মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছে যে শহর
যে শহরে আপনার/আমার বসবাস, জীবনযাত্রা, আয়-উপার্জন এবং ভবিষ্যতে সন্তানদেরও যে শহরে বেড়ে ওঠা সে শহরটির দিকে একবার কখনও নজর দিয়েছি আমরা? আজকাল আর এই শহরে কোনো একতলা বিল্ডিং নেই বললেই চলে, ফলে ঘরের ভেতর বসে বাইরে তাকালে আমরা আরেকটি বাড়ির দেয়াল দেখতে পাই। আমাদের দৃষ্টি চলে না। গায়ে গায়ে মিশিয়ে বাড়ি তুলে একটু জায়গাও ছেড়ে দেইনি আমরা কেউ। বাড়ি থেকে বের হওয়া মাত্রই এ শহরের ভাঙাচোরা রাস্তা, ফুটপাথে চলছে মোটরসাইকেল, মানুষ ঠেলে ফেলে দিচ্ছে যখন-তখন। রাস্তা ভরা গর্ত, যে কেউ যে কোনো সময় পাতাল-প্রবেশ করতে পারেন এসব রাস্তায় চলতে গিয়ে।
কোনমতে গলি পেরিয়ে যদি সড়কে ওঠেন তাহলে সেখানে নতুন বাস্তবতায় আপনি পা রাখবেন। যদি গণপরিবহনের যাত্রী হয়ে থাকেন তাহলে আপনি ধাক্কাধাক্কি করে পরিবহনে উঠলেও কখন গিয়ে গন্তব্যে পৌঁছবেন তার কোনো ঠিক নেই। পরিবহনের ভেতরে উঠে আপনার কাছে সাহায্যের নামে চাঁদা দাবি করবে বৃহন্নলারা। কখনও সাপ ছেড়ে দিয়ে ভয় দেখাবে বেদে দল। ছিনতাইকারীর কবলে পড়তে পারেন যে কোনো সময়। অনেক কষ্ট করে হয়তো আপনি পৌঁছলেন গন্তব্যে কিন্তু ফেরার পথে আপনি সেই একই কিংবা তার চেয়েও বেশি বিড়ম্বনার শিকার হয়ে বাড়িতে ফিরবেন, কিংবা আপনি নাও ফিরতে পারেন।
যদি আপনার নিজস্ব যানবাহন থাকে তাও আপনার বিড়ম্বনার ভিন্নতা কিন্তু তেমন একটা হেরফের হবে না। আপনি ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় বসে থাকবেন এবং আপনি তেল পুড়িয়ে পরিবেশ দূষণ ঘটাবেন কিন্তু আপনার কিংবা দেশের তাতে কোনো লাভ হবে না। রাস্তায় বসে থাকার জন্য রাষ্ট্রের এই ক্ষতি প্রতি ঘন্টায় কত তার একটা হিসেব আমরা প্রায়শঃই শুনে থাকি। সেসব হিসেব-নিকেশকে আপনি গালভরা কথা বলে উড়িয়ে দিতে পারেন কিন্তু মাসশেষে আপনি আপনার জ্বালানি খরচ এবং কত কিলোমিটার গাড়ি চালিয়েছেন তা মিলিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন এ শহরে মানুষের জীবনের মূল্য সামান্যই।
যে কোনো সময় যে কোনো ছুতোয় আপনার জীবন যেতে পারে। আপনাকে মিউনিসিপ্যালিটির ময়লা ফেলার গাড়িও ধাক্কা দিয়ে চলে যেতে পারে, আপনার কিছুই বলার থাকবে না, ক্ষতিপূরণতো দূরের কথা। আপনার সন্তানের ভর্তির জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই, যখনই আপনি কোথাও ভর্তির জন্য যাবেন সেখানে হয় দীর্ঘ প্রতীক্ষা নয়তো ক্ষমতাবানদের সহযোগিতা ছাড়া সেখানে আপনার প্রবেশাধিকার নেই। রাষ্ট্রের ক্ষতি আসলে কতটা হচ্ছে।
এ শহরে মানুষের জীবনের মূল্য সামান্যই। যে কোনো সময় যে কোনো ছুতোয় আপনার জীবন যেতে পারে। আপনাকে মিউনিসিপ্যালিটির ময়লা ফেলার গাড়িও ধাক্কা দিয়ে চলে যেতে পারে, আপনার কিছুই বলার থাকবে না, ক্ষতিপূরণতো দূরের কথা। আপনার সন্তানের ভর্তির জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই, যখনই আপনি কোথাও ভর্তির জন্য যাবেন সেখানে হয় দীর্ঘ প্রতীক্ষা নয়তো ক্ষমতাবানদের সহযোগিতা ছাড়া সেখানে আপনার প্রবেশাধিকার নেই। আপনি বাজারে যাবেন সেখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে বিষ মেশানো পণ্যাদি, আপনি ঘামেকষ্টে অর্জিত অর্থের বিনিময়ে সেসব বিষ কিনে এনে নিজে খাচ্ছেন, পরিবারের সদস্যদের খাওয়াচ্ছেন।
এ শহরে রোগাক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বিপুল ও বিশাল। আপনি ভেজাল খেয়ে, বিষাক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিয়ে, ঘিঞ্চি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করে রোগাক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু এখানে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি কর্তৃপক্ষের পক্ষে। আপনি অত্যন্ত চড়া মূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন যেভাবে যেখান থেকে সম্ভবপর হচ্ছে আপনার পক্ষে। আপনি যে বেঁচে আছেন এই শহরে সে সত্যিই এক বিস্ময়ের ব্যাপার বটে।
যদিও ঢাকা দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির শহর। ভারতের মুম্বাইয়ের পরেই ঢাকার অবস্থান। কাগজে-কলমে এই শহরে ২ কোটির একটু বেশি লোকের বসবাস দেখানো হলেও এখানকার জনসংখ্যা কারো কারো মতে ৪ কোটি। পুরো বাংলাদেশের জনসংখ্যা যদি হয় ১৬ কোটি তাহলে পুরো দেশের চার ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যার বোঝা এই ৩০৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের শহরটিতে বসবাস করে। অনেক আগেই এর মৃত্যু ঘটনার কথা ছিল, কিন্তু এখনও কী করে এই শহর টিকে-বর্তে আছে সেও এক বিস্ময়কর ব্যাপার।
এতো কিছুর পরেও ঢাকায় প্রতিদিন ১৭০০ নতুন মানুষ এসে যোগ দিচ্ছেন পুরোনোদের সঙ্গে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের দেয়া এক পরিসংখ্যান থেকে আরো জানা যায় যে, সারা দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৪৭ শতাংশ হলেও রাজধানী ঢাকায় এই হার ৩.৮২ শতাংশ। আর ঢাকার কাছেই অবস্থিত গাজীপুরের মতো জেলাগুলিতে এই সংখ্যা কিন্তু আরও বেশি, প্রায় ২০ শতাংশ।
অর্থাৎ প্রায় মৃত নগরী ঢাকার দুরবস্থা অতি দ্রুত গাজীপুর কিংবা নারায়ণগঞ্জের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো যেসব নগরের জনসংখ্যা ১ কোটির ওপরে জাতিসংঘ তাকে মেগাসিটি নাম দিয়েছে। সে হিসেবে ঢাকাতো মেগা-মেগা-মেগা-মেগা সিটি, ভাবুন একবার এরকম একটি শহরে বসবাসের কারণে কোথায় আপনার/আমার গর্বিত হওয়ার কথা, আর আমরা কিনা আসলে লড়ছি এই শহরের অব্যবস্থাপনা আর ভয়ঙ্কর দূষণের সঙ্গে? জীবন ও ভবিষ্যত বাঁচাতে?
এই যে মৃতপ্রায় (ভদ্র ভাষায় এভাবেই বলতে হচ্ছে, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে বিশেষ করে পশ্চিমে হলে এ শহরকে মৃত ঘোষণা করা হতো অনেক আগেই) শহর ঢাকায় আপনার/আমার বসবাস, একে কি চাইলেই আমরা বসবাসযোগ্য এবং খানিকটা পরিবেশবান্ধবও করে তুলতে পারতাম না? স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশকে বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা প্রতিটি সরকার বলেছে, আমরা শুনেছি। কিন্তু তারপরও শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকুরি এবং ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য ঢাকাই এদেশের একমাত্র কেন্দ্র, এর বিকল্প এখনও হয়ে ওঠেনি কোনো শহর।
আলোচনায় আছে ১০০টি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ দক্ষিণবঙ্গে পায়রা বন্দরসহ একাধিক শিল্পকেন্দ্র গড়ে ওঠার কথা। পদ্মা সেতু হলে ঢাকা থেকে জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমবে বলেও কথা শোনা যায়। কিন্তু ততোদিন এই শহর কি তবে এভাবেই মৃত্যুর দিকে এগুতে থাকবে এবং আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবো?
তাকিয়ে দেখার কথা বলছি কেন? এই শহরে শিশুদের খেলার জন্য সামান্য এক টুকরো জমিও সরকার নিয়ে নিতে চায় ‘থানা’র জন্য ভবন নির্মাণের নিমিত্তে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হলে কিশোর সন্তানসহ মাকে নিয়ে হাজতে পোরা হয়। প্রতিবাদের মুখে তাদেরকে মুক্তি দেয়া হলেও বিষয়টিতো এরকমই থেকে যায় যে, এই শহরকে কেবল ‘সরকারের’ই প্রয়োজন হয়, জনগণের জন্য এই শহর শুধু ‘খাওয়া-মলত্যাগ-বংশবৃদ্ধি’র জায়গা, এর মধ্যে বেঁচে থাকার আর কোনো উপকরণ এখানকার অধিবাসীদের প্রয়োজন নেই এবং যতো দ্রুত এই শহর থেকে একজন মানুষের মৃত্যু হবে ততোই ভালো কারণ তাহলে আরেকজন এসে এই মৃতের জায়গাটি দখল করে, পুনরায় মৃত্যুর দিন গুণতে পারবে।
বিষয়টি একটু নাটকীয় শোনালেও ঘটনা কিন্তু ঠিক এরকমই। ১৬ লাখ মানুষকে যে শহর মোটামুটি স্বাস্থ্যকর একটি বাসস্থান দেয়ার ক্ষমতা রাখে সেই শহরে এখন কাগজে-কলমে জনসংখ্যা ২ কোটিরও বেশি (আগেই বলেছি যে, কেউ কেউ এই সংখ্যার দ্বিগুণ মানুষ ঢাকায় বসবাস করে বলে মনে করেন)। পরিস্থিতি এর চেয়ে ভালো তাহলে হবে টা কি করে?
আমরা আশাবাদী হতে চাই, মরণাপন্ন রোগীও আসলে আশাবাদ নিয়েই চোখ বন্ধ করে, হয়তো কোনো জাদুমন্ত্রবলে তিনি সুস্থ হলেও হতে পারেন। ঢাকার জনসংখ্যার প্রতিটি মৃতপ্রায় নাগরিকও এই স্বপ্ন দেখেন যে, একদিন ঢাকা শহরও মানুষের চাপমুক্ত হয়ে একটি পরিকল্পিত নগরীর চেহারা পাবে, নিঃশ্বাসে বিষ নয়, অক্সিজেনই পাওয়া যাবে। সে লক্ষ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ‘ড্যাপ’ নামে একটি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে বলেও আমরা জানি।
কিছুদিন পর পর ভূমিদস্যুদের সঙ্গে এই ‘ড্যাপ’ বাস্তবায়ন নিয়ে বাহাসও চলে কর্তৃপক্ষের। সমাধান কি হয় না হয় তা আমরা জানতে পারি না। আমরা শুধু দেখতে পাই যে, ঢাকা শহর আরও দূষিত হতে হতে পৃথিবীর এক নম্বর দূষিত নগর হয়ে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, ঠিক আছে, ঢাকা শহরকে আর কিছু করা না গেলেও আরেকটি উপায় আছে, যদি ঢাকার আশেপাশের নগরীগুলোকে ঢাকার সঙ্গে সফল ও কম সময়ের পরিবহন ব্যবস্থার সাহায্যে জুড়ে দেওয়া যায় তাহলে ফলাফল আসবে দ্রুত, এ শহর হয়তো বসবাসের যোগ্য হয়ে উঠলেও উঠতে পারে।
ব্যাপারটা সেরকম হতেই পারে, দিনমান মানুষ এই শহরে কাজ করলো আর সন্ধ্যায় তারা ফিরে গেলো ঢাকারই কাছের কোনো সবুজ-শ্যামল, পরিবেশবান্ধব, পরিকল্পিত নগরীতে, যেখানে ঘুমন্ত শিশু পুষ্ট হয় বিশুদ্ধ অক্সিজেনে। এখন যারা কর্মক্ষম তাদের জীবনের বিনিময়ে পরবর্তী প্রজন্মকে তারা দিয়ে গেলেন এক নিরাপদ ও দূষণমুক্ত জীবন। এরকমটি আশা করা যায়, যদি দেশের তথা এই নগরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে যারা আছেন, যারা আইন প্রণয়ন করেন, মোটকথা যারা সরকার পরিচালনা করেন তারা যদি এমনটি চান।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার করেছি আমরা, এতোদিন তারা ঢাকা শহরকে চাইলেই বদলে ফেলতে পারতেন, চাইলেই পারতেন ঢাকাকে সফলভাবে জুড়ে দিতে আশেপাশের নগরীগুলোর সঙ্গে, যেখানে মানুষ প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারতো। সেটা যেহেতু হয়নি সেহেতু আশা করারও ‘আশা’ থাকে না আমাদের আর। অন্তর্জালে ঢাকা শহরের কিছু ড্রোন-ধারণকৃত ভিডিওচিত্র ঘুরতে দেখা যায়। উড়ালসড়কসহ যেটুকু সবুজ এখনও আছে তা থেকে ঢাকাকে ভিন্নরূপে দেখা যায় সেসব চিত্রে। কিন্তু এ শহরের মানুষের মনেতো চিত্রটা ভিন্ন। এখানে প্রতিদিন মানুষ মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে। এই বেঁচে থাকাকে আরেকটু অর্থবহ করতে আন্তরিক কর্তৃপক্ষকে কোথাও দেখা যায় না, এটাই পীড়াদায়ক সত্য।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম