ধর্ম, হিন্দু আইন ও মানববোধে বহুবিবাহ
পঞ্চগড়ের রোহিনী চন্দ্র বর্মণ তার দুই প্রেমিকাকে এক আসরে একসঙ্গে বিয়ে করেছেন। তিন পক্ষই এই বিয়েতে রাজি থাকায় সামাজিকভাবেই তাদের একসঙ্গে বিয়ে দেয়া হয়েছে। ফেসবুকে এই নবত্রম্পতিকে অভিনন্দন এবং শুভ কামনা জানানোর ঝড় বইছে। হিন্দু, মুসলমান সবাই এই “সাহসী সিদ্ধান্তকে” স্বাগত জানিয়ে মন্তব্য দিচ্ছে। কিন্তু সমাজের সবাই তো এত ভাল নয়, বিশেষ করে এখন বেপর্দা, বেলজ্জা নারীদেরও অনেকেই ফেসবুক ব্যবহার করেন। তাদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, “এখন যদি ১ টা মেয়ের দুইটা প্রেমিক হতো তাহলে সে কলঙ্কিনী, ছলনাময়ী হয়ে যেত। সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারতো স্থানীয় সমঝোতাকারীরা?”
এই ধরনের বেপর্দামুখো বেলজ্জা নারীদের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের অনেক পুরুষও আছে। ঘটনাচক্রে আমিও বেপর্দামুখো। তাই আমারও প্রশ্ন, “একটি মেয়ে একসঙ্গে দুই ছেলের সঙ্গে প্রেম এবং দুই ছেলেকে বিয়ে করলে কি বলতেন?”
এই সমাজে এধরনের প্রশ্ন বেমানান। নারী একসঙ্গে একাধিক স্বামী রাখবে তা কেউ কল্পনায় আনতে পারে না। কিন্তু পুরুষের বহুগামিতা এখানে সমাজস্বীকৃত। মানুষের মননে এবং মগজে এই অপকর্ম স্বীকৃত। এই মানসিকতা ও কার্যক্রমকে পুরুষতন্ত্র বা নারীনিপীড়নতন্ত্র বলে। যে দুইজন মেয়ে এক স্বামীর দাসত্ব মেনে নিয়েছে, ভিকটিম হলেও তারাও আসলে পুরুষতন্ত্রী। এখানে নারী, পুরুষ, শিশু সবাই পুরুষতন্ত্রী; অর্থাৎ নারী-নিপীড়নতন্ত্রী। এই জায়গায় বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান মোটামুটি এক জায়গায় আছে। তবে মুসলমানদের আইন একসঙ্গে চারটির বেশি বিয়ে করতে দিচ্ছে না। হিন্দু পুরুষদের জন্য কোনো সীমা নেই।
এই রোহিনী নামক ছেলেটি যেভাবে একসঙ্গে দুই কন্যাকে বিয়ে করেছে, ঠিক একইভাবে মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডব হিসেবে পরিচিত যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব – এই পাঁচ ভাইকে একসঙ্গে বিয়ে করেছিলেন দ্রৌপদী সতী। মহাভারতে এবং বিভিন্ন পুরাণে এক নারীর একইসঙ্গে একাধিক পতি গ্রহণের আরও বেশকিছু নজির আছে। প্রাচীনকালের মাতৃতান্ত্রিক সমাজের নিদর্শনগুলো প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে আছে। কিন্তু সেই নিদর্শনকে এখনকার মানুষ আর মানতে চাইবে না। কারণ, আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজ সময়ের স্রোতে বদলে গিয়ে পুরুষতান্ত্রিক হয়ে গেছে। অল্প কিছু সমাজে মাতৃতন্ত্র বিভিন্নরূপে এখনো ঠিকে আছে। পৃথিবীর ইতিহাস আসলে সমাজ পরিবর্তনেরই ইতিহাস। পরিবর্তনের নানাবাঁক পেরিয়ে আজকের এই পৃথিবী।
সনাতন ধর্মের গ্রন্থগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্ম ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা হওয়ায় সেখানে নানারকম বৈচিত্র্য পাবেন। সেখানে নারী-পুরুষ সমতন্ত্র, মাতৃতন্ত্র এবং কোনো এক পর্যায়ে চরম পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়নের দৃষ্টান্তগুলোও আছে। ইংরেজরা যখন হিন্দু আইন বানিয়েছে তখন সেইসব শাস্ত্র থেকে কিছু নিয়েছে, কিছু নেয়নি।
বাংলাদেশের হিন্দু আইনে বর্তমানে স্বতন্ত্র বসবাসের সুযোগ আছে, কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের সুযোগ নেই। ইংরেজরা বিদায় হওয়ার আগে ১৯৪৬ সালে আবশ্যক ক্ষেত্রে আলাদা বসবাসের সুযোগ দিয়ে একটি আইন করেছিল। “The Hindu Married Women's Right to Separate Residence and Maintenance Act, 1946” নামের হিন্দু আইনটি নারীকে ভরণপোষণ নিয়ে আলাদা বাস করার সুযোগ দিলেও তাদেরকে আবার বিয়ে করার সুযোগ দেয় না। আলোচ্য ঘটনার দুইজন নারী এখন যদি জীবনের বিরম্বনা থেকে বাঁচার জন্য ভুল শোধরাতে চায়; যদি তারা বিবাহ বিচ্ছেদ চায় এবং নতুন করে বিয়ে করতে চায়– তার কোনো সুযোগ হিন্দু আইনে নেই।
একজন মেয়ে যদি একবার কোনো পুরুষকে বিয়ে করে– সেই পুরুষ যদি দুর্বৃত্ত হয়, লুচ্চা হয়, অত্যাচারী হয় এবং এমনকি চোর-ডাকাত বা দস্যুও হয়– তার সঙ্গে মতের অমিল হলেও সারাজীবন ঐ পুরুষের সেবা করে যেতে হবে নারীকে। এমন কি বিয়ের পর যদি প্রমাণিত হয় ঐ পুরুষটি সম্পূর্ণরুপে যৌনসামর্থ্যহীন – ছেলেটি যদি মদ্যপ মাতাল হয়, হিরোইনখোর হয়, কিংবা পাগল হয়; সে যদি বাসায় না থেকে ফুটপাতে বা রাস্তাঘাটে পরে থাকে – তবুও ঐ পুরুষকেই ধ্যানজ্ঞান করে বাকি জীবন কাটাতে হবে নারীকে। এটাই বাংলাদেশে বিদ্যমান হিন্দু আইনের বিধান।
এই আইন ভারত বা হিন্দু অধ্যুষিত পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। ইংরেজদের বানানো এই আইন বাংলাদেশে এখনো চালু আছে। এই আইনের সঙ্গে ধর্মেরও কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ ধর্মশাস্ত্রে এধরনের পুরুষকে ত্যাগ করে নতুন করে বিয়ে করার সুস্পষ্ট নির্দেশ নারীকে দেওয়া আছে। পরাশর সংহিতায় বলা হয়েছে,
“নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরণ্যো বিধিয়তে।”
এর অর্থ হল, স্বামী যদি নিরুদ্দেশ হয়, মারা যায়, প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে (অর্থাৎ সন্ন্যাসী হয়ে যায়) ক্লীব (পুরুষত্বহীন) হয় অথবা পতিত (ধর্ম বা সমাজ থেকে বিচ্যুত) হয় –এই পাঁচ প্রকার বিপদ উপস্থিত হয় তবে নারীর জন্য অন্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া বিধেয়। গরুড় পুরাণের প্রথম খণ্ডের ১০৭ নম্বর অধ্যায়ের ২৮ নম্বর শ্লোকেও হুবহু একই কথা বলা হয়েছে।
যেহেতু একসঙ্গে যতজনকে (পত্নী অথবা রক্ষিতা) ইচ্ছা সঙ্গে নিয়ে বসবাসের সুযোগ হিন্দু পুরুষের আছে, সুতরাং পঞ্চগড়েরর ঐ রোহিনীর একসঙ্গে দুই বিয়ে আইনসম্মত। প্রাপ্তবয়স্ক হলে, আইনগতভাবে তাদেরকে বাধা দেওয়ার সুযোগ নেই।
আইয়ুব খান ১৯৬১ সালে ‘মুসলিম পারিবারিক আইন’ প্রণয়ন না করলে আজও এক অন্ধকারময় জগতে বাস করতে হতো বাংলাদেশের মুসলমানদের। ঐ আইনের কারণে বর্তমান বাংলাদেশে হিল্লে বিয়ে বন্ধ হয়েছে। মুখের কথায় এখন আর তিন তালাক হয় না; তিনবার নোটিশ দিতে হয়। একজন মুসলিম পুরুষ বর্তমানে একসঙ্গে সর্বোচ্চ চারজন স্ত্রী রাখতে পারলেও প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করার সুযোগ নেই। এধরনের বহুগামিতার সুযোগ কেড়ে নেওয়ার ঐতিহাসিক মহান কাজটি করে গেছেন একজন সামরিক স্বৈরশাসক। অথচ ভারত, বাংলাদেশ এবং পকিস্তানের তথাকথিত গণতান্ত্রিক দলগুলো প্রগতিশীল আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে খোঁড়াদের মতো চলছে এবং বেপাত্রে হোঁচট খাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের পঙ্গুত্ব ও অসহায়ত্ব প্রমাণ করছে। ভারতে যখনই মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধনের কথা উঠছে, তখনই সেখানকার কট্টরপন্থী মুসলমান রাজনৈতিক ও সমাজপতিরা চিৎকার চেঁচামেচি করছে। একই অবস্থা বাংলাদেশেও। আমরা যখনই হিন্দু আইন সংশোধনের দাবি করছি তখনই একটি পুরুষতান্ত্রিক স্বার্থান্বেষী মহল বাধা দিচ্ছে।
এখন কেউ বলতে পারেন, আইনে যেহেতু অধিকার আছে তাহলে আপনার কি? দুইজন মেয়ে যদি স্বেচ্ছায় তার সঙ্গে বিয়ে করতে রাজি হয়, তাহলে আপনার বাধা দেওয়ার কি অধিকার আছে? মেয়েদের স্বেচ্ছায় বোরকা পরার যে যুক্তি দেখানো হয় সে রকম যুক্তি আর কি!
পঞ্চগড়ের আলোচ্য দুই মেয়ে কি আসলে স্বেচ্ছায় রোহিনী নামক ঐ নড়বড়ে চেহারার ছেলেটিকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে? বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী রোহিনী তার প্রথম প্রেমিকা ইতি রানীকে এর আগে গোপনে বিয়ে করেছিলেন। ইতিকে বিয়ে করার পরেই তার সঙ্গে তার প্রেমেরও ইতি হয়ে যায়। তখন তিনি প্রেমে মজেন মমতার সঙ্গে। গত ১২ এপ্রিল মমতার সঙ্গে দেখা করতে যান রোহিনী। পরে দুজনকে একত্রে দেখে আটকে রেখে বিয়ে দেন মমতার পরিবারের লোকজন।
নীলফামারি, পঞ্চগড়সহ রংপুর বিভাগের ঐ দারিদ্র্য পীড়িত গ্রামাঞ্চলগুলোতে যৌতুক থেকে বাঁচার জন্য ছেলেদের আটকে রেখে বিয়ে দেওয়ার চল আছে। রোহিনীর বিয়ের সংবাদ শুনে তার বাড়িতে অনশন শুরু করেন তার আগের স্ত্রী ইতি রানী। এ অবস্থায় দুই কন্যাই একসঙ্গে সঙ্গে ঘর করতে রাজি হয়। বুধবার (২০ এপ্রিল) রাতে তাদের দু’জনকে আবারও আনুষ্ঠানিকভাবে একসঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়।
তাহলে বলুন, কোন পরিস্থিতিতে একজন নারী স্বামীকে ভাগাভাগী করে নিতে বাধ্য হয়? এর নাম স্বেচ্ছায়! রিমান্ডে নিয়ে হাত-পা ফুটিয়ে দিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করলেন, আর নাম দিচ্ছেন- তারা স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছে!
নারীকে আপনি বলবেন কলঙ্কিনী, ছলনাময়ী; অথচ নিজে সকাল-বিকেল যৌনপল্লীর জল খাবেন – এই ভন্ডামো চিরকাল চলতে পারে না। সমাজকে বদলাতে হবে, উন্নত হতে হবে। রাষ্ট্রকে এর দায়িত্ব নিতে হবে। উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করতে হবে।
আইনকে পাশকাটিয়ে জীবনের তাড়নায় বা করুণ বাস্তবতায় এখন হিন্দুদের মধ্যে বেআইনি বিবাহ বিচ্ছেদ এবং বেআইনি বিয়ে অনেক হচ্ছে। তাতে অনেক জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এভাবে চলতে পারে না। সুবিচার পাওয়া মানুষের অধিকার। সরকার মাথা গুণে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। একজন মানুষও যদি ন্যায় চায় তাহলে তা দিতে হবে। সরকারকে সংবিধান মানতে হবে। “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী” – সংবিধানের এই ঘোষণা বাস্তব করতে হবে। ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হলেই ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক: সাংবাদিক; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ।
এইচআর/এমএস