ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

পিকে হালদার এবং অর্থপাচার সমাচার

আমিনুল মজলিশ | প্রকাশিত: ০৪:১৬ পিএম, ২২ মে ২০২২

দেশে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনায় তৈরি হচ্ছে নানান ইস্যু। এসব ঘটনায় কতটা রটনা রয়েছে তা নিয়েও আছে বিস্তর আলোচনা, সমালোচনা। তবে বাস্তবতা হচ্ছে নতুন ইস্যুর ভিড়ে দ্রুতই চাপা পড়ে সদ্য পুরাতন ইস্যু। তাই যে কোন ঘটনা নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে চলমান তকমা রাখা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এখন যা ঘটমান-বর্তমান একটু পরেই তা হয়তো পুরাঘটিত।

যাই হোক ভূমিকার হেতু হচ্ছে, বহুল আলোচিত, ভারতে গ্রেফতারকৃত ও রিমান্ডপ্রাপ্ত পি কে ওরফে প্রশান্ত কুমার হালদার প্রসঙ্গ। তিনি পাকড়াও হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সব দৃষ্টি মিলিত হয়ে যায় এক মোহনায়। সাময়িক সময়ের জন্য হলেও তখন থেকে একে একে বিদায় নেয় প্রাত্যহিক জীবনের যত দুঃখ, ক্লেশ, চাপ। তখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শত সহস্র লিটার সয়াবিন তেল উদ্ধারের খবর, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জনমনের অস্বস্তি, নাভিশ্বাস, দীর্ঘশ্বাস হা-হুতাশ সবই যেন এক নিমেশে কিছুটা হলেও উবে যায়, ঘটনার আকস্মিকতায়। কারণ হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে যে ব্যক্তি দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন অবলীলায়, আবার বিভিন্ন দেশ ঘুরে নাম পরিচয় গোপন করে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন পাশ্র্ববর্তী দেশে। বাগিয়ে নিয়েছিলেন ভারতীয় পাসপোর্ট, ভোটার আইডি কার্ড, তথা নাগরিকত্ব। শেষতক তারও আর শেষ রক্ষা হলো না। নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাবার যোগ্য ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

বাণিজ্যিক চাহিদায় কিংবা সুস্থ -অসুস্থ প্রতিযোগিতায়, এই ঘটনায়ও প্রায় প্রতিটি গণমাধ্যম প্রতিমুহূর্তে ছড়িয়ে দেয় ব্রেকিং, হতে থাকে বিভিন্ন নিউজ মেকিং, প্রডিউসিং, পাবলিশিং। একে একে বেড়িয়ে আসতে থাকে পি কে হালদারের অগাধ সম্পদের হদিস, পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রাসাদ সম রাজকীয় বাসভবনের খোঁজ, নানা ক্ষেত্রে অর্থ লোপাট আর লগ্নির তথ্য, সাথে রয়েছে বিভিন্ন নারী বন্ধুদের পেছনে টাকা ওড়ানোর সব ঘটনা। ফলে সরাসরি সম্প্রচারের উত্তেজনা থেকে আগ্রহী দর্শকের দৃষ্টি সরে না, পলকও পড়ে না। কেবল মূলধারার দৈনিক নয়,এসব খবরে উঠতি পত্রিকারও বাড়ে কাটতি।

যাই হোক, বরাবরই এই অর্থপাচার সমাচারে আমজনতার জন্য যেমন থাকে চমক, তেমনি দায়ীদের জন্যও থাকে শাস্তির ধমক। (ছাড় দেয়া হবে না, জিরো টলারেন্স, অপরাধী যিনিই হোক না কেন, অচিরেই শাস্তির মুখোমুখি করা হবে, ইত্যাদি, ইত্যাদি) কিন্তু সুচতুর অপরাধীর যথেচ্ছ আচরণের জন্য এসব ধমক যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন শাস্তির প্রয়োগ। এককালে বুয়েটের প্রকৌশলী (পি কে হালদার এবং তার ভাই প্রিতিশ কুমার হালদার ) কতটা সুকৌশলে রাতারাতি দেশে বিদেশে বিভিন্ন কোম্পানির মালিক বনে গেছেন সেই কাহিনী নিয়ে নাটক সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা যতটা সহজ, পাচারকৃত টাকা ফেরত পাওয়া ততটাই দুরূহ।

কিন্তু লাখ শহীদের রক্তস্নাত মাটি কিভাবে দিনে দিনে অর্থপাচারের উর্বর ভূমিতে পরিণত হচ্ছে সেটি অনেকের কাছেই আজ বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন। তাবৎ দুনিয়ার অর্থপাচার নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্ট্রিগ্রিটি-জিএফআই তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলছে, পাচারের ক্ষেত্রে র্শীষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ।

দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অবস্থান দ্বিতীয়। সংস্থাটি জানিয়েছে, কেবল ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ থেকে মোটা দাগে চারটি পন্থায় পাচার হয়েছে, এক হাজার ১৫১ কোটি ডলার যা টাকার হিসেবে প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। উল্লিখিত চারটি প্রক্রিয়া হচ্ছে- ১) আমদানি বাণিজ্যে ব্যাপক ওভার-ইনভয়েসিং, ২) রপ্তানি বাণিজ্যে আন্ডার-ইনভয়েসিং, ৩) রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না এনে বিদেশে রেখে পাচার এবং ৪) ব্যাংকঋণ বিদেশে পাচার।

সংস্থার বরাত দিয়ে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বছরে গড়ে ৬৫ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। সে হিসাবে ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পযর্ন্ত ছয় বছরে পাচার হয়েছে প্রায় চার লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। জিএফআই এর এই তথ্য কতটা সত্য কিংবা অসত্য এনিয়েও রয়েছে সরকারী বেসরকারী মহলে নানা দরকারি বেদরকারি যুক্তি তক্ক।

সাধারণত আমরা বলি, যা রটে তা কিছুটা হলেও বটে। কিন্তু এক্ষেত্রে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ- টিআইবি’র বক্তব্যের সার সংক্ষেপ হচ্ছে, যা রটেছে তার চেয়ে ঢের বেশি ঘটেছে। অর্থ্যাৎ বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারে যে তথ্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রকাশ করছে, সেটাও আংশিক। বাস্তবে এর পরিমাণ আরো অনেক বেশি। কারণ অনেক বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করেন। তাদের আয়ের বড় একটা অংশ অবৈধভাবে চলে যায় বিদেশে। সেটাও অর্থপাচার। এই তথ্য কিন্তু বৈশ্বিক সংস্থাগুলো উল্লেখ করে না। তারা শুধু বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচারের তথ্যটুকুই দেয়।

এবারে অর্থপাচার মামলার আইনি বাস্তবতায় দৃষ্টি দেয়া যাক, এসব মামলার অভিযোগ খতিয়ে দেখে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার আছে দুদকের। তবে, ২০১২ সালে অর্থপাচার, স্থানান্তর ও রূপান্তরকে ‘শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করে প্রথমে ‘মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন’ প্রণয়ন করার পর, ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর সরকার এটি সংশোধনের মাধ্যমে আরো যুযোপযোগী করে। সংশোধিত আইনটি গেজেট প্রকাশের পর দুদকের পাশাপাশি মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় অপরাপর আরো চারটি সংস্থা।

সংশোধিত আইনে দায়িত্ব পাওয়া অন্য চারটি সংস্থা হলো: অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। আর প্রশাসন ও সরকারি কোনো সংস্থাকে মামলার বিষয়ে সহায়তা করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’। সুতরাং বর্তমান সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে সংশ্লিষ্ট আইনের এসব সংশোধন ও প্রণয়ন, নিঃসন্দেহে ইতিবাচক মনোভাবের প্রতিফলন।

আবার খোদ শাসকদলের এবং বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর আপন ছোট ভাই, ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি, সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরকে দু হাজার কোটি টাকা পাচার মামলায় গেল ৮ মার্চ গ্রেফতারের পর আদালতে সোর্পদ করার ঘটনাও সরকারি আন্তরিকতা প্রমাণ করে।

কিন্তু এতো আয়োজনের পরও কেন অর্থপাচারের সিংহভাগ মামলাই নিষ্পত্তি হচ্ছে না। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, মোট মামলার তিন-চতুর্থাংশই এখনও পারেনি নিম্ন আদালতের গন্ডি পেরোতে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে শত শত মামলার বিচার চলছে বছরের পর বছর। এর মধ্যে হাইকোর্টের আদেশে কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে প্রায় শতাধিক আলোচিত মামলা।

তবে অর্থপাচার মামলায় সাফল্যের আলোকচ্ছটাও রয়েছে, এই যেমন কিছু ক্ষেত্রে টাকা ফেরৎ আনা হয়েছে, কয়েজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে হয়তো অনেকেই বলবেন ফেরৎ এবং জব্দকৃত টাকার পরিমাণ যৎসামান্য। কিন্তু বিষয়টিকে বিশাল সমুদ্র থেকে ঝিনুকের মাধ্যমে জলসিঞ্চনের সাথে তুলনা করা এখনি হয়তো যুক্তিযুক্ত হবে না।

জনপ্রত্যাশা হচ্ছে, সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে নিরন্তর, অনতিবিলম্বে বড় অঙ্কের পাচারকারীরাও ভোগ করবে কাঙ্ক্ষিত পরিণতি, অন্তত সেই তোড়জোড়ের প্রমাণ মিলতে হবে দ্রুত, কথায় নয় কাজে। অন্যথায় নিন্দুকেরা তো সদাই রাজনৈতিক রঙ লেপনের সুযোগ খোঁজে।

এরই মধ্যে বাতাসে নানা প্রশ্ন ভাসছে, ডালপালা মেলতে শুরু করেছে নানান সন্দেহ আর শঙ্কা, ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন ভাবনা। ২০২০ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, কানাডায় অর্থ পাচারের ২৮টি ঘটনার তথ্য তারা পেয়েছেন, যেগুলোর মধ্যে সরকারি কর্মচারীই বেশি (বিবিসি বাংলা, ১৯ নভেম্বর ২০২০)। সেই ২৮টি ঘটনা আজও কেন ধরা হয়নি?

আবার ২০২১ সালের ৫ ডিসেম্বর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চে অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত ১৪টি প্রতিষ্ঠান ও ২৯ জনের তালিকা আদালতে দাখিল করেন দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান। তাদের বিরুদ্ধে কি আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে তবে কেন হয়নি? জনমনের সেই প্রশ্ন কি অবান্তর!

আসলে পিকে হালদারদের জন্ম একদিনে হয়নি। ২০০৯ থেকে ১৯ এই এক দশকে নামে বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল করে কিভাবে ঘটলো এই পি কে কাণ্ড! এই দুর্নীতি, অনিয়ম, অর্থপাচারের বিজ কিভাবে অঙ্কুরিত হলো, কাদের প্রচ্ছন্ন ছায়ায়, আলোয়, বাতাসে, পানিতে, দিনে দিনে এই বিষবৃক্ষ পত্র পল্লবে, ফুলে, ফলে সুশোভিত হতে পারলো। আর দুর্নীতির সেই মহিরুহ যখন দেশে বিদেশে বিষবাষ্প ছড়াতে শুরু করেছে তখন আমাদের সম্বিত ফিরে এসেছে, যেন এতোদিনে অবেলায়! কিন্তু কাদেরকে সিঁড়ি বানিয়ে হালদার সাহেবরা দুষ্কর্মের শেকড় থেকে শিখরে উঠতে পারলেন।

একি কেবলই রাষ্ট্রযন্ত্রের কিংবা বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতা, উদাসীনতা দায়িত্বহীনতা, নাকি কর্তাব্যক্তিদের কারো কারো জেগে ঘুমিয়ে থাকার প্রবণতা কিংবা সুবিধাভোগের পরিণাম। এসব প্রশ্নের সদুত্তর জানা এখন সময়ের দাবি, নচেৎ আবারো হয়তো আর দশটা ঘটনার মতোই চাপা পড়বে, বিলীন হবে পিকে হালদারের এই অর্থপাচার সমাচার!

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/জিকেএস

আরও পড়ুন