ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

‘বাংলাকে ইসলামাইজড করতে রেডিও পাকিস্তানে বাংলা খবর পড়া শুরু হয়’

মুনতাসীর মামুন | প্রকাশিত: ০৯:৫৭ এএম, ২৩ মে ২০২২

গত চার দশকে যখনই লন্ডন গেছি তখনই আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি আমার বাবার সঙ্গে চাকরি করেছেন। আমার বড় চাচা প্রয়াত বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কৈশোরের বন্ধু। আমাকে দেখেছেন জন্ম থেকেই। সুতরাং আমি তাঁর স্নেহের পাত্র। কিন্তু তাঁর গুণেই আমাদের সম্পর্কটা হয়ে গেছে বন্ধুর মতো।
আমি অনেকদিন তাঁকে বলেছি, একটি স্মৃতিকাহিনি লেখার জন্য। এর অনেকটাই তিনি লিখেছেন। প্রকাশিতও হয়েছে কাগজে। এসব মিলিয়ে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করা এখনও তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।

২০০১ সালের এপ্রিলে লন্ডনে গিয়েছিলাম কয়েকদিনের জন্য। তখন ঠিক করি তাঁর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করব। প্রথাগত সাক্ষাৎকার নয়। আমাদের সংস্কৃতির আন্দোলনকে সামনে রেখে পঞ্চাশ দশকের কথা জানতে চাইব। অন্য কথায় এই সাক্ষাৎকারটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসের উপাদান।

সময়ের টানাটানি আমাদের দুজনেরই ছিল। তবে, আমার অনুরোধ তিনি উপেক্ষা করেননি। ২৮ এপ্রিল থেকে ৩১ এপ্রিল (২০০১) এই তিন ঘণ্টার একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। তারই অংশ এখানে প্রকাশিত হলো।
(ক্যাসেট থেকে অনুলিখন করেছেন জামালউদ্দিন ও শরীফা বুলবুল)
২৮ এপ্রিল শনিবার ২০০১ আজকের আলোচনায় আমরা প্রধানত জনাব চৌধুরী’র কাছে কয়েকটি বিষয়ে বিশেষভাবে জানতে চাইব। একটি হচ্ছে পঞ্চাশের সাহিত্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন, তার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বিশেষ করে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন, তাঁর সেই বিখ্যাত গানের রচনাকাল, এরপর সাংবাদিক হিসেবে তিনি ’৭১ সাল পর্যন্ত যে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেটি, তৃতীয় পর্বে আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর যে যোগাযোগ ছিল দীর্ঘকাল সে বিষয়ে আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করব।

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

মুনতাসীর মামুন: এটা কি পঞ্চাশ দশকের কথাই বলছেন আপনি? তার মানে ষাটের দশকে যে আমরা রবীন্দ্র বিরোধিতা দেখেছি তার আগে থেকেই এটা শুরু হয়েছে?

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী: জগন্নাথ কলেজের মিটিংয়ে প্রথম রবীন্দ্রনাথের ওপরে আক্রমণ হয়। সে আক্রমণের প্রতিবাদ করে মুস্তফা নুরউল ইসলাম এবং সৈয়দ আলী আহসানের সঙ্গে তার হাতাহাতি হয় জগন্নাথ কলেজের সেই সভায়। সেই মুস্তফা নুরউল ইসলাম কিন্তু পরে সৈয়দ আলী আহসানের সঙ্গে করাচিতে গিয়ে একসঙ্গে অধ্যাপনা করেছেন। কিন্তু ওই মিটিংয়ে রীতিমতো ধস্তাধস্তি হয়েছিল। ওতে সৈয়দ আলী আহসান ভয় পেয়েছিলেন। তারপর তো আজাদে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ভারতীয় সাহিত্যের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষাকে ইসলামাইজড করার জন্যে প্রচারণা শুরু হলো। যে রকম রেডিও পাকিস্তানের বাংলা খবর। বাংলাটা হচ্ছে- আজ রাজস্ব মন্ত্রী করাচি থেকে ঢাকায় আসবেন- আমাদের যে নুরুল ইসলাম আছে না বিবিসিতে তিনি নিউজ পড়তেন। ওকে দিয়েও পড়ানো হয়েছে এই কথা- আজ উজিরে খাজানা ঢাকা এত শরিফ আনবেন। আজাদে বিজ্ঞাপন বেরুত হরলিকসের। সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনি যদি দুর্বলবোধ করেন তাহলে এক গ্লাস হরলিকস পান করুন। সেটার বিজ্ঞাপন পাকিস্তানি বাংলা হলো ‘ফজরে উঠিয়া কমজোর মালুম হোনা তো একগ্লাস হরলিক্স পিয়ে নিন।’ ১৯৪৮ সালের আজাদ খুললে এগুলো পাবেন। তারপর তো প্রেসিডেন্ট সদরে বিয়াসদ, প্রজাতন্ত্রের নাম হয়েছিল জমহুরিয়াত। উজিরি আজম উজিরি আলা এইসব। বাংলা শব্দ খুব কম ছিল, সেসব শুরু হয়ে গেল। এমনকি হাস্যকর ব্যাপার ছিল- মাহবুব জামাল জাহেদী ছিল বিদ্রোহী গ্রুপে।

তার বাবা মিজানুর রহমান সাহেব ছিলেন একজন আইসিএস অফিসার বোধহয়। তিনি ছিলেন কট্টর পুরো উর্দুপন্থি। তাকে আবার মাহেনও’র সম্পাদক করে দেয়া হলো। পাকিস্তান একটা ডেসট্রয়ার কিনেছে। ডেসট্রয়ার কেনার পর মাহেনও-তে সেই ডেসট্রয়ারটার ছবি ছাপা হলো। মাহেনও-এর কভার ছবি, নিচে লেখা হয়েছে পাকিস্তানের সদ্য খরিদ করা একটি ‘তাবাক্কুল’ এই তাবাক্কুল কী? এই তাবাক্কুল হল ডেসট্রয়ার। এইটা নিয়ে মাহাবুব জামাল জাহেদী তার বাবাকে এমনভাবে লিখেছিল যে, ত্যাজ্যপুত্র হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। মানে তখন উর্দুমিশ্রিত বাংলা চালুর একটা সচেতন প্রয়াস-অবশ্য আগেও উর্দু মিশ্রিত বাংলা কবিতা, গল্প লেখা হয়েছে- যেমন নজরুল ইসলাম লিখেছেন, আমাদের মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ বাহার একটা ‘রাহিহো হালিম’ নামে সেই চল্লিশের দশকে একটা কলাম লিখতেন দৈনিক আজাদে উর্দু মিশ্রিত বাংলায়। সেগুলো ছিল অনেকটা ব্যঙ্গ রসাত্মক আলোচনা। কিন্তু সিরিয়াসলি ভাষাটাকে ইসলামীকরণের নামে উর্দু ফার্সির দ্বারা ভারাক্রান্ত করার সচেতন প্রচেষ্টা পাকিস্তান আমলে শুরু হয়। এদের ইচ্ছেই ছিল বাংলা ভাষাটাকে ধ্বংস করা। এই সময় এর প্রতিবাদে আবার একটা বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন শামসুর রাহমান। অনেকের সঙ্গে আমার দ্বিমত হলেও আমি বলব ভাষা আন্দোলন দ্বারা আমরা যতটা উপকৃত হয়েছি, যে বিদ্রোহ হয়েছিল ভাষা নিয়ে- সেই বিদ্রোহের সমসাময়িক যারা বড় বিদ্রোহ করেছেন তিনি শামসুর রাহমান। উনি তো রাজনীতিক ছিলেন না, রাজনীতি সচেতনও ছিলেন না। কিন্তু অনেক সময় বুদ্ধদেব বসুর একটা কথা আমার সত্য মনে হয় যে, কবিরা হচ্ছেন কালের পুতুল। কাল বা মহাকাল তাদের দিয়ে কী কাজ করিয়ে নেয় কবিরা অনেক সময় নিজেরা তা টেরও পান না।

শামসুর রাহমান সচেতনভাবেই হোক অসচেতনভাবেই হোক উনি বাংলা ভাষায় ঈশ্বর জল এসব শব্দ ব্যবহার করা শুরু করলেন। তার আগে ঈশ্বর শব্দ বাঙালি মুসলমানরা ব্যবহার করাই বর্জন করেছিল। বিশেষ করে ঈশ্বর-জল এমন শব্দ। এমনকি প্রগতিশীল মুসলমান সাহিত্যিকরাও, যেমন- শামসুদ্দিন আবুল কালাম, শওকত ওসমান, তারাও ব্যবহার করেননি। বাঙালি মুসলমানের ভাষা থেকে শব্দগুলো পরিত্যক্ত হয়েছিল। শামসুর রাহমান ১৯৫১ সালে ‘রূপালী স্নান’ নামে একটা কবিতা লিখলেন। তাতে এন্তার ঈশ্বর আরও স্বর্গ নরক বা যেটাকে তারা বলতো হিন্দুয়ানি বাংলা- পরিষ্কারভাবে তিনি ব্যবহার করলেন। কবিতাটি দেওয়া হরো সংবাদের সাহিত্য সাময়িকিতে প্রকাশের জন্য। তখন আরেকজন প্রগতিশীল ব্যক্তি আব্দুল গণি হাজারী ওই কাগজের সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন কিন্তু লেখাটি ছাপা হচ্ছে না। শামসুর রাহমান একদিন সওগাতের আড্ডায় বসে আমাকে বললেন যে, আমার একটা কবিতা আছে, সংবাদে ছাপা হচ্ছে না। তো আমি গেলাম আব্দুল গণি হাজারীর রুমে। আব্দুল গণি হাজারী বললেন যে, কী ব্যাপার কী জন্য এসেছ? আমি তো তখন সংবাদের ১০০ টাকা বেতনের সাব-এডিটর। আমি গিয়ে বললাম যে, আমার বন্ধু শামসুর রাহমানের কবিতাটা? আব্দুল গণি হাজারী বললেন, ছাপা হবে এত অস্থির হচ্ছে কেন তোমার কবি? তখন শামসুর রাহমান নাম করেননি এতটা, কথা বলে সম্পাদক খায়রুল কবির তাকে কি জন্য যেন ডেকেছেন উনি সেখানে গেলেন। আমি দেখি ওনার ফাইলে শামসুর রাহমানের ‘রূপালী স্নান’ এবং তার ভিতরে লাল কালি দিয়ে ঈশ্বর, স্বর্গ, নরক, দেবদূত এসব কথাগুলোকে লাল কালি দিয়ে দাগ দেওয়া। তখন আমি বুঝলাম এই শব্দগুলোর জন্য কবিতাটি রিজেক্টেড হয়েছে।

উনি সে কথা না বলে চুপ করে আছেন, লজ্জায় হোক বা যে কোনো কারণে হোক। উনি আসলে পরে আমি বললাম, হাজারী ভাই আপনি এই কবিতা তো ছাপাবেন না। তিনি বললেন, কে তোমাকে বলল ছাপব না? আমি বললাম, এই তো ফাইলের ভিতর। আমিও তখন একটু গোঁয়ার টাইপের ছিলাম আর কি। এখন তো একেবারে ভেড়া। তখন গোয়ার্তুমি নিয়ে তাকে যা-তা বলেছি। কিছু অপমানজনক কথা বলেছি। বলে বেরিয়ে এসেছি। পরদিন এডিটর খায়রুল কবির আমাকে শোকজ নোটিশ করলেন যে, আমি আব্দুল গণি হাজারীর সঙ্গে অভদ্রতা করেছি, আমাকে মাফ চাইতে হবে। আমি মাফ চাইতে অস্বীকার করলাম এবং সামারিলি ডিসমিসও হলাম সংবাদ থেকে। সেই ডিসমিসের জন্য বেশ কিছুদিন আমাকে কষ্ট করতে হয়েছে। যাহোক পরে এজন্য অনুতপ্ত হলাম যে খামাকা চাকরি হারালাম কেন আর তো দ্বিতীয় উপার্জনের কোনো পথ ছিল না, লিখেও টাকা পেতাম না। কিন্তু একটা অন্য কাজ হলো। সেটা হলো এই শামসুর রাহমানের লেখাটা সংবাদ থেকে প্রত্যাখ্যাত হলো বটে উনি সেই কবিতাটা বুদ্ধদেব বসুকে পাঠিয়ে দেন, আর তিনি শামসুর রাহমানকে চিঠি লিখে জানালেন, এটি একটি অনবদ্য কবিতা।

বহুকাল এত ভালো কবিতা আমার হাতে আসেনি। আমি কবিতাটি ছাপাবো ‘কবিতা’য়। কবিতায়, ‘রূপালী স্নান’ ছাপা হলো। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সমসাময়িক ঘটনার একটু আগে। এটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্নদা শংকরের স্ত্রী লীলা রায়, উনি শামসুর রাহমানকে চিঠি লিখে জানালেন, তুমি যদি অনুমতি দাও আমি এটা ইংরেজিতে অনুবাদ করতে চাই। বহুকাল আমি এত ভালো কবিতা পড়িনি। উনি ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন এবং সেটা একটা ইংলিশ ম্যাগাজিনে ছাপা হলো। শামসুর রাহমানকে নিয়ে তখন হৈ-চৈ। আর আমি সংবাদ অফিসে গিয়ে হাজারী সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, হাজারী সাহেব আপনি কি ‘রূপালী স্নান’ কবিতাটি আর ওই লীলা রায়ের ইংরেজি অনুবাদটা পড়েছেন? হাজারী তো বুঝলেন যে আমি খোঁচা মারছি। আমি বললাম, দেখেন আমার চাকরি গেছে। আমার এখন আর দুঃখ নেই। বহুদিন অর্থনৈতিক কষ্টে ছিলাম তা আমার চলে গেছে। এই যে শামসুর রাহমান আবার ঈশ্বরকে ফিরিয়ে আনলেন বাংলা সাহিত্যে। মুসলমানের দ্বারা রচিত বাংলা সাহিত্যে যিনি ঈশ্বরকে ফিরিয়ে আনলেন, স্বর্গ, নরক, দেবদূত, এসব তার কবিতায় ফিরে আসল। গ্রামের এই যে মক্কা মদিনার খেজুর গাছের বদলে ডাহুক, কলা গাছ, বাঁশঝাড় ফিরে আসল তার কবিতায় এটা আমার মনে হয় ভাষা আন্দোলনের সমসাময়িক আরেকটা আন্দোলন। তাঁকে অনুকরণ করে কায়সুল হক, ফজল শাহাবুদ্দিন, আরেকটা গ্রুপ দাঁড়ালা।

যারা এভাবে শুদ্ধ বাংলায় একদম উর্দুভাষা বর্জন করে ইচ্ছাকৃতভাবে। এখানে পরবর্তীকালে অবশ্য কবি শামসুর রাহমান উর্দুভাষী শব্দ আল্লাহ, খোদা, নামাজ, রোজা ব্যবহার করেছেন, সেই সময় উনি ইচ্ছাকৃতভাবে এই বিপ্লবটি ঘটিয়েছিলেন। আমি এ কারণে শামসুর রাহমানকে বলি ফার্সি সাহিত্যে কবি ফেরদৌসী যে কাজটি করেছিলেন সেই কাজটি কবি শামসুর রাহমান বাংলা সাহিত্যে করছেন। যদিও কবি ফেরদৌসী স্ব-জ্ঞানে সচেতনভাবে আরবি, ফার্সি শব্দ ফার্সি ভাষাটিকে ব্যবহার করতে সম্মত হন। ফলে ফার্সি ভাষাটি টিকে যায়। তাহলে আরবরা যখন পারস্য বিজয় করে (আরব মুসলমানরা) তখন আরবদের কালচার থেকে ফার্সি কালচার অনেক বেশি সমৃদ্ধ। কারণ এরা তো আর্য কালচার এবং অন্যান্য কালচারের সাথে সম্পৃক্ত। এই কালচারটাকে ধ্বংস করার জন্য তারা বহু চেষ্টা করেছেন। পারসিকদের ১০০ ভাগকে তারা মুসলমান করতে পেরেছে, অ্যারাবিক কালচার আত্মস্থ করাতে পারেনি। তারা তাদের সেই পৌত্তলিক যুগের সোহরাব রুস্তম, হাতেমতাই, নওরোজ এগুলো সব ইনটেক্ট রেখেছে। যেটা আমরা বাঙালি মুসলমানরা পারিনি। শামসুর রাহমান এই কাজটি করেছেন, বাঙালি মুসলমানকে স্বদেশের দিকে স্বভাষার দিকে ফিরিয়ে এনেছেন, যা শুধু ভাষা আন্দোলন দ্বারা হতো না। এই যে আজ পর্যন্ত শামসুর রাহমানের প্রতি আমার একটা আনুগত্য আছে। শামসুর রাহমান একজন বড় ঐতিহাসিক, যে দায়িত্বটা হাসান হাফিজুর রহমান বা তার গ্রুপ করতে পারেনি। সেই দায়িত্বটা নন-পলিটিক্যাল হয়েও শামসুর রাহমানের গ্রুপ পালন করেছিল। ভাষার দ্বন্দ্ব শুরু হলো একদিকে তথাকথিত ইসলামাইজড ভাষা- আরেক দিকে বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাংলা সেই মনসা কাব্য, চর্যাপদ, পুঁথিসাহিত্য, আলাওল, চন্ডিদাসের বাংলা সাহিত্য, আবহমান রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের প্রবহমান বাংলা সাহিত্যটাকে বাংলাদেশে রক্ষা করলেন এই গ্রুপটি সচেতনভাবে। আর হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ গণসাহিত্যে বাস করেছে, ভাষা সাহিত্যে গণমানুষের বলিষ্ঠতা সিঞ্চন করেছে কিন্তু সাহিত্য সংস্কৃতিকে রক্ষা করেছে তৃতীয় গ্রুপটি, শামসুর রাহমানের নেতৃত্বাধীন। এটা হচ্ছে আমার এনালাইসিস।

এখন উর্দু এবং আরবি যারা করতেন তাদের পেছনে হাঁটার সময় এসে গেল। কারণ তরুণরা বুঝতে পারলেন যে, পাকিস্তান কালচারাল কলোনি করতে চায়। আমাদের বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক কলোনি দখল করে ফেলেছে- এখন বাকি ছিল কালচারাল কলোনি, পলিটিক্যাল কলোনি। এই তিনটার সমাবেশ করতে পারলে বাংলা ভাষী জাতিকে দাস জাতি হিসেবে তারা গণ্য করতে পারে। ১৯৫১ সালে আল্লামা সোলাইমান নদভি আসলেন। পাকিস্তান গভর্নমেন্ট ইন্টেনশনালি নিয়ে আসল কার্জন হলে। উনি বললেন, বাঙালি মুসলমানরা হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছে। এখন পর্যন্ত তাঁরা হিন্দু দ্বারা প্রভাবিত। তাদের ছেলে হলে নিয়ে যায় ব্রাহ্মণের কাছে নামকরণ করানোর জন্য, মেয়েদের সেবাদাসি করা হয়, নানা রকম তর্ক, তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হলো, তার গাড়ি ভাঙা হলো কার্জন হলের সামনে। গভর্নর ছিলেন ফিরোজ খান নুন-তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হলো- তারপরে শুরু হলো পরোক্ষ আন্দোলন।

পরে তারা বলল রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া যাবে না- তখন এইটার বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আবদুল গণি হাজারী, সরদার জয়েন উদ্দিন, মুনীর চৌধুরী.... এবং এরা তখন ওয়ারীর একটা বাড়িতে রবীন্দ্র সংগীতের আসর করল। লিটন হল চাওয়া হল দেওয়া হয়নি, আরও কোনো কোনো কয়েকটি হল চাওয়া হয়েছিল কিন্তু সরকারের পরোক্ষ ইঙ্গিতে এই আসরের জন্য হল দেওয়া হলো না। তখন একটি বাড়িতে আম গাছতলায়, ওয়ারীতে বড় বড় বাড়ি ছিল- সেখানে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি প্রিয় গান বিমল রায়ের কণ্ঠে শুনি যেগুলো পরে আর আমার স্মৃতি থেকে যায়নি। বিমল রায় এখন কোথায় আমি জানি না। অন্ত নাই যেনো আনন্দে ভরা আমর অঙ্গ, প্রথম আমি তার কণ্ঠে শুনি। আর মুসলমান মহিলাদের মধ্যে- দুঃসাহসিকতার সঙ্গে বেরিয়ে আসলেন রবীন্দ্র সংগীতের পক্ষে আন্দোলনে- পর্দাবিরোধী অন্ধকারের মধ্যে- প্রথমে আমি নাম করি মুনীর চৌধুরীর বোন নাদেরা চৌধুরীর যে এখন পুরো মৌলবাদী হয়ে গেছে। আরেকজন মহিলা তিনি এখন মারা গেছেন, লায়লা সামাদ, কমরেড সামাদের স্ত্রী। তিনি বেপরোয়াভাবে বেরিয়ে এসেছেন, বেগম পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন।

এই যে ফ্যাশন এটাতো বাঙালি মুসলমানদের কাছে একেবারে অস্পৃশ্য এবং অজানা একটা সাবজেক্ট ছিল। ‘বেগম’ পত্রিকায় তিনি ফ্যাশন ঢোকালেন। ‘বেগম’টাকে তিনি নানাভাবে একটা মডার্ন কাগজ করার চেষ্টা করেছিলেন। তারপর আসলেন ফরিদা বারী মালিক, যে কোনো ফাংশানে গেলে রবীন্দ্র সংগীত গাইতেন। ১৯৫৪ সালে যখন আমরা ইউনিভার্সিটিতে বিজয় লাভ করি নির্বাচনে, সেখানে উদ্বোধনী সংগীত গাইলেন তিনি। সবচেয়ে মজার কথা, ইস্কান্দার মির্জা যখন গভর্নর হয়ে আসছে তখন ২১ ফেব্রুয়ারি পালন, রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া এগুলোর প্রতি তার পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞা ছিল, হলের প্রভোস্টরা বলে দিতেন তোমাদের ফাংশানে একটি নজরুল সংগীত দিও। ইসলামী গজল দিও, রবীন্দ্র সংগীত টংগীত বাবা বেশি আর দিও না। সবই উনি হ্যাঁ করতেন। দুজনই তো গায়ক ছিল আমাদের খালেদা ফেন্সী খানম আর ফরিদা বারী মালিক। ফরিদা বারী মালিক যদি গান গাইতেন আমার মনে হয় আজকে অনেকের চাইতে বেশি প্রতিষ্ঠা লাভ করতেন। উনি আর ছিলেন শাহজান হাফিজ রবীন্দ্র সংগীতের।

ফরিদা বারী ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন। বহুবার তাকে এক্সপেল করে দেওয়ার কথা হয়েছে। আমার মনে আছে, ইস্কান্দর মির্জা গভর্নর হয়েছেন, ৯২-৪ ধারা জারি হয়েছিল গ্রেফতার চলছে। কার্জন হলে ফরিদার উদ্বোধনী সংগীত গাওয়ার কথা-উনি গাইলেন সেখানে দাঁড়িয়ে ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এ দ্বার’ সেই গানটার এখন কোনো আবেদন নেই- সেদিন সব ছাত্রের ভেতরে বিদ্যুৎ যেন বয়ে গেছিল এই গানটা গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। কারণ চারদিকে সন্ত্রাস, রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারবে না। তার মধ্যে একটি মেয়ে সব নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কার্জন হলে দাঁড়িয়ে গাইছে ‘নাই নাই ভয় হবে হবে জয়’ এটা মনে হলো যেন একটা বাণী আর কি। এটা ওরা প্রথম বুঝতে পারেনি। পরে যখন বুঝতে পেরেছে তখন অনুষ্ঠানও শেষ হয়ে গেছে। প্রায় উনি এ ধরনের গান গাইতেন। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’। এভাবে বিভিন্ন ভাবে রবীন্দ্র সংগীতকে তারা জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন, এখন তো বন্যা, পাপিয়াসহ বহু গায়িকা দেশে বিদেশে যাচ্ছে- রবীন্দ্র সংগীত গেয়েই বেঁচে আছেন বলতে গেলে। তখন রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া যে কি বিপজ্জনক ব্যাপার ছিল সেটা তখনকার পরিবেশে না থাকলে বলা যাবে না, কারণ এত শক্তিশালী ছিল এই প্রো স্টাবলিশম্যান্ট গ্রুপ, ইসলামী গ্রুপ যে বলা যাবে না।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানারকম ব্যঙ্গ করা, রবীন্দ্র সংগীত গাইলে নিষেধ করা হতো। রবীন্দ্র সংগীতের কদরও ছিল না তখন। কারণ আমাদের মিডলক্লাস তৈরি হয়নি। গ্রামে তখন আব্বাসউদ্দীনের গান শুনতে অভ্যস্ত। অনেক রকম যুদ্ধ চলতো। আমাদের কারণে সবাইকে গান গাইতে হতো। একদিন সৈয়দ আলী আহসানের গ্রুপ বলে বসল যে, পাকিস্তান আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের কোনো ভূমিকা বা অবদান নাই- প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কোনো অবদান নাই। এক্ষেত্রে আরেকজন লোকের নাম মনে আসছে। যদিও তার বিরুদ্ধে ’৭১ সালে অনেকে বলেছিল কোলাবরেটর হয়ে গেছে, এই লোকটি যেভাবে রবীন্দ্র সংগীতকে বাঁচিয়ে রেখেছেন বাংলাদেশে তিনি হলেন আব্দুল আহাদ। ১৯৫০ সালের দিকে গোলাম মোস্তফা চারদিকে বলে বেড়াতে লাগলেন পাকিস্তান আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের কোনো অবদান নেই। প্রত্যক্ষ তো না-ই পরোক্ষও নাই। তাঁকে বর্জন করতেই হবে। তখন উনি (আব্দুল আহাদ) রেডিও পাকিস্তানে চাকরি করেন চাকরি ছাড়তে পারবেন না বলতেও পারবেন না তার চাকরি যাবে। উনি আমাদের কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে বললেন যে, রবীন্দ্র সংগীত দিয়েই প্রথম পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত লেখা হয়েছে, সুর দিয়ে। অবাক কাণ্ড কোনটা? তিনি বললেন যে, প্রথম গান কোনটা বল তোমরা- গোলাম মোস্তফা প্রথম গান লেখে, ‘ঝির ঝির পূবাল বাতাসে ধাও, ও আমার ময়ূর পংখী নাও- পাকিস্তানের পাক হাওয়াতে আমায় লইয়া যাও’, এই গানটি প্রথম তারপর লিখেছে, ‘সকল দেশের পিয়ারা কোনো সে স্থান পাকিস্তান সে পাকিস্তান’।

এই হলো প্রথম গান একেবারে পশ্চিম পাকিস্তানের কেউ গান লেখেনি- তারপর থার্ড গান হচ্ছে নাজির আহমদের ‘পূর্ব বাংলার শ্যামলী যার পঞ্চ নদীর তীরে, অরুণি যায়’ এই সে গাওয়া হতো। উনি বললেন সব দেশের চেয়ে পেয়ারা এই গানটা ছাড়া বাবি দুটো গানই রবীন্দ্র সংগীত। আর আগেরটা উনি বললেন, এই গানটা হচ্ছে ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ’ এর সুর। ঝির ঝির ঝির ঝির পূবাল বাতাস এবং সেইটা নিয়ে এক মিটিংয়ে আমি গান গেয়ে দুটোকে দেখালাম যে দুটোর সুর এক। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে এই সুর দুটো নেয়া। রবীন্দ্রনাথও এই সুর বাউলদের কাছ থেকে ধার করেছিলেন। তারপর সেটা নিয়ে আমরা আর বাড়াবাড়িতে যাইনি। রবীন্দ্রনাথ তো বহু আগে লিখেছেন। গোলাম মোস্তফা ধার করেছেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। এভাবে একটা যুদ্ধ চলতো তখন। রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এবং বিপক্ষে। পক্ষে আমরা ইয়াংরা বিপক্ষে ওল্ড জেনারেশন। গোলাম মোস্তফা থেকে শুরু করে আজাদ। যেটাকে আজাদ গ্রুপ বলা যায় আরকি। শেষ পর্যন্ত যখন দেখল এই যুদ্ধে সরকার পক্ষের পরাজয় অবধারিত তখন সরকার স্বয়ং আবির্ভূত হলেন কি-না...! আরবি অক্ষরে বাংলা লিখতে হবে। চিটাগাংয়ে এক সময়ে আরবি অক্ষরে বাংলা লেখা হয়েছিল কোনো এক প্রাচীন যুগে সেই সব মাল মসলা বের করে এনে ছাপানো শুরু হলো- এইটাই হলো বাঙালি মুসলমানের আদি ভাষা। তখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রতিবাদ করেন খুব বলিষ্ঠভাবে, এবং উনি একটা মজার কথা বললেন, ঠিক আছে যদি আমাদের বাংলা আরবিতেই লিখতে হয় তাহলে এক কাজ হোক পাকিস্তানে আরবিকে রাষ্ট্র ভাষা করে দেওয়া হোক। এতে পাকিস্তান বড় বিপদে পড়ল। আরবি রাষ্ট্র ভাষা হলে তাদেরও অসুবিধা। তারপর তো মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, এস ওয়াজেদ আলী আরও অনেকে বাংলা ভাষার পক্ষে লেখা শুরু করলেন যে বাংলা ভাষাকে আরবি ফার্সি হরফে লেখা চলবে না।

কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে এ কারণে। এর পেছনে ছিলেন একজন বাঙালি। তিনি হচ্ছেন ওই যে সালমান রহমানরা আছে- সালমান রহমানের বাবা ফজলুর রহমান, তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছিলেন। যিনি কোটি কোটি টাকা খরচ করেছেন, মুনীর চৌধুরীর ভাষায় বাংলা ভাষাকে খৎনা করার জন্য। গেল সেটাও তাদের সফল হলো না। জিন্নাহ সাহেব তো নিজে এসে পরিষ্কার বললেন উর্দুই রাষ্ট্র ভাষা হবে। তার পরের ইতিহাস তো সবারই জানা।

মুনতাসীর মামুন: জিন্নার সেই বক্তৃতার সময় আপনারা ছিলেন কেউ?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী: না আমি ছিলাম না। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়তাম, বরিশালে ছিলাম, তবে আন্দোলনটা শুরু হয় কিন্তু জিন্নাহর বক্তব্যের পরে। ১৯৪৮ সাল থেকে এবং প্রতি ১১ মার্চ তারিখে আমরা রাষ্ট্র ভাষা দিবস পালন করি, ১৯৫২ সালে গুলিবর্ষণের পরে ওই দিবসটা চলে যায়, ১১ মার্চের দিবসটা, চলে আসে সামনে ২১ ফেব্রুয়ারি। এখানে শুধু বাংলা ভাষা সাহিত্যে বিরোধিতা হয়নি পশ্চিমবঙ্গের সাথে আমাদের একটা ভাষাগত বিভেদ তৈরি হয়। সেজন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে সব বইপত্র আনা ব্যান্ড করে দেওয়া হলো, আনন্দবাজার, যুগান্তর ব্যান্ড হয়ে গেল, ইভেন দৈনিক ইত্তেহাদ ছিল, সেটাও ১৯৪৮ সালে ব্যান্ড করে দেওয়া হয়, যেটা ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন দিচ্ছিল। সব রকম উপন্যাস, কবিতা, গল্প.... মানে একটা বার্লিন ওয়াল আরকি। একটা ছিল পলিটিক্যাল ওয়াল আরেকটা কালচারাল ওয়াল তৈরি করা। এবং তমদ্দুনপন্থিদের একটা প্রশ্রয় দেওয়া শুরু হয়।

এর মাঝখানে কিছুটা যখন দেখা গেল প্রো-স্টাবলিশম্যান্ট মানে ইসলামী রেনেসাঁর গতি খুব মন্থর তখন অধ্যাপক আবুল কাশেম নামে এক ভদ্রলোক তমদ্দুন মজলিশ করলেন- এটা আবার কিছু ইয়াং জেনারেশনকে টানল। তারা সেখানে প্রগ্রেসিভ কথা বলতো- বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করতে হবে এ দাবিও তারা তুলেছিল, বাংলাকে সরকারি ভাষা করতে হবে। ১৯৪৮ সালে এ আন্দোলনের সঙ্গে তারা ছিল। ফলে তারা কিছুদিন ইয়াং জেনারেশনের একটা অংশকে ওদিকে টেনেছিল। বর্তমানে যারা বেশ প্রগ্রেসিভ তাদের অনেকেই তমদ্দুন মজলিশে ছিল। এই যে আমাদের ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী উনি তমদ্দুন মজলিশ করতেন, এর পাশাপাশি আরেকটা ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল। ‘ইসলামিক ব্রাদার হুড’ নামে। এরাও প্রগ্রেসিভ কিছু কথাবার্তা বলত, কিন্তু বাংলাকে ইসলামি জবানে পরিণত করার একটা প্রচেষ্টা ছিল। এর সঙ্গে বদরুদ্দীন উমর, ইশতিয়াক আহমদ, বিচারপতি মোস্তফা কামাল প্রমুখ ছিলেন।

তারপর ছিল ইসলামি ছাত্র শক্তি। চাটগাঁর ফরমানুল বশর নামে একজন এর নেতা ছিলেন। তখনও কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন তৈরি হয়নি। ছাত্র ফেডারেশন ছিল। ছাত্র ইউনিয়ন তৈরি হলো, ছাত্রলীগ অসাম্প্রদায়িক হলো। তারপরে ছাত্রফ্রন্ট আস্তে আস্তে শক্তিশালী হতে থাকে। এর মাঝখানে কলকাতায় একটা দল ছিল, ফ্যাসিবিরোধী লেখক সংঘ। যুদ্ধের পরে ওটা ভেঙে যাওয়ার পরে ঢাকায় প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশন হয়। তাতে এরা সবাই ছিল হাসান, বোরহান, আজাদ, মুস্তফা নুরউল ইসলাম, মাহবুব জামাল জাহেদীর পুরো গ্রুপ। আমাদের ভিতরে অনেক ইনার ট্রাবল ছিল। তা সত্ত্বেও সবাই একত্র হয় এবং মধুর রেস্টুরেন্টে প্রতি মাসে এর সভা হতো। এখন লেখা ছাপা হবে কোথায় অগত্যা ছাড়া এবং চিটাগাংয়ের সীমান্ত ছাড়া আর কোনো কাগজ ছিল না। আর কোথায় লিখব? আর তো কোথাও লেখা ছাপা হচ্ছে না, এই সময় সুবর্ণ সুযোগ দেখা দিল। নাসির উদ্দীন সাহেব ঘোষণা করলেন যে তিনি সওগাত পত্রিকা বের করবেন। এই সওগাত পত্রিকায় গিয়ে হাসান হাফিজুর রহমান দায়িত্ব নিলেন। সওগাতি আড্ডা আমার মনে হয় কেউ যদি কোনো দিন লিখতে পারে সেই কল্লোল যুগের মতো একটা বই হবে। এটা মুনতাসীর তুমি চিন্তা করে দেখ।

এ নিয়ে গবেষণা করলে দারুণ একটা কাজ হয়। তখনকার ওই সওগাতি আড্ডায় আসেননি কে? প্রবীণদের ভেতর থেকে কাজি মোতাহার হোসেন, কবি আব্দুল কাদির, কবি আহসান হাবীব, [নতুন] গোষ্ঠীর মধ্যে হাসান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, বোরহান, ফজলে লোহানী, তাসিকুল আলম খাঁ, মুস্তফা নুরউল ইসলাম, সরদার জয়েন উদ্দীন, আব্দুল গণি হাজারী, কামরুল হাসান, মুনীর চৌধুরী, ফয়েজ আহমদ, কে না আসতো।
মুনতাসীর মামুন: এটা কি ১৯৫২ সালের আগের কথা বলছেন না পরের কথা বলছেন?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী: কোনটা?

মুনতাসীর মামুন: সওগাতের প্রতিষ্ঠার কথা যে বললেন?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী: ১৯৫২ সালের আগের ১৯৫১ সালের কথা। সওগাতের প্রিপারেশন চলছে আরকি- তো মাঝখানে খানিকটা বন্ধ ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জন্য। সওগাত বেরুবার পরে এই প্রগতিশীল রাইটারদের একটা আশ্রয়স্থল হলো- যেখানে গিয়ে আমরা আড্ডা মারতাম বিকেলবেলা এবং সওগাত বেরুল সব প্রগ্রতিশীল লেখকের লেখা নিয়ে প্লাস যেটা হলো ওখানে একটা সাহিত্য গ্রুপ করা হলো ব্রড বেসিসে। নাম হলো পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ। এটার সভাপতি হলেন কাজী মোতাহার হোসেন এবং সম্পাদক ছিলেন ফয়েজ আহমদ। এই প্রথম একটা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় প্রগতিশীল লেখকরা একত্র হলেন এবং চিটাগাং থেকে মাহবুব উল আলম, সুচরিত চৌধুরী, রুহুল আমীন নিজামী, যিনি স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স করেছিলেন। এরকম আরও কারা কারা যেন এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলেন। সুচরিত চৌধুরী খুব এক্টিভ ছিলেন।

এভাবে চিটাগাং থেকে আসলেন, সিলেট থেকে আসলেন, তারপরে রংপুর থেকে তো কায়সুল হকরা আসলেন। কায়সুল হক আবার সওগাতের পাশাপাশি আরেকটা কাগজ বের করেছিল। নজমুল হক বলে এক ভদ্রলোক বের করলেন- মাসিক কাফেলা। এটাও প্রগ্রেসিভদের কাগজ হলো। কায়সুল হকরা সম্পাদনা করতেন। এভাবে মোটামুটি আমাদের প্রগ্রেসিভ কালচারাল ফ্রন্টরা অসম্ভব শক্তিশালী হয়ে দাঁড়ায়। ওই দিকে ওদের ভিতরে দেখা দেয় দ্বন্দ্ব। সরকারি অনুগ্রহ দিয়ে আজাদ গ্রুপ একটা, মাহেনও গ্রুপ আরেকটা, কবি গোলাম মোস্তফার নওবাহার গ্রুপ আরেকটা- এদের ভিতর আবার ইন্টার্নাল দ্বন্দ্বটা এত বেশি ছিল এবং কনট্রাডিকশনও ছিল। যেমন- আজাদ গ্রুপ তো এটাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ব্যস্ত। মাহেনও গ্রুপে আব্দুল কাদির রিটায়ার হওয়ার পরে এটা না প্রগ্রেসিভ না রিয়েকশনারি একটা মাঝামাঝি পন্থা তারা গ্রহণ করেছিল। এরূপ ওই গ্রুপের ভিতর একটা লন্ডভন্ড কাণ্ড হয়। আর শক্তি এবং প্রতিভার দিক থেকেও তরুণ গ্রুপই বেশি জনগণের আস্থা অর্জন করে। ফলে ওই ইসলামী গ্রুপটা পেছন হাঁটতে শুরু করে, তমদ্দুন মসলিশ তো ভেঙেই যায়।

তমদ্দুন মজলিশ দুটি কাগজ বের করেছিল। একটা হলো সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’, আরেকটা ‘মাসিক দ্যুতি’। যখন উর্দু নাম দিয়ে কাগজ প্রকাশ করার একটা প্রবণতা ছিল বাঙালি মুসলমানদের। এটা ওরা ভেঙে দেয়। এরপর ১৯৫১ সালের ১৭-১৮ মে দৈনিক সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর দৈনিক আজাদ এডিটরিয়াল লিখেছিল যে, এরকম হিন্দুয়ানি বাঙলায় কেন নাম দেওয়া হলো? ওই কাগজের নাম তো দৈনিক খবর হতে পারতো। তখন আবার জহুর হোসেন চৌধুরী সংবাদের পক্ষ থেকে জবাব দিয়েছিলেন, কেন মওলানা আকরাম খাঁ তো যুবক বয়সে দৈনিক সেবক বের করেছিলেন। সেবক নামটা কি খুব মুসলমানি বাংলা বলে মনে হয়? এভাবে বাদ প্রতিবাদ হয়েছে। দৈনিক সংবাদ বেরুল। এই সংবাদে সাহিত্য সেকশানের দায়িত্ব প্রগ্রেসিভরাই বহন করলেন। বোরহান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, যদিও এটা নূরুল আমীনের কাগজ, কিন্তু কি কনট্রাডিকশন। ওই যে কথায় বলে না কংসের ঘরেই কংস হন্তারকের জন্ম। এভাবে নূরুল আমীনের কাগজেই শামসুর রাহমান, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, হাসান হাফিজ এদের লেখা বেরুতে লাগল। আব্দুল গণি হাজারী যখন সাহিত্য সম্পাদক তখন কখনও কখনও সিকান্দার আবু জাফরও ছিলেন পুরাদমে, সংবাদের সাহিত্য পাতাটা ছিল পুরোপুরি প্রগ্রেসিভ কাগজ। এডিটোরিয়াল পেজগুলো এবং সংবাদের নিউজ পেজগুলো ছিল মুসলিম লীগের মুখপত্র।

যেমন- ইকবালের একটা কবিতা একবার অনুবাদ করা হয়েছিল প্রয়াত কবি আমাদের আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সাংঘাতিক প্রগ্রেসিভ কবি ছিলেন এই গ্রুপে উনি মোল্লাদের বিরুদ্ধে একটা কবিতা অনুবাদ করে নিয়ে আসলেন, এটার লাইন হলো ‘স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে যত ভেদ আছে গুঁড়িয়ে দাও, মধ্যবর্তী মোল্লাদের আজ হটিয়ে দাও।’ বেশ বড় কবিতা। আমি তো রাতের শিফটে কাজ করি সংবাদে, অফিসে এসে শনিবার দিন রাত্রে আমার একটা নজর থাকতো যে, সংবাদ সাহিত্য সাময়িকীতে কী বেরুচ্ছে। বেশ ভালো হতো তখন আমাদের বন্ধু বান্ধবদের কবিতা গল্প ইত্যাদি এসব বেরুত। দেখি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতা ইকবালের অনুবাদ। পেজ পেকআপ হয়ে গেছে রাত্রে দেখি সৈয়দ নূর উদ্দিন যখন বার্তা সম্পাদক, হৈচৈ করে এসে বলল, এই গাফ্ফার তুমি কি একটা কবিতা লিখতে পারো? এই ধরো বারো চৌদ্দ লাইনের। আমি বললাম কেন? তিনি বললেন, তুমি লিখতে পারলে লিখে দাও। আমি বললাম শিফটের লোক আমি, আমি নিউজ ট্রান্সলেশন করতে পারি। আমার এখন কবিতা লেখার মতো অবস্থা আছে? তারপর তিনি বেরিয়ে গেলেন গিয়ে পুরোনো ফাইল ঘেটে.... তখন আব্দুল গণি হাজারীও নেই। পুরোনো ফাইল ঘেঁটে কী একটা কবিতা লিখে নিয়ে এলেন। ভাবলাম হঠাৎ এত রাত্রে কবিতা কেন? পরদিন ভোরে উঠে দেখি কাগজে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর অনুবাদটা নেই। তার বদলে ওটাকে রিপ্লেস করার জন্য আরেক কবিতা দেওয়া গেছে। আমি অবাক যে এখানে নূরুল আমীনের চোখ পড়েছে দেখে। নূরুল আমীনকে নিশ্চয়ই কেউ ইনফর্ম করেছে যে ওখানে কমিউনিস্টদের আড্ডা হয়েছে।

ইমামুর রশীদ বলে একজন কবি ছিলেন, হাসান হাফিজুর রহমানের ভাইয়ের ছেলে অথবা ভাগনে জামালপুরে বাড়ি। সেও অসাধারণ কবিতা লিখতো। সংবাদ থেকে যখন বিতাড়িত হওয়ার অবস্থা প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের তখন সওগাত ছাড়া আমাদের কোনো আশ্রয় ছিল না। তখন আরেকটি মাসিক বেরিয়েছিল, বেশি দিন বাঁচেননি, তার নাম ‘যাত্রিক’। এই কাগজটা সম্পাদনা করতেন আহমেদুল কবির, জহির রায়হানের ভগ্নিপতি। ’৭১ এর শহীদ বুদ্ধিজীবী, যাকে মওলানা মান্নান মেরেছে। ডা. আলীমকেও তো মেরেছে। এরা দুজনই আহমেদুল কবির, আব্দুল আলীম মেডিকেল কলেজের ছাত্র। তারা ‘যাত্রিক’ নাম দিয়ে এই কাগজটা বের করেন। এই কাগজটা সম্পাদনা করতেন হাসান হাফিজুর রহমান। এরা দুজনই শামসুর রাহমানের গ্রুপের ঘেঁষা ছিল। গণসাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক মূল্যবোধ এবং তার গণভিত্তি চেতনায় বিশ্বাস করতেন। আর হাসান ভাইয়ের গ্রুপটা তো একেবারে গণভিত্তিক সাহিত্য, বামপন্থি বিপ্লবী সাহিত্য। এর মাঝামাঝি যাত্রিকের একটা রোল ছিল এবং যাত্রিক খুব জনপ্রিয় ছিল। তার কভার ছিল কামরুল হাসানের যাত্রিকের পরে ‘সমকাল’ অবশ্য পঞ্চাশ দশক মনে হয় সমকালের। আমার বই বের করল। আমার মনে হয় ৫৬-৫৭ থেকে এটা আন্দোলনের পর্যায়ে চলে যায়।

আন্দোলন অত্যন্ত বলিষ্ঠ হয়ে উঠে। এই দুটি ধারা, এই ধারাটি আমরা এখনও দেখি। যেটা আবুল মনসুর আহমদের ভাষায় পাক-বাংলা কালচার, আরেকটা বাংলা কালচার। এই দ্বন্দ্ব কিন্তু আজকের না, সেই নবনূর কোহিনূরের আমল থেকেই আরম্ভ হয়েছে, ত্রিশের দশকে-বিশের দশকেও ছিল, সাম্প্রতিক অসাম্প্রদায়িক ধারার মধ্যে বিভেদ ছিল। পরে এটা রাষ্ট্রীয় আশ্রয় লাভ করে। পাকিস্তানি শাসকরা চেষ্টা করেছে এই ভাষাকে ধ্বংস করার জন্য। তাদের যারা কোলাবরেটার ছিলেন, সাহিত্যিক কোলাবরেটার, বুদ্ধিজীবী কোলাবরেটার তারাও চেয়েছিল, রাজনৈতিক কোলাবরেটার ছিলেন পাকিস্তানিদের, তারা চেয়েছিল ধ্বংস করতে, কিন্তু প্রতিরোধটা আমাদের নবোত্তীর্ণ মধ্যবিত্তের ভিতর থেকে তৈরি হয়েছে। একটা অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে তারা তৈরি হয়। যার ফসল আমরা দেখেছি ষাটের দশকে। পঞ্চাশের দশকটা ছিল প্রস্তুতির ক্ষেত্র। ষাটের দশকটা ছিল বিদ্রোহী পর্ব। সত্তরের দশকটা ছিল আত্মপ্রকাশ ও আত্মবিকাশের পর্ব। তারপর তো আবার একটা উল্টো স্রোতে আসছে, যা নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে।

[চলবে…]

এইচআর/জিকেএস