শৈশব কেড়ে নেওয়া নয়, গড়ে উঠুক ক্রীড়া সংস্কৃতি
শুক্রবার মধ্য দুপুরে জাতীয় দৈনিক ও আনলাইন পোর্টালের অনেকগুলোয় খবর ছিল এমন- রাজধানীর কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠে খেলায় মেতেছে এলাকার শিশু কিশোররা। এলাকাসী যেন এমন একটি ক্ষণের অপেক্ষায় ছিলেন বহুদিন।
‘দুই মাস মাঠে খেলতে পারিনি। মাঠে এলে পুলিশ আমাদের ফিরিয়ে দিত। দূরের কোনো মাঠে খেলতে যেতে পারতাম না। বাসায় বসে থেকে বিরক্ত হতাম। এখান মাঠ ফিরে পেয়েছি। আবার খেলতে পেরে খুব ভালো লাগছে’ – এক কিশোর বলছিল একজন সাংবাদিক-কে।
এই কলাবাগান তেঁতুলতলা মাঠ দখলের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন সৈয়দা রত্না ও তাঁর ছেলে, সেটি পরিণত হয়েছিল সামাজিক আন্দোলনে। ফলে প্রবল পরাক্রমশালী বাংলাদেশের পুলিশ এই মাঠে থানা বানানোর জন্য তাদের জেদ ধরে রাখতে পারেনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একেকদিন একেক রকম কথা বলে পরিস্থিতি যখন জটিল করে তুলেছিলেন তখন এগিয়ে এলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঘোষণা দিলেন তেঁতুলতলা মাঠে আর কোনও ভবন হবে না। মাঠ যেভাবে ছিল সেভাবেই থাকবে।
সৈয়দ রত্না কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি নন। তিনি একটি ন্যায্য আন্দোলন করেছেন। অথচ এ জন্য পুলিশ তাঁর উপর বল প্রয়োগ করেছে, তাঁকে তাঁর শিশুপুত্র সহ থানায় ১২ ঘন্টারও বেশি সময় আটকে রেখেছে। বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের প্রতিবাদের মুখে তাঁকে ছেড়ে দিতে অবশ্য বাধ্য হয়, যদিও নাগরিক মর্যাদাহানিকর একটি মুচলেকা সই করে নেয় পুলিশ।
কলাবাগান আন্দোলন সফল হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রামের ডিসি হিল মুক্ত হয়নি, বহু মাঠ দখলদার হাতে আটক বছরের পর বছর। হারিয়েও গেছে বহু মাঠ, খোলা জায়গা। এইতো ৯০-এর দশকেও পুরোনো প্রান্ত থেকে উত্তরা পর্যন্ত মাঠে ময়দানে খেলতে যেতো অনেকে। এলাকার ছেলেমেয়রা নিজেদের মতো করে আবাহনি, মোহামেডান দল বানিয়ে বা নিজেদের কোন ক্রীড়া সংঘ করে নিয়মিত টুর্নামেন্ট আয়োজন করে খেলতো। পাড়ায় পাড়ায় সেই সব প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল বা ক্রিকেট এখন অতীত। স্থানীয় ক্লাবগুলো হারিয়ে গেছে, যেগুলো আছে সেগুলোয় বসে জুয়ার আর ক্যারামের আসর। চিড় ধরেছে ক্রীড়া সংগঠনেও।
ঢাকাসহ সারাদেশে ওয়াজের সংস্কৃতি আছে, মাহফিল আছে, মেলা আছে, কিন্তু ক্রীড়া-সংস্কৃতি নেই। ক্রীড়া-সংস্কৃতি ধরে রাখার পথে অন্যতম অন্তরায় হল মাঠের অভাব। গোটা শহরে খেলার মাঠ বলতে পড়ে রয়েছে শুধু কিছু ক্লাব মাঠ। সেগুলোর অনেকগুলোতেই প্রবেশাধিকার নেই সাধারন মানুষ ও শিশু-কিশোরদের। আর যেগুলো আছে সেগুলোর অবস্থাও দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এসব মাঠে ঘাস নেই, পানির সংযোগ নেই। অসমান মাঠে চোট পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কিছু কিছু মাঠের আশপাশে স্থাপনা নির্মাণ করে প্রায় সব মাঠকেই করে ফেলা হয়েছে এক চিলতে। আগে এলাকায় এলাকায় প্রচুর ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হলেও এখন তা হাতেগোনা।
সমাজ গড়ার কারিগর হিসেবে গড়ে তোলাই শিক্ষার মূল কথা। আজ যারা শিশু, তারাই আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর। তারা নেতৃত্ব দেবে দেশ তথা বিশ্বকে। সমাজ শিশুদের প্রতি কী আচরণ করে, তার মধ্য দিয়ে সমাজের চেহারা ফুটে ওঠে। এই কলাবাগান মাঠে খেলতে চাওয়ায় পুলিশ সদস্যরা শিশুদের কান ধরে উঠ বস করিয়েছে পুলিশ, এমন দৃশ্যও এ সমাজকে দেখতে হয়েছে।
রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড রয়েছে ১২৯টি। কিন্তু তাদের আওতাধীন খেলার মাঠ রয়েছে মাত্র ২০টি। এর মধ্যে উত্তর সিটির রয়েছে আটটি আর দক্ষিণের রয়েছে মাত্র ১২টি। আগেই বলেছি শিশু- কিশোরদের জন্য উন্মুক্ত নেই সব খেলার মাঠ। কিছু জায়গায় তৈরি হচ্ছে বহুতল ভবন আবার কিছু জায়গায় উন্নয়নের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে মাঠ। রাজধানীতে মাঠের সংখ্যা কমার অন্যতম কারণ হচ্ছে, অভিভাবকত্ব ও তদারকির অভাব। অন্যান্য দেশে যেমন মাঠ তদারকির জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ রয়েছে কিন্তু আমাদের দেশে মাঠ তদারকির জন্য একক কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মাঠগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
আমাদের সমাজ অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক ও মুনাফাকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। মাঠগুলো ভিন্ন উদ্দেশ্য ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের অভিভাকদেরও বিষয়টা নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। আমরা নিজেরা ছোটবেলায় কি এই ভাবে পড়াশোনা করেছি? আমরা তো খেলতাম, ঘুরতাম, আনন্দ করতাম। কিন্তু এখন কেন তেমন হয় না? এখন যেমন খেলার মাঠ নেই সে ভাবে, তেমনই নেই অভিভাবকের উৎসাহও। শুধুই পড়া আর পড়া। আর তার কারণ, জীবনযুদ্ধে নিজের সন্তানকে দাঁড় করাতেই হবে! তবেই সেই সন্তান আর তার গর্বিত পিতামাতা সফল। কিন্তু এই তথাকথিত সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে সন্তানের শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা যে করুণ হয়ে উঠছে সে কথা ভাবছি না। শিশুরা তারা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। ব্যাগের বোঝা শিশুমনে প্রভাব ফেলছে, শারীরিক বাড়বৃদ্ধির ক্ষতি করছে। অতিরিক্ত পড়ার ব্যাগের ওজন শিশুর ঘাড় এবং কাঁধের মাংসপেশির ক্ষতি করছে। অতীতের শিক্ষাব্যবস্থায় এ ভাবে শিশুদের শারীরিক ক্ষতি অন্তত হত না। প্রতিযোগিতা আগেও ছিল। কোথাও বেশি, কোথাও কম। কিন্তু তা এমন ভয়ঙ্কর স্তরের ছিল না। প্রতিযোগিতার মোহে এমন সমাজবিস্মৃতি ছিল না।
সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া নেই, তাই শিশুরা ঘরকুনো হয়ে উঠেছে। তাদের স্মার্টফোনে আসক্তি বেড়েছে, বিভিন্ন অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে সমাজে ও ভবিষ্যত প্রজন্মের বেড়ে ওঠায়। নগরে আরও মাঠ চাই, উন্মুক্ত জায়গা চাই, হাঁটাহাঁটির জায়গা চাই, সুস্থভাবে বাঁচতে চাই।
এইচআর/এমএস