ডলার, টাকা, বাজার
এখন যেখানেই যাই, সেটা বড়লোকদের আসর, কিংবা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তদের আসর হোক, আলোচনার বিষয় দ্রব্যমূল্য। বোঝা যাচ্ছে গরিব মানুষের পাতে যেমন টান পড়েছে, জিনিসপত্রের দাম সব শ্রেণিকেই চিন্তায় ফেলেছে। টাকার দাম পড়ছে। অর্থাৎ বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে।
কিছু দিন আগেও একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে বাজারে গেলে যতটা চাল-ডাল-তেল-মশলা, তরকারি, ফলমূল, মাছ-মাংস কেনা যেত, এখন তার থেকে অনেক কম পরিমাণে কেনা যাচ্ছে। টাকার দাম পড়ে যাওয়ার আর একটা মানে হল, বিদেশি মুদ্রার বাজারে টাকার নিরিখে আমেরিকান ডলারের দাম বাড়ছে। অর্থাৎ, প্রতিটি ডলার কিনতে এখন বেশি টাকা লাগছে।
মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার অসঙ্গতি এবং ব্যাংকগুলোতে ক্যাশ টাকার অপ্রতুলতা সব আলোচনাই আছে এখন অর্থনীতিতে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান অবমূল্যায়ন করা কখনও সমর্থিত হয়নি সরকারের নীতিতে। ডলারের বিপরীতে টাকার শক্তিশালী মান বজায় রাখা আমাদের দেশে একটি জনপ্রিয় বিষয়। কারণে-অকারণে টাকার মান শক্তিশালী রাখতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এখন সেটা আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।
দেশে এখন আমদানির জন্য যে পরিমাণ ডলার খরচ হচ্ছে, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে তা মিটছে না। ফলে বাড়ছে ডলারের দাম এবং এক পর্যায়ে সেটা ১০০ অতিক্রম করে চলে যায় যদিও গত বুধবার বৃহস্পতিবার প্রতি ডলার ৯৫ টাকা দরে বেচাকেনা হয়েছে। তবে স্বাভাবিক হয়নি ডলারের সরবরাহ।
টাকার মান অবমূল্যায়ন হলে আমদানি করা জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায় ফলে ভোগ কমে। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এখন সেটাই শুরু হয়েছে এখন। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় অনেকেই এখন ভোগ্যপণ্যের ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছেন৷ অনেকেই চলছেন ধারদেনা করে।
শুধু চলতি বছরেই ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে দু’বার৷ সর্বশেষ ঠিক করা হয়েছে লিটার ১৯৮ টাকা৷ কিন্তু ১৯৮ টাকা দামে এক লিটার সোয়াবিন পাওয়া যায় না৷ বাস্তবে ২২০ টাকা। পেঁয়াজ, চাল, চিনি, ডাল, ডিম, মাছ, মাংসের দাম আরো এক দফা বেড়েছে৷ প্রতিটি ভোগ্য পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। নতুন করে বাড়ছে পেয়াঁজের দামও। গরুর মাংসের কেজি এখন ৮০০ টাকার দিকে ছুটছে।
সরকারি হিসেবে মূল্যস্ফীতি ৬.২ ভাগ৷ কিন্তু বাস্তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিশেষ করে করে ভোগ্যপণ্যের দাম গত এক বছরে ২০ থেকে ৪০ ভাগ বেড়েছে৷ কোনো ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশিও বেড়েছে৷ সেটা বিচার করলে বোঝা যায় সরকারের হিসাবের সাথে বাস্তবের মিল নাই৷ অপেক্ষাকৃত সচ্ছলদের তুলনায় গরিব মানুষ খাবার-দাবারের পিছনে তাদের আয়ের আরও বেশি অংশ ব্যয় করে থাকেন, ফলে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে তাদেরই সবচেয়ে ক্ষতি।
সারা পৃথিবী একটু একটু করে কোভিডের কবল থেকে বেরিয়ে আসছিল। বাংলাদেশ অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তায় আগেভাগেই অর্থনৈতিক পূণরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে রাশিয়া -ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় পেট্রো পণ্যের এখন আকাশছোঁয়া দাম। এর মধ্যেই জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করেছেন যে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে বৈশ্বিক খাদ্যসঙ্কট তৈরি হতে পারে। তিনি বলেন, এই যুদ্ধের ফলে পণ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দরিদ্র দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। তার আশংকা, শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন থেকে রপ্তানি স্বাভাবিক না হলে দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে পারে বিশ্ব।
পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে সন্দেহ নেই। তাই আমাদের সতর্কতামূলক পদক্ষেপের বিকল্প নেই। পাকিস্তানি রুপির ইতিহাসের সর্বোচ্চ দরপতনের পর গত বৃহস্পতিবার পাকিস্তার সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে ৩৮ ‘অপরিহার্য নয়, এমন বিলাসবহুল পণ্যের’ আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে গাড়ি, মোবাইল ফোন, সিগারেট, প্রসাধনী সামগ্রী। বাংলাদেশেও এই আলোচনাটা শুরু হয়েছে যদিও বা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে সন্দেহ নেই। তাই আমাদের সতর্কতামূলক পদক্ষেপের বিকল্প নেই। পাকিস্তানি রুপির ইতিহাসের সর্বোচ্চ দরপতনের পর গত বৃহস্পতিবার পাকিস্তান সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে অপরিহার্য নয়, এমন ৩৮টি বিলাসবহুল পণ্যের আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে গাড়ি, মোবাইল ফোন, সিগারেট, প্রসাধনী সামগ্রী।
বাংলাদেশেও এই আলোচনাটা শুরু হয়েছে যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পাকিস্তানের অবস্থার সাথে তুলনা করা কোনভাবেই সাজে না। কিন্তু সতর্ক হতে দোষ নেই। বাংলাদেশ সরকারও কিছু কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে গাড়িসহ বেশ কিছু পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ৭৫ শতাংশ মার্জিন, আরো বেশ কিছু আমদানি পণ্যে ৫০ শতাংশ মার্জিন আরোপ করেছে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় শুধু নিরুৎসাহিত নয়, কিছু পণ্যের আমদানি সাময়িকভাবে সরাসরি নিষিদ্ধ করার কথাও বলছে কেউ কেউ। আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক দর নিশ্চিত করতে মনিটরিং সেল চালু করা ও রফতানির ক্ষেত্রে মূল্যের যথার্থতা যাচাইয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা উঠছে। কালোবাজারি ও মজুতদারদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করলেও বাজারে একটা প্রভাব আসতে পারে।
নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রার ওপর মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব লাঘব করার আগাম প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। ২০০৮ সালর বিশ্বজুড়ে খাদ্যমূল্য বাড়ার প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় টানাপোড়েনে পড়েছিল। প্রায় দেড় দশক ধরে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরে অর্থনীতি এখন আবার এক চ্যালেঞ্জের মুখে।
মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত যারা, তাদের আয় তাল মিলিয়ে বাড়ছে না। তাই তাদের আয় ও প্রয়োজনীয় খরচের মধ্যে ব্যবধান কমছে। কমছে উদ্বৃত্ত। কমছে তাদের পণ্য পছন্দের অধিকার। তাই মাথাপিছু আয় বাড়ার গল্পটা এখন সরকারের দিক থেকে না বলাই ভালো। অতি উচ্চবিত্তের বা ধনীর লাভ বাড়লেও তা কম আয়ের মানুষের জন্য কোন সুখবর নয়। বাজারে ধনীর অধিকার বাড়লে বিশাল বৈষম্য সৃষ্টি হয়।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এমএস