তেলেই জীবন, তেলেই মরণ!
আমাদের ছেলেবেলায় ভোজ্যতেল মানেই ছিল সরিষার তেল। সব এলাকায়ই দু-একটা ঘানি থাকতো। সেই ঘানি ভাঙা সরিষার তেলেই মিটতো আমাদের নিত্যদিনের চাহিদা। আর ছিল ডালডা। গরিবের ঘি হিসেবে পরিচিত ডালডা দিয়ে বিশেষ বিশেষ উপলক্ষে পরোটা ভাজা হতো, পোলাও রান্না হতো ডালডায়।
বাংলাদেশে নারকেল তেল খাওয়া হয় না। তবে তিল, তিশি, সূর্যমুখী, বাদাম থেকেও অল্পকিছু তেল মিলতো। তবে তেল বলতে সরিষার তেলই ছিল ভরসা। চার দশকে কীভাবে সরিষার তেলের জায়গা দখল করে নিলো সয়াবিন, ভোজ্যতেলের প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ থেকে আমরা কীভাবে ৮০ শতাংশ আমদানিনির্ভর হয়ে গেলাম; সেটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। তবে আমদানিনির্ভর হওয়ার বিপদটা এখন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
জ্বালানি তেলের মতো ভোজ্যতেলের বাজারও আন্তর্জাতিক বাজারে ওঠানামা করে। তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলে দাম যত দ্রুতগতিতে ওঠে, তত শ্লথগতিতে নামে। দাম বাড়ার সময় আন্তর্জাতিক বাজার ফ্যাক্টর হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও সেটার প্রভাব দেশের বাজারে আসে না। জ্বালানি তেলের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি সরকারের হাতে হলেও ভোজ্যতেলের বাজারের চাবি আবার পুরোটাই ব্যবসায়ীদের হাতে। তাই ব্যবসায়ীরাও নিজেদের ইচ্ছামতো ভোজ্যতেলের বাজারে পুতুলনাচ নাচান।
তবে বাজারের অস্থিরতার জন্য শুধু ব্যবসায়ীদের দায় দিলে অন্যায় হবে। ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভ যেমন আছে, আছে সরকারের নিয়ন্ত্রণে শৈথিল্য। তবে আসল কারণটা যুদ্ধ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিশ্ববাজারেই একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। অন্য সব পণ্যের মতো ভোজ্যতেলের বাজারও যেন রোলার কোস্টার, এই বাড়ে তো এই কমে।
এই অস্থিরতার প্রভাব পরে দেশের বাজারেও। এর শুরুটা রমজানের আগে থেকেই। অনেক হইচইয়ের পর সরকার শুল্ক কমিয়ে এবং দাম কমিয়ে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। তবে সরকারের এ উদ্যোগ নিতে কিছুটা দেরি হয়ে যায়। তাই শুল্ক কমানোর সুফলটা সাধারণ মানুষ খুব একটা পায়নি। সুফল যখন সাধারণ মানুষের পাওয়ার কথা তখনই আবার সংকট শুরু হয়।
ঈদের আগে আগে বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় সয়াবিন তেল। ব্যবসায়ীরা জানতেন ঈদের পর তেলের দাম বাড়বে, তাই সবাই স্টক করা শুরু করেন। তাতেই ঈদে তেলের রান্না কমিয়ে ফেলতে হয়েছিল অনেককে। ব্যবসায়ীদের ধারণাই সত্য হয়েছে। ঈদের পরপরই সয়াবিন তেলের দামে নতুন রেকর্ড হয়। এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম এখন ১৯৮ টাকা। আগে যা ছিল ১৬০ টাকা। এক লাফেই বেড়েছে লিটারপ্রতি ৩৮ টাকা। অল্পের জন্য ডাবল সেঞ্চুরি না হওয়া ফেসবুকে মজা করে অনেকে আফসোস করেছেন। দুই টাকার ভাংতি নিয়েও অনেকে মজা করেছেন।
তবে মজা করার দরকার হয়নি। দাম বাড়ানোর পরও বাজারে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। তাই দাম ডাবল সেঞ্চুরি ছাড়িয়ে গেছে কোথাও কোথাও। কম দামে কেনা তেল এখন বেশি দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশে সয়াবিন তেলের মূল উৎস ইন্দোনেশিয়া। কিন্তু সেই ইন্দোনেশিয়া তেল রপ্তানি বন্ধ রাখায় সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। সংকট কবে কাটবে, তা এখনও নিশ্চিত নয়। সংকট কাটলেও দাম আবার জায়গায় ফিরবে, তেমন ভরসা নেই আমার।
বাংলাদেশের বাজারে কয়েকটি পণ্যের দাম বাড়লে হাহাকার তৈরি হয়। এর মধ্যে ভোজ্যতেল একটি। আমি বলি- চাল, আটা, চিনি, তেল, পেঁয়াজ; এই কয়েকটা পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারলে সাধারণ মানুষ একটু স্বস্তিতে থাকে। একদম প্রান্তিক পর্যায়ের কিছু মানুষের তেল দিয়ে রান্না করার মতো পণ্য কেনার সামর্থ্য থাকে না। তাদের তেল ছাড়াও চলে।
তবে সাধারণভাবে তেল একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। চালের দাম বাড়লে আমরা বেশি করে আলু খাওয়ার পরামর্শ শুনি। এবার রমজানে বেগুনের বদলে মিষ্টি কুমড়া ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। তবে তেলের কোনো বিকল্প নেই। তেল ছাড়া রান্না যেমন হয় না, আবার তেল মানেই ঝুঁকি।
অতিরিক্ত তৈলাক্ত রান্না হার্টের জন্য ক্ষতিকর। কয়েক বছর ধরে সাওল হার্ট সেন্টার তেলছাড়া রান্না জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছে। যারা খেয়েছে, তাদের তেলছাড়া রান্না সুস্বাদুও বটে। আমরা সবাই যদি তেল ছাড়া রান্নার কৌশলটা শিখে যেতে পারতাম; তাহলে জীবনও বাঁচতো, অর্থও বাঁচতো।
আমি বিশ্বাস করি সব সংকটই সমাধানের পথ বাতলে দেয়। ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ার পর এক-দুই বছর কোরবানির ঈদে সমস্যা হয়েছে। এখন বাংলাদেশের আর গরু আনতে হয় না। পেঁয়াজ সংকটও পেঁয়াজ উৎপাদনে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। এখন আমরা যদি তেল ছাড়া রান্নার পাশাপাশি ভোজ্যতেলের বিকল্প উৎসগুলোর দিকে নজর দেই, তাহলে সংকট যত প্রলম্বিতই হোক, আমরা বিপদে পড়বো না। সরিষা, বাদাম, সূর্যমুখীর চাষ বাড়ালে; আমদানিনির্ভরতা কমবে। ভোজ্যতেল সংকটের স্থায়ী সমাধান সেখানেই।
শুধু তেল নয়; রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা থাকবেই। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে তার প্রভাবটা হয় বৈশ্বিক এবং সেটা সর্বক্ষেত্রে। গমের মূল উৎস রাশিয়া এবং ইউক্রেন। সম্ভাব্য সংকটের আশঙ্কায় ইন্দোনেশিয়ার মতো অনেক দেশই আগে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে চাইবে। তাই অর্থ থাকলেও সবসময় পণ্য মিলবে না।
সম্ভাব্য এই সংকটের দায় সরকারের ওপর দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। সতর্ক হতে হবে আমাদের সবাইকে। পণ্য ব্যবহারে সংযমী হতে হবে। ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার প্রবণতা ছাড়তে হবে। তবে সবচেয়ে বেশি দরকার সরকারের কঠোর নজরদারি ও সুশাসন। কেউ যেন সুযোগ বুঝে স্টক করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে না পারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে, চেষ্টা করতে হবে দেশে উৎপাদন এবং দেশি পণ্যের ব্যবহার বাড়ানোর।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম