ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

গাফ্‌ফার চৌধুরীর চলে যাওয়া এবং স্মৃতিকথন

ড. মাহবুব হাসান | প্রকাশিত: ১০:০৩ এএম, ০২ জুন ২০২২

সাংবাদিকতায় কিংবদন্তিতুল্য আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর মরদেহ জাতীয় প্রেসক্লাবে আসে বিকেল চারটার পনেরো মিনিট আগে। আমি তার নামাজে-এ জানাজায় অংশ নিতেই গিয়েছিলাম প্রেসক্লাবে। সে-দিনই ছিলো কবি ও গীতিকার কেজি মোস্তাফার স্মরণসভা। আমি শ্রোতার আসনে বসে মনে মনে তাঁর (কেজি মোস্তাফা) প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানালাম। আর অপেক্ষা করছিলাম গাফফার ভাইয়ের শবাধারের জন্য।

গাফ্‌ফার ভাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয় নিয়ে ভাবনাগুলো মিছিল করে আসছিলো। আমি তখন দৈনিক যুগান্তরে সদ্যই যোগ দিয়েছি। সহকারী সম্পাদক হিসেবে। সম্পাদক গোলাম সারওয়ার আমাকে ডেকে বললেন, তুমি প্রতি সপ্তাহে গাফ্‌ফার ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করবে এবং তার কাছে থেকে লেখা আনবে। আমি প্রতিসপ্তাহে ফোন করি আর লেখার তাগিদ দিই। তিনি লেখা শেষ হলে আমাদের ফ্যাক্সে পাঠান। এভাবেই চলে আমার যুগান্তরে কর্মজীবনের আট/ নয় বছর।

আমি অ্যাসোসিয়েট এডিটর হিসেবে পদোন্নতি পেলেও কয়েকমাস ওই দায়িত্ব পালন করেছি। তার পর অন্য একজন সেই দায়িত্ব নেন। এই সময়কালের মধ্যে একবার তিনি ঢাকায় আমাদের অফিসে আসেন। সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের রুমে আমরা সবাই উপস্থিত। তিনি সারওয়ার ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন—তোমাদের মাহবুব সাহেব কই?

সারওয়ার ভাই হেসে বললেন আপনার ডানপাশেই তো বসে আছে। তিনি ফিরলেন তার পাশের চেয়ারের দিকে। আমাকে দেখে বললেন, আরে আপনি তো ছেলে মানুষ। আমি ভেবেছিলাম আপনার বয়েস অনেক। আমি একটু হাসলাম। টেলিফোনে আপনার গলা বেশ ভারী শোনায়। বিনয়ের ভঙি করলাম। তিনি অনুমোদন করলেন।

পরে, আরো একবার তিনি এসেছিলেন ঢাকায়। সেবারও তিনি এসেছিলেন আমাদের অফিসে। তখন সরকার যমুনা টিভির জন্য পারমিশন দিচ্ছিলো না। গাফ্‌ফার ভাই যাতে এ-ব্যাপারে ইনফ্লুয়েন্স করেন, সে-জন্য তাকে ব্রিফিং দেয়া এবং টিভির সেটআপ দেখানো এবং মালিক নূরুল ইসলাম বাবুলের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছিলো। আজকে যুগান্তর যে অফিস ব্যবহার করছে, তার নিচতলায় যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যানের অস্থায়ী অফিস। সেখানেই তিনি এলে আমি রিসিভ করি গাফ্‌ফার ভাইকে। নিয়ে যাই চেয়ারম্যানের রুমে। দুপুরের পর আমি চলে আসি আমাদের কমলাপুরের অফিসে। কারণ সম্পাদকীয় পাতার কাজ পড়েছিলো।

স্মৃতি রোমন্থন ভালো, তাতে নিজেকে পুনরায় উদ্দীপ্ত করে তোলা যায়। আমার স্মৃতি চলচ্চিত্রিক ঢঙে পাখা মেলছিলো। কিন্তু তাতে বাদসাধলেন আয়োজকগণ। শুরু হলো জানাজা নামাজের প্রাক-অনুষ্ঠান। আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর জানাজা নামাজের আগে প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ও সেক্রেটারি ইলিয়াস খান তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বক্তব্য দেন। আর উপস্থিত বিভিন্ন মিডিয়া হাউজের সম্পাদক ও সাংবাদিক নেতাদের নাম ঘোষণা করা হয়। সেখানে জাতীয়তাবাদী সাংবাদিকদের ভিন্ন ফোরাম নেতাদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু তাদের নাম বলা হয়নি। মনে হচ্ছিল দেশে একটিই সাংবাদিকদের সংগঠন ও ফেডারেশন আছে। এটা দুঃখজনক।

স্বাধীনতার পর গাফ্‌ফার ভাইয়ের সম্পাদনায় বেরোয় দৈনিক জনপদ। সেখানে নিউজ এডিটর হিসেবে যোগ দেন বামধারার সাংবাদিক কামাল লোহানী। আমি সে সময় কামাল লোহানীর কাছে সাব এডিটরের চাকরির জন্য গেছিলাম। আমার অগ্রজ ড. মাহবুব সাদিক একটি চিঠি লিখে দিয়েছিলেন। তিনি লোহানী ভাইয়ের ঘনিষ্ট ছিলেন। ধরেই নিয়েছিলাম যে আমি অ্যাপ্রেনটিস হিসেবে কাজ পাবো এবং যৎসামান্য বেতনও পাবো, যা আমার ছাত্রজীবনের খরচ নির্বাহে সহায়ক হবে। আমি লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম, একজন দীঘল-পাগল লোক এলেন।

তিনি কি কথা যেন বলতে এসেছিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এ কি চায়? লোহানী ভাই বললেন চাকরি। সাবিং শিখতে চায়। সেই লম্বাটে লোকটি বললেন, এখন তো হবে না, এখনো আমরা গুছিয়ে নিতে পারিনি। তিন মাস পর এসো। লোহানী ভাই বললেন, হ্যা, তিন মাস পর এসো। আমি সালাম দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখলাম কবি আবুল হাসানকে। তিনি আমাকে ইশারায় ডাকলেন। আবুল হাসান মাহবুব সাদিকের বন্ধু এবং তিনি আমাকে ভালোভাবেই চেনেন। আমার কবিতা ছাপার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে-শুদ্ধ কবি আহসান হাবীবের কাছে।

আমি হাসান ভাইয়ের সঙ্গে গিয়ে চা খেলাম। আরো বহুবিদ আলাপ হলো। ওই দীঘল-পাগল লোকটি যে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী, জানলাম কবি আবুল হাসানের কাছ্ তিনি তখন সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করেন। অচেনা আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়, কিন্তু অপরিচয়ের পর্দা না উঠিয়েই। লোকে তাকে চেনে, পাঠক তাকে চেনে, দেশের শাসকরা চেনে আর আমরা যারা নবীন কবিতাকর্মী তাঁকে চিনি বিশিষ্ট সাংবাদিক হিসেবে। আমিও চিনলাম। তার লেখা পড়ি, তাঁর গুণ উপভোগ করি, তাঁর গাল্পিক চরিত্র বুঝতে পারি। তখনো জানি না, তিনি একজন ভালো মানের গল্পকার। সেটা কেবল শুনেছি যে গাফ্‌ফার চৌধুরী গল্পকার।

২০০২-এ প্রকাশিত আমার শতবর্ষের গল্প সংকলন বের করার আগে পড়েছি প্রয় আড়াই হাজার গল্প, সেখানে গাফ্‌ফার ভাইয়েরও কয়েকটি ছিলো। তিনি যে অমর গানটি লিখেছেন -‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি?’ তখনো ব্যাপকভাবে গীত হয় না ঢাকার অনুষ্ঠানগুলোতে। আমরা সেটা আরো পরে, ৮ এর দশকে হৃদয় দিয়ে গাইতে থাকি আর অনুভব করতে থাকি গণতন্ত্রহীনতা কতোটা বেদনার কতোটা শ্বাসরুদ্ধকর। কেন না, সেটা হয়েছিলো স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত গণতান্ত্রিক চেতনার রোপন-সময় ও বিকাশের গান বা হাতিয়ার।

তিনি সেই গানের রচয়িতাই কেবল হয়ে থাকলেন না, যেন তিনিই মূর্ত করে তুললেন জীবনে ওই জয়গান। সুরকার আলতাফ মাহমুদের অনবদ্য সুরের গুণেই লোকস্নাত হয়েছে ওই গান। আমরা এই গানটিকে গণমননের সোপান হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমাদের গণতান্ত্রিক চেতনার শেকড় ভাষা আন্দোলনে নিহিত, আর এই গান সেই প্রবাহের প্রধানতম স্রোত। এ-কারণেও আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ও শহীদ আলতাফ মাহমুদ জাতির সূর্যসন্তান হিসেবে বরিত হয়েছেন এবং থাকবেন চিরকাল।

লেখক: কবি, সিনিয়র সাংবাদিক।

এইচআর/এএসএম

আরও পড়ুন