ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে কে এগিয়ে?

ফুরকানুল আলম | প্রকাশিত: ০৯:৫৩ এএম, ২১ মে ২০২২

‘শক্তিতে নিজের চেয়ে দুর্বল শত্রুকে সবসময় ধ্বংস করতে হবে। তবে তারা যদি জীবন সম্পর্কে নিরাশ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তাহলে তাকে আর কষ্ট দেয়া যাবে না’। প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক কৌটিল্য বা চাণক্যের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ক বই অর্থশাস্ত্রের সাংগ্রামিক অধিকরণের শেষ অনুচ্ছেদে এ কথা বলা হয়েছে।

ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের তিন মাস হতে চললো। এরই মধ্যে বিভিন্ন শহর থেকে মার খেয়ে পিছু হটেছে রুশ সেনারা। ইউক্রেনের নিয়মিত সেনাবাহিনীর বাইরেও দেশটির সাধারণ জনতা নাম লিখিয়েছে প্রতিরোধ যুদ্ধে। পশ্চিমাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রের চালান যাদের প্রতিনিয়ত আরও শক্তিশালী করে তুলছে।

২০১৪ সালে যত সহজে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অংশ করেছে ক্রেমলিন এবং দোনবাসের বিশাল একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে রুশপন্থি বিদ্রোহীরা। বর্তমান যুদ্ধে তার চেয়ে অনেক বেশি রসদ দিয়েও সেই ধরনের বিজয়ের দেখা পাচ্ছে না রাশিয়া। যাতে পুরো ইউক্রেন দখলের বদলে অ্যাযভ সাগরতীরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা ও দোনবাস দখলে মনোযোগ দিয়েছে মস্কো।

এতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী মারিওপোলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। যাতে দীর্ঘ প্রতিরোধের পর অবশেষে হার মেনেছে ইউক্রেন সেনারা। তাদের নেয়া হয়েছে রুশ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে। কিন্তু দেশটির বাকি অংশে নিজেদের অবস্থান আরও সংহত করেছে ইউক্রেন বাহিনী।

ওই সেনাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়ার পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছিলেন, সমূলে ধ্বংস হওয়ার চেয়ে এখন এই সেনাদের রুশ বাহিনীর কাছে বন্দি রাখাই যুক্তিযুক্ত। তাদের জাতীয় বীর ঘোষণা করে জেলেনস্কি বলেন, সেনাদের জীবনের মূল্য রয়েছে। বলা হচ্ছে, বন্দিবিনিময়ের আওতায় তাদের ফিরিয়ে নেবে ইউক্রেন। কিন্তু, পশ্চিমা গণমাধ্যমে বীরত্বের নানা গল্পগাথা প্রচারের পর মারিওপোলের অ্যাযবস্টাল স্টিল কারখানায় ইউক্রেন সেনাদের এই আত্মসমর্পণ, টইটম্বুর আত্মবিশ্বাসে কিছুটা হলেও চিড় ধরিয়েছে।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়াকে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কাবু করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। মস্কো আন্তর্জাতিক লেনদেনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম সুইফট থেকে বের করে দিয়েছে। রাশিয়ার তেল-গ্যাস বিক্রিও দুঃসাধ্য করার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি ইউক্রেনকে ৩শ' কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে ওয়াশিংটন। মার্কিন দেখানো পথে হাঁটছে ইউরোপীয় ইউনিয়নও।

রাশিয়ার তেল-গ্যাসের নির্ভরতা কমাতে নানান পদক্ষেপ নিয়েছেন জোটের নেতারা। তাই মার্কিন অনলাইন পোর্টাল দি ইন্টারসেপ্টের জেরেমি স্ক্যাহিলের সাথে আলাপচারিতায় যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্নমতাবলম্বী ও দার্শনিক নোয়াম চমস্কি বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রিয় ইচ্ছাকে পূর্ণ করেছে। সোনার থালায় ইউরোপকে তার হাতে তুলে দিয়েছে’।

বৈশ্বিক সংকটে যত সাহসী ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন অ্যাঙ্গেলা মের্কেল, ইউরোপীয় ইউনিয়নের এখনকার নেতৃত্ব ততটা কার্যকর নয়। জার্মানির সাবেক এই চ্যান্সেলর রুশ ভাষায়ও পটু ছিলেন। ভালো সম্পর্ক ছিল রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে। অনেকে মনে করেন এখন মের্কেল থাকলে, যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি অন্যরকম হতো। রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল ইউরোপের জন্য রাতারাতি বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব নয়। তাই ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্রের শত আহবানে রাশিয়ার কাছ থেকে গ্যাস না কেনার মতো ঘোষণা দিতে পারছে না তারা। উল্টো ইউক্রেনকে সহযোগিতার কারণে পোল্যান্ড ও

বুলগেরিয়াকে গ্যাস দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে রাশিয়া। রাশিয়া থেকে আসে বুলগেরিয়ার গ্যাসের আমদানির ৭৫ শতাংশ আর পোল্যান্ডের ৫৪ শতাংশ। দেশদুটির জন্য চটজলদি এই আঘাত মোকাবিলা করা খুবই কঠিন হবে। চেকরিপাবলিক ও লাটভিয়া শতভাগ, হাঙ্গেরির ৯৫ শতাংশ ও স্লোভাকিয়ার ৮৫ শতাংশ গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। তাই তারা স্বপ্নেও মস্কোর গ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে ভাবতেই পারে না।

এছাড়া, জার্মানির ৬৬ শতাংশ, ফিনল্যান্ডের ৬৭ শতাংশ, এস্তোনিয়ার ৪৬ শতাংশ, রোমানিয়ার ৪৪ শতাংশ, ইতালির ৪৩ শতাংশ, লিথুনিয়ার ৪১ ও গ্রিসের গ্যাস আমদানির ৩৮ শতাংশ মস্কোর। রাশিয়ার গ্যাসের ওপর দেশগুলোর এই নির্ভরতা পুতিনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বড় শক্তি হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই ইউক্রেন ইস্যুতে ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে সবাই নিন্দা পর্যন্তই এগুতে পারছে।

কিন্তু, ইউক্রেনের আশপাশের দেশগুলোতে রুশ আগ্রাসনের ভয় দেখিয়ে এখন অনেকটাই সফল ন্যাটো। এরইমধ্যে সামরিক জোটটির সদস্য হতে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করেছে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন। যাদের সদস্যপদ দিতে ইতিহাসের দ্রুততম গতিতে চলছে ফাইল চালাচালি।

যেখানে ২০১৮ সালে জুলাইতে আনুষ্ঠানিক আবেদনের প্রায় দুই বছর পর ২০২০ সালের ২৭ মার্চে, এখন পর্যন্ত সর্বশেষ সদস্যপদ পায় নর্থ মেসিডোনিয়া। সেখানে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে তা দেয়া হতে পারে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে। তবে, এখানে বড় বাধার নাম হাঙ্গেরি ও তুরস্ক। ন্যাটোভুক্ত দেশের ঐকমত্য ছাড়া কারো সদস্যপদ অনুমোদিত হয় না। যাতে এরইমধ্যে ভেটো দেয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে তুরস্ক। তারপরও, যুক্তরাষ্ট্রসহ বাকিদের আশা, শেষ পর্যন্ত হাঙ্গেরি ও তুরস্ককে বুঝিয়ে এই বাধা কাটানো যাবে।

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতিকে যেমন ঘাতপ্রতিরোধী করছে, তেমনি রুবলকেও যেকোনো সময়ের চেয়ে করছে শক্তিশালী। ঋণ ও লেনদেনের অর্থ বিশেষ করে গ্যাসের অর্থ পরিশোধে রুবলের ওপর জোর দিয়েছে রাশিয়া। এতে তরতর করে বাড়ছে রুবলের চাহিদা। একইসাথে ডলার নির্ভর দুনিয়াকে নতুন পথ দেখাচ্ছে। চীনও তার লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ইয়েনকে গুরুত্ব দিচ্ছে। যা আর্থিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর হলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হাতিয়ার আরেকটু দুর্বল হবে।

বলা হয়ে থাকে, ইউক্রেন যুদ্ধ পুতিনের প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। দোনবাসের দিকে মনোযোগ দেয়ার আগে পুরো রণকৌশল ঢেলে সাজিয়েছেন তিনি। বদলে ফেলেছেন কমান্ডারদের। তারপরও খুব বেশি সাফল্য এখনও আসেনি। যা তাকে আরও মরিয়া করে তুলছে।

এই সময় তার স্বাস্থ্যের নানা জটিলতার খবর চাউর হয়েছে পশ্চিমা গণমাধ্যমে। এমনকি তাদের দাবি, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন পুতিন। তবে এ সব বিষয়ে রাশিয়ার পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য আসেনি। যুদ্ধের যে গতিপ্রকৃতি তাতে এক অর্থে সফল ইউক্রেন। সবাই যেখানে ধারণা করেছিলো, রুশ বাহিনীর আগ্রাসনে সপ্তাহখানেকের মধ্যে পতন ঘটবে ইউক্রেনের। সেটি থেকে এখন অনেক দূরে রাশিয়া। বরং এখন দোনবাস অঞ্চলের পুরোটা দখল করতে পারলেই হয়তো বেজায় খুশি হবে রুশ বাহিনী।

লেখক: নিউজ এডিটর, চ্যানেল 24।

এইচআর/ফারুক/এমএস