ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ী সহাবস্থান জরুরি

ড. প্রণব কুমার পান্ডে | প্রকাশিত: ১০:১৮ এএম, ২৪ এপ্রিল ২০২২

গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী এবং তৎসংলগ্ন এলাকার বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে চলমান সংঘর্ষ। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের সাথে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক কিংবা কর্মচারীদের সংঘর্ষের ঘটনা বিভিন্ন সময় ঘটেছে। তবে এবারের সংঘর্ষ দীর্ঘমেয়াদি হয়েছে এবং এ সংঘর্ষে দুই পক্ষেরই বেশ কিছু মানুষ আহত হয়েছে, প্রাণ গেছে দুই জনের যা একেবারেই কাম্য নয়। তবে এ ধরনের সংঘর্ষ কেন ঘটছে এবং দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব কি হতে পারে সেই বিষয়ে বিভিন্ন মহলের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা দোকানের কর্মচারীকে মেরেছে-এই মর্মে একটি মিথ্যা তথ্য ছাড়িয়ে দিয়ে ব্যবসায়ীরা শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয় এবং পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরাও ব্যবসায়ীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ে। পুলিশ চেষ্টা করেছে দুই পক্ষের মধ্যে দাঁড়িয়ে উভয় পক্ষকে নিভৃত করবার। যদিও শিক্ষার্থীদের তরফ থেকে পুলিশের প্রতি একপেশে আচরণ করার অভিযোগ উঠেছে। ভিডিও ফুটেজের ওপরে ভিত্তি করে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত রিপোর্টে স্পষ্ট দেখা গেছে দুই দোকানের কর্মচারীর মধ্যে দ্বন্দ্বের পরে সেই কর্মচারীরাই ঢাকা কলেজের একদল শিক্ষার্থীকে এই সংঘর্ষে লিপ্ত করেছে এবং পরবর্তীতে এটি ব্যাপক আকার ধারণ করে।

সংঘর্ষ কিছুটা স্তিমিত হলে প্রশাসনের বিভিন্ন পক্ষের হস্তক্ষেপে প্রথম দিন পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায়। পরবর্তীতে মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী মহোদয় সেই স্থান পরিদর্শন করে সকলের সাথে কথা বলে পরিস্থিতি ঠাণ্ড করবার চেষ্টা করেছেন। পরিস্থিতি যেন আরো খারাপের দিকে না যায় সে কারণেই ঢাকা কলেজের ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও শিক্ষার্থীদের তরফ থেকে বলা হয়েছিল যে তারা হল ছাড়বে না এবং যে কোনো মূল্যে তারা হলে অবস্থান করবে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে এই ঘটনার জের হয়তো সাময়িকভাবে প্রশমিত করা যেত, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি একটি সমাধান নয়। উভয় পক্ষ যদি তাদের সহাবস্থান বজায় না রাখে তাহলে উভয়পক্ষেরই ক্ষতি। সেই এলাকাগুলিতে যদি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান না চলে তাহলে শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক সমস্যা তৈরি হবে। আবার ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে যে বিষয়টি অনুধাবন করা প্রয়োজন সেটি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তারা যে পরিমাণ অর্থ আয় করে শিক্ষার্থীরা যদি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তাদের সে আয় বন্ধ হয়ে যাবে। অতএব উভয় পক্ষেই যদি সমঝোতার ভিত্তিতে সহাবস্থান নিশ্চিত না করে তাহলে এই ধরনের অশান্তি চলতেই থাকবে।

তবে সাধারণ চোখে ঘটনাকে শিক্ষার্থী এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হিসেবে ব্যাখ্যা করা হলেও এর পেছনে কোন শক্তি বা গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা আছে কিনা তা খুঁজে বের করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত। দুইটি দোকানের কর্মচারীদের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষের পরে কেনইবা একটি পক্ষ ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের তাদের পক্ষে নিয়ে এসে সংঘর্ষে লিপ্ত করলো এই বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। এটি একেবারেই কাকতালীয়, না এই ঘটনার অন্তরালে অন্য কোন ঘটনা রয়েছে- এটি স্পষ্ট করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের আমরা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি গোষ্ঠী দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কখনো বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর প্রচেষ্টা, কখনো বা বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সমস্যা তৈরি করা, কিংবা কখনো রাজনৈতিক ইস্যুতে বিবাদমান দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ফলে এই ঘটনার পেছনের কোন ঘটনা আছে কিনা সেটি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে এবং তা খুঁজে বের করতে হবে।

এছাড়া এই ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনার বলি হয়ট সাধারণ মানুষ বা পথচারি-যাদের এই ঘটনার সাথে কোনই সম্পৃক্ততা নেই। এই ধরণের ঘটনা ঘটলে তা হয় অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। অন্যান্য বিভিন্ন ঘটনার মতো এই ঘটনাতেও আমরা নিরীহ পথচারী নাহিদের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর খবর দেখেছি। নাহিদ জীবিকার কারণে কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারি ম্যানের কাজ করত। মাত্র ৬ মাস আগে নাহিদ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং তার স্ত্রীকে নিয়ে কামরাঙ্গীরচরে বসবাস শুরু করে। যে মেয়েটির হাতে মেহেদির রং এখনো মোছেনি, স্বামীকে হারিয়ে সেই মেয়েটি কি মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে সে বিষয়টি আমরা কেউই চিন্তা করিনা।

আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি যে নাহিদের বাবা-মা অত্যন্ত দরিদ্র। উপার্জনক্ষম একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে তাদের কি হবে কিংবা তারা কিভাবে দিন অতিবাহিত করবে-এ বিষয়টি কি বিবাদে জড়ানো অংশগ্রহণকারী কোন পক্ষই চিন্তা করবে? নাহিদের মৃত্যুই একমাত্র মৃত্যু নয়। আমরা এর আগেও বিভিন্ন সংঘর্ষে পথচারীর মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছি।

একই ঘটনায় কাপড়ের দোকানে চাকরি করা মোরসালিন নামের আরেক জন ব্যক্তি মারা যায়। ফলে এখন সময় এসেছে এই ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনাগুলো পেছনে যারা মুখ্য ভূমিকা পালন করে তাদেরকে চিহ্নিত করে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার। এই ধরনের মানুষদের শাস্তি দেওয়া গেলে ভবিষ্যতে অন্যরা এ ধরনের ঘটনা ঘটাবার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে।

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্যান্য স্কুল-কলেজ এবং এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংযুক্ত হতে দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সমর্থন দিয়েছে। এমনকি ছাত্রলীগের বিভিন্ন স্তরের নেতারা এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ প্রশমিত করবার চেষ্টা করেছে। তবে তারা পাশাপাশি এটাও বলেছে যে ব্যবসায়ীদের এই ধরনের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে যে দাবি উঠেছে সেটি হল ঢাকা কলেজ যদি বন্ধ থাকে তাহলে সেই অঞ্চলের কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারবে না।

ঘটনা ঘটে যাওয়ার তৃতীয় দিনে যখন নিউমার্কেটের বিভিন্ন দোকান খুলতে শুরু করে তখন সেই খবরের প্রেক্ষিতে কলেজের শিক্ষার্থীরা আবার নিউমার্কেটে সামনে অবস্থান গ্রহণ করে। পরবর্তীতে পুলিশের মধ্যস্থতায় তারা সেখান থেকে ফিরে যায় এবং নিউমার্কেটের দোকানগুলো আবার বন্ধ হয়ে যায়। এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকলে উভয় পক্ষের জন্য ক্ষতির বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।

ব্যবসায়ীদের মনে রাখতে হবে যে নীলক্ষেত এবং এর আশেপাশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা হল তাদের কাস্টমার। ঈদকে সামনে রেখে যে কয় দিন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে তাতে তারা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ধরনের ঘটনা যদি না ঘটানো হতো তাহলে তাদের এই ক্ষতির শিকার হতে হতো না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ব্যবসায়ী সমিতিকে ধন্যবাদ উভয় পক্ষকে সাথে নিয়ে ঐক্যমতের ভিত্তিতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য। একটি ইতিবাচক বিষয় হল যে উভয় পক্ষই সংঘর্ষের প্ররোচনাকারী অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আরেকটি বাস্তবতা হল সেই অঞ্চলে যে সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের মালিকদের সন্তানরা হয়তো ঢাকা কলেজ কিংবা তার আশেপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করে। ফলে তাদেরও এক ধরনের দায়বদ্ধতা রয়েছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনা ঘটে দোকানের কর্মচারীদের মাধ্যমে। ফলে মালিকদের কর্মচারীদের সম্পর্কে আরও সচেতন হওয়া উচিত। কারণ কর্মচারীদের যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় এবং তাদের মাধ্যেমে যদি কোন ঘটনা ঘটে তবে তার সার্বিক দায়িত্ব মালিকদের ওপর বর্তাই। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও উচিত তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা।

শিক্ষার্থী এবং ব্যবসায়ী কেউ কারো প্রতিদ্বন্দ্বী নয়- এই বিষয়টি উভয় পক্ষকেই অনুধাবন করতে হবে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে নিজেদেরকে গড়ে তুলবার জন্যে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে তাদের অর্থ উপার্জনের জন্য। দুই পক্ষের সদস্যদের বুঝতে হবে যে সংঘাত তাদের কারোর জন্য কাম্য নয়।

পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও গুরুত্ব সহকারে বিষয়টির গভীরে যেয়ে তদন্ত করতে হবে। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে আগামী ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের ভিতরে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সকল পরিকল্পনার মূলেই রয়েছে দেশে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি করা। প্রকৃতপক্ষে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মাধ্যেমে একটি গোষ্ঠী ফায়দা লুটতে চায়। এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সজাগ থাকতে হবে। পাশাপাশি সচেতন নাগরিক সমাজকে এই ধরনের ঘটনা সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ।

এইচআর/জেআইএম