তামাকের ব্যবহার কমাতে কর বৃদ্ধি জরুরি
স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছে গেছি আমরা। অর্থনীতি, সামাজিক অনেক সূচকেই ভালো অবস্থানে রয়েছি আমরা। কিন্তু আমাদের উন্নয়নযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে হৃদরোগ, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের মতো নানা অসংক্রামক রোগ। কোনো দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অবশ্যই জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, সুস্থ মানুষের শ্রমের বিনিময়েই দেশ সমৃদ্ধ হয়। এজন্যই জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) লক্ষ্য ৩-এ সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের জীবনাচরণ ও অভ্যাসজনিত কারণে অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব রোগের পিছনে একটি বড় কারণ তামাক ব্যবহার।
বাংলাদেশে পৌনে চার কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। বিপুল পরিমাণ তামাক সেবনের ফলও ভয়াবহ। প্রতিবছর দেশে তামাকজনিত রোগে ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায় এবং বছরে ৪ লাখ লোক হৃদযন্ত্র ও ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে তামাক ব্যবহারের ফলে তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা ও উৎপাদনশীলতা নষ্ট হওয়ার কারণে প্রতিবছর দেশে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়াও তামাক চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, তামাকপণ্য উৎপাদন, কৃষি জমির উর্বরতা হ্রাস, বিড়ি/সিগারেটের ধোঁয়ার পরিবেশগত ক্ষতি রয়েছে। সামগ্রিকভাবেই তামাক জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য বড়ো একটি হুমকি।
তামাকের এই ক্ষতিকর দিকগুলো বিবেচনায় নিয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার। তিনিই বিশ্বের প্রথম কোনো রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি এমন ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি শুধু দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণাই দেননি, বরং এই লক্ষ্য অর্জনে করণীয় সম্পর্কেও আলোকপাত করেছিলেন। তিনি এজন্য তামাক কর কাঠামো সংস্কার এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করার ওপর জোর দেন।
বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার কমানোর পিছনে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো তামাকদ্রব্যের সহজলভ্যতা। বিশ্বে তামাক সস্তা— এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১ সালের তথ্যমতে, সবচেয়ে কমদামে সিগারেট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫টি দেশের মধ্যে ১০৭তম। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সবচেয়ে কমদামি সিগারেটের মূল্য বাংলাদেশের কমদামি সিগারেটের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। অন্যান্য তামাকদ্রব্যও তুলনামূলকভাবে খুবই সহজলভ্য এখানে।
কার্যকরভাবে করারোপের মাধ্যমে তামাকপণ্যের দাম বাড়ানো হলে তরুণ প্রজন্ম তামাকে আসক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে না। অন্যদিকে নিম্ন আয়ের লোকজনও ব্যবহার কমাতে বাধ্য হবে। স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো পণ্যের দাম বাড়লে ধনীর তুলনায় গরিব মানুষের মধ্যে পণ্যের ব্যবহার হ্রাস পায়। একইভাবে তামাকপণ্যের দাম বাড়লেও নিম্নবিত্তরা তামাক ছাড়তে বাধ্য হবে। তবে তামাকের এই দাম বৃদ্ধি হতে হবে মূল্যস্ফীতি ও মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কোনো মানুষের আয় বৃদ্ধির তুলনায় তামাকের দাম কম হারে বাড়লে, সেই দাম তার পকেটে চাপ ফেলতে পারবে না। ফলে ব্যবহারও কমবে না। তামাকের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এদিকটা মাথায় রাখতে হবে।
তামাক কর কাঠামোর আরেকটি ত্রুটি হলো সিগারেটের চারটি মূল্যস্তর থাকা। এর ফলে দাম বাড়লেই ধূমপায়ীরা নিচু স্তরের সিগারেটের মুখাপেক্ষী হয়। কিন্তু ধূমপান থামে না। তাই সবার আগে সিগারেটের এই স্তরভিত্তিক করপদ্ধতি বাতিল করা জরুরি। প্রথম দফায় সেটি সম্ভব না হলে ৪ থেকে কমিয়ে ২ স্তরে নামিয়ে আনা যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত তামাকমুক্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়নে নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে। দেশে তামাকের ব্যবহার হ্রাস, তামাকের পরিবর্তে অন্য ফসল চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করা, তামাক শ্রমিকদের অন্য কোনো ঝুঁকিমুক্ত পেশায় নিয়োজিত করা, তামাকে কর বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও চাহিদা কমানো, জনসাধারণকে তামাক ছাড়তে সহায়তার ব্যবস্থা করা প্রভৃতি পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় আন্তরিক ভাবে সমন্বিত উদ্যোগ নিলে অবশ্যই আমরা বাংলাদেশকে আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত করতে পারবো।
লেখক : সংসদ সদস্য, মহিলা আসন-৬।
এইচআর/এমএস