো অমিত সম্ভাবনাময়। আজ যাকে মনে হচ্ছে কেবল বিফলতাময় কালকে যে সে সফল হবে না সেটা কি কেউ বলতে পারে। যতক্ষণ বেঁচে থাকা ততক্ষণই আশা। এই আশার কথা, স্বপ্নের কথা, জীবনের মাধুর্যময় দিকের কথা, বেঁচে থাকার আনন্দের কথা তরুণ প্রজন্মকে জানাতে হবে। কোনো তরুণ জীবন যেন হতাশায় ঝরে না যায় সেই প্রত্যাশাই করি।

লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এমএস