‘সঠিক পুষ্টিতে সুস্থ জীবন’
প্রবাদ আছে স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। এ সুখ ও স্বাস্থ্য অনেকটাই নির্ভর করে সুষম খাবার তথা পুষ্টির ওপর। পুষ্টিকর খাবারের অভাব হলেই মানুষ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নানা জটিলতার সম্মুখীন হন। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী বর্তমানে দুই রকমের অপুষ্টির শিকার। খাদ্যের অভাবজনিত পুষ্টিহীনতা এবং খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগের বিস্তার। খাদ্যের অভাবজনিত তথা পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে মানুষ খর্বকায়, নিম্ন ওজন এবং কৃশকায় হচ্ছে।
অন্যদিকে খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগগুলো হলো স্থূলতা, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার ও বেশি বয়সে হাড় নরম হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এছাড়া শিশু মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ এই অপুষ্টি। পুষ্টিহীনতা শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশকে ব্যাহত করে। পুষ্টিহীন শিশু বহুবিধ সীমাবদ্ধতা নিয়ে বেড়ে ওঠে, ফলে পরিণত বয়সে তার পক্ষে সমাজ ও জাতির কল্যাণে যথাযথ অবদান রাখা সম্ভব হয় না।
পুষ্টির অভাবজনিত নানা জটিলতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে ১৯৯৮ সাল থেকে প্রতি বছর জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহ পালন করে আসছে বাংলাদেশ। অন্যান্য বছরের মতো এবারো ‘সঠিক পুষ্টিতে সুস্থ জীবন’ এ প্রতিপাদ্য সামনে নিয়ে ২৩ থেকে ২৯ এপ্রিল জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহ পালিত হচ্ছে।
পুষ্টি হলো পরিবেশ থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যবস্তু আহরণ করে খাদ্যবস্তুকে পরিপাক ও শোষণ করা এবং আত্তীকরণ দ্বারা দেহের শক্তির চাহিদা পূরণ, রোগ প্রতিরোধ, বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরণ করা ৷অর্থাৎ দেহ সুস্থ ও সবল রাখার প্রক্রিয়াকে পুষ্টি বলে।
একটি রাষ্ট্র গঠনের চারটি উপাদানের মধ্যে অন্যতম প্রধান উপাদান হলো মানুষ। মানুষকে সুস্থ-সবল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পুষ্টির গুরুত্ব অপরিসীম। এজন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান পুষ্টিকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
সংবিধানের ১৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবে...’। স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের নানা পুষ্টি সমস্যা ছিল। মানুষের ওজন কম ছিল, স্বাস্থ্য কম ছিল, খর্বাকৃতির ছিল। এখন তা কমে এসেছে। তবে নগরায়ণের ফলে পুষ্টি চ্যালেঞ্জ বেড়ে যাচ্ছে।
মানুষ বিভিন্ন উপাদান থেকে পুষ্টি পেয়ে থাকে ৷মূলত ছয়টি উপাদান যথা- আমিষ, শর্করা, স্নেহপদার্থ, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি থেকে পুষ্টি লাভ করে। এসব উপাদানের অভাবে মানুষ গলগণ্ড, রাতকানা, রিকেটস, রক্তশূন্যতাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়।
তাছাড়া বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিশু প্রোটিন ও ক্যালরিজনিত পুষ্টিহীনতায় ভোগে, যার মধ্যে খর্বাকৃতি ২৮ শতাংশ, কৃষকায় ৯ দশমিক ৮ শতাংশ এবং নিম্ন ওজনে রয়েছে ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ (এমআইসিএস-২০১৯)। গড়ে এক-চতুর্থাংশ নারী দীর্ঘস্থায়ী ক্যালরিজনিত অপুষ্টিতে ভোগে, যাদের অধিকাংশেরই দেহে একই সাথে জিংক, আয়রন ও আয়োডিনের স্বল্পতা রয়েছে।
মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে প্রাণিজ আমিষ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমাদের অনেক অর্জন সত্ত্বেও পুষ্টিতে বেশ পিছিয়ে আছি আমরা। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইন অনুযায়ী আমাদের শক্তির ৬০ শতাংশ আসার কথা শস্যজাতীয় পণ্য থেকে। ১০-১৫ শতাংশ আসার কথা আমিষ থেকে। এই আমিষের ২০ শতাংশ হবে প্রাণিজ আমিষ।
এফএও এর সুপারিশ অনুযায়ী একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের দৈনিক ন্যূনতম ২৫০ মিলি দুধ ও ১২০ গ্রাম মাংস এবং বছরে ১০৪টি করে ডিম খাওয়া প্রয়োজন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, গবেষণা সংস্থা, বিজ্ঞানী, চাষী ও খামারিদের অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশে প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বর্তমানে দেশে মাথাপিছু মাছ, দুধ, মাংস ও ডিম গ্রহণের পরিমাণ যথাক্রমে দৈনিক ৬২ দশমিক ৫৮ গ্রাম, ১৯৩ দশমিক ৩৮ মিলি, ১৩৬ দশমিক ১৮ গ্রাম ও ১২১ দশমিক ১৮টি। বিগত ১২ বছরে দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন যথাক্রমে ৫ গুণ, ৭ গুণ এবং ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস্য মাছ থেকে পাওয়া যায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা হৃদরোগ প্রতিরোধসহ মেধাবিকাশ ও দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়। এছাড়া মাছে রয়েছে অধিক পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থ, ভিটামিন, অপরিহার্য অ্যামাইনো অ্যাসিড ও ট্রাইগ্লিসারাইড, যা হাড় ও দাঁত গঠন, রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমানোসহ হার্ট অ্যাটাক ও ক্যানসারের মতো মরণব্যাধি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
তাছাড়া গর্ভে থাকা শিশুর চোখ ও মস্তিষ্ক গঠনেও মাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে দুধ, ডিম ও মাংস শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও মেধার বিকাশ করতে এবং মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এতে বয়স্কদের অস্থি ক্ষয়রোধ, মানবদেহের প্রাণঘাতী ব্যাধি স্ট্রোক, হৃদরোগ, আথ্রাইটিস ও ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। পাশাপাশি মানুষের দৃষ্টিশক্তি ও স্মরণশক্তি বৃদ্ধি করে। সর্বোপরি সুস্থ সবল মেধাবী জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে দুধ, ডিম ও মাংস।
বর্তমানে দেশে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৩ বছর। এক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে পুষ্টিজাতীয় খাবার। পুষ্টিহীনতার পেছনে কাজ করে দেশের দারিদ্র্যতা। দেশে দারিদ্র্যতা কমলে পুষ্টিহীনতা কমবে। নারীর ক্ষমতায়ন করলে শিশুরা পুষ্টিহীনতায় ভুগবে না।
বর্তমানে দেশে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। অতিদারিদ্র্যের হার ১০ দশমিক ৫ শতাংশ। সর্বোপরি বলা যায়, বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরিত করতে হলে পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: গণযোগাযোগ কর্মকর্তা। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
এইচআর/এএসএম