ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সিনিয়র সিটিজেনদের দিকে আসুন দৃষ্টি দিই

ডা. পলাশ বসু | প্রকাশিত: ০৯:৫৩ এএম, ২৪ এপ্রিল ২০২২

জীবন এক বহমান সময়। বয়ে চলে আপন নিয়মে। এক সময়ে তার শেষও হয়। স্বাভাবিক কিম্বা অস্বাভাবিক নিয়ম যেভাবেই হোক না কেন তার শেষ হবেই। এটাই সত্য। ধরে নেয়া হয়, স্বাভাবিক নিয়মে একজন মানুষ শৈশব, কৈশোর, যৌবন পার করে বার্ধক্যে পৌঁছার পরেই যেমন তার জাগতিক কর্ম থেকে ছুটি হয়ে যায় তেমনিভাবে মহাকাল এসে এক সময় তাকে গ্রাস করে নেয়। বেজে ওঠে অনন্তের পথে চলার ছুটির ঘন্টাটি। আর অস্বাভাবিক মৃত্যুর তো কোনো সময় নেই। নেই কোন হিসাব-কিতাব।

উন্নত বিশ্বে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে ‘‘সিনিয়র সিটিজেন” বলে শুধু লোক দেখানো সম্মান নয়; বরং তাদের জীবনকে উপভোগ করার জন্য যথাসাধ্য সকল ব্যবস্থা রাষ্ট্রই করে থাকে। অনেক সিনিয়র সিটিজেন আছেন যারা এ বয়সেও সমান কর্মক্ষম থাকেন। তাদের চিন্তা, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতাকে সমাজ এবং রাষ্ট্র কাজে লাগায়। এর ফলে তারাও দেশ ও দশের অগ্রগতিতে পূর্বের ন্যায় অংশগ্রহণ করতে পেরে সম্মানিতও বোধ করে থাকেন।

উন্নত বিশ্বের কথা মাথা রাখলে এটা অন্তত বলতেই হবে যে, আমাদের দেশে ৬০ বছর ও এর বেশি বয়সী নাগরিকদের সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কারণ আগে স্বীকৃতিটুকুই ছিলো না। এ সংক্রান্ত নীতিমালা ২০১৪ সালে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। সে আলোকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ঐ বছরেই প্রবীণ ব্যক্তিদেরকে “সিনিয়র সিটিজেন” হিসেবে ঘোষণা করেন।

এ সময়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য আলাদা পরিচয়পত্র দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। দুঃখের বিষয় হলো- সে পরিচয়পত্র আজও দেয়া হয়নি। তেমনিভাবে তাদের সেবা পাওয়ার সুযোগ-সুবিধাও নিশ্চিত করা সম্ভবপর হয়নি। যদিও ১৯৯৭-৯৮ সাল থেকে আমাদের দেশে বয়স্ক ভাতা চালু হয়েছে। যদিও এত বছর পরে এসে সে সেবা আরো মজবুত ও দৃঢ়ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে যাবার কথা ছিল। বাস্তবে তা হয়ত নানাকারণেই হয়নি।

প্রবীণ নীতিমালা এবং বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মায়ের ভরণপোষণের জন্য আইন প্রণীত হলেও রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আমাদের আরো জোর প্রচেষ্টা নেয়া দরকার। কারণ আমাদের পূর্বসূরীদেরকে ভালো রাখার দায়িত্ব তো আমাদেরই। আমার দৃষ্টিতে প্রবীণ বয়সে ৩ টি জিনিসের খুব বেশি প্রয়োজন হয়। খাদ্য, চিকিৎসা এবং নিরাপদ বাসস্থান। এর সাথে বিনোদনসহ তাদেরকে কর্মমুখর রাখার জন্য স্ব স্ব ক্ষেত্রে কিভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে সে ব্যাপারেও উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এজন্য স্বল্প পরিসরে আমি কিছু প্রস্তাবনা রাখছি-

(১) প্রথমেই আসা যাক প্রবীণদের খাবার গ্রহণ প্রসঙ্গে। বৃদ্ধ বয়সে আমরা জানি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা দরকার। শুধু ভাত খেলে হবে না। তাছাড়া ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, হাইপারটেনশনসহ নানাবিধ জটিলতাও তৈরি হয়। এজন্য সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য এলাকাভিত্তিক সরকারি দোকান চালু করতে হবে। সেখানে নির্ধারিত কার্ডের মাধ্যমে ফ্রি অথবা স্বল্পমূল্যে ডিম, দুধ, শাকসবজি, ফলমূল বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

(২) বৃদ্ধ বয়সে নানাবিধ রোগব্যাধি হবে এটা ধরে নিতে হবে। এজন্য ইউনিয়ন সাবসেন্টার থেকে শুরু করে জেলা হাসপাতালগুলোকে “সিনিয়র সিটিজেন”দের চিকিৎসা বান্ধব করে তুলতে হবে। তাদের শুধু শারীরিক নয়; মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থাও রাখতে হবে। এজন্য এসব হাসপাতালে আলাদা আউটডোরসহ ইনডোরে অন্তত কিছুসংখ্যক বেড বরাদ্দ রাখতে হবে। সেই সকল ওয়ার্ডে যারা কাজ করবেন তারা যেন জেরায়াট্রিক্স বা প্রবীণদের চিকিৎসা ও সেবায় পারদর্শী হন সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

শুরুতেই এমন দক্ষ জনশক্তি হয়ত পাওয়া যাবে না। সে কথা মাথায় রেখে চিকিৎসক, নার্স, সাইকিয়াট্রিস্ট, সাইকোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান, ফিজিওথেরাপিস্টসহ বা আরো অন্য সাপোর্টিং জনবল তৈরিতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ ও কোর্স চালু করতে হবে।

(৩)প্রবীণ মানুষদের দেখাশোনা করার মতো লোকের অভাব এখনই দৃশ্যমান হচ্ছে। সামনে তা আরও প্রকট হবে।দেখা যায়, অনেক প্রবীণ ব্যক্তি আছেন যাদের অর্থসম্পদ আছে। থাকার জায়গা আছে। কিন্তু দেখাশোনা বা সেবা করার লোক নেই। তাদের জন্য “কেয়ার গিভার” লাগবে। ফলে কেয়ার গিভারের মতো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে মনোযোগী হতে হবে। উন্নত বিশ্বেও কেয়ার গিভারদের চাহিদা প্রচুর। ফলে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হলে নিজেদের প্রয়োজন যেমন মিটবে তেমনিভাবে আমরা বিদেশেও এ জনশক্তি রপ্তানি করতে পারব।

(৪) এখন প্রবীণ নিবাস বা আশ্রয় নিবাস তৈরিরও মনে হয় সময় হয়ে এসেছে। সরকারি এবং বেসরকারি আলাদা এবং যৌথ- দুদিক থেকেই এ দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আগেই বলেছি, অনেক প্রবীণ আছেন যাদের অর্থ-বিত্ত আছে কিন্তু দেখাশোনা করার মতো লোক নেই। আবার অনেকে আছেন যাদের দেখাশোনার লোক আছে। কিন্তু পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েন কিম্বা সদস্যদের ইচ্ছের অভাবে এ সকল প্রবীণের শেষ বয়সটা খুবই অবহেলা বা অনাদরে কাটছে। তাদের শেষ জীবনকে একটু হাসিখুশিতে ভরিয়ে দিতে প্রবীণ নিবাস বা আশ্রয় নিবাস তৈরির বিকল্প নেই। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণদের ইনকোর্সের একটা অংশ এসব নিবাসে কাজের মাধ্যমে মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। তাতে করে এসকল তরুণদের বাস্তবভিত্তিক সেবামূলক জ্ঞান আহরণের সুযোগ তৈরি হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রও তাতে নিশ্চয় উপকৃত হবে।

পরিশেষে বলব, প্রবীণদের জন্য আশ্রয় নিবাস তৈরি, তাদের চিকিৎসা এবং দেখাশোনা করার জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তোলা আর দেরি না করে সমন্বিতভাবে শুরু করতে হবে। অন্ততপক্ষে জেলাওয়ারি সার্ভিলেন্স করে সে অনুসারে শুরুটা করা যেতে পারে। একবার শুরু হয়ে গেলে নিশ্চয়ই তা ধীরে ধীরে উন্নততর হতে থাকবে-সে প্রত্যাশা করা যেতেই পারে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ, সাভার।

এইচআর/জেআইএম