দুটি মৃত্যু ও কিছু প্রশ্ন
দুটি অতি সাধারণ মানুষের মৃত্যু। তারাও মানুষ। কিন্তু তারা আসলে কোনওদিন এদেশে মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচেন নি, মরার সময়ও নয়। কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারিম্যান নাহিদ হোসেন, আর দোকান কর্মচারী মুরসালিন। তাদের জীবন কেড়ে নেয়া হয়েছে ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থী বনাম নিউমার্কেট ব্যবসায়ীদের সহিংসতায়। কুড়ি বছর বয়সের নাহিদ মাত্র সাত মাস আগে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর পেশার কাজে গিয়েছিলেন নিউমার্কেট এলাকায়। তাঁর ১৮ বছর বয়সের স্ত্রী, সদ্য-বিধবা, মুঠোফোনে স্বামী নাহিদের ছবি দেখে কান্না করছেন। মাত্র ২৫ বছর বয়সের দোকান কর্মচারী মুরসালিন স্ত্রীর নাম মিতু, তার দুটো শিশুসন্তান আছে। সেই দুই শিশু বাবাহারা হলো, মিতু স্বামীহারা হলেন।
সহিংসতায় এমন করে নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না, কিন্তু মেনে নিতে হয়। কারণ এরকম ঘটনা এদেশে নতুন কোন কিছু নয়। আগের রাতে দুটি দোকানের কর্মচারীদের মধ্যকার সংঘর্ষে কেমন করে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা জড়িয়ে যায়? গভীর রাতে সেই সংঘাত থেমে গেলে কী করে পরদিন আবার শুরু হয়ে এত সহিংস হয়ে উঠে?
কেন এমন উন্মত্ততা? সামান্য কথাকাটাকাটি থেকে এমন সহিংস আন্দোলন এদেশেই সম্ভব। সবাই আধিপত্য চায়। গ্রাম থেকে উঠে এসে ভাগ্যদোষে একটি ছেলে দোকান কর্মচারী হয়েছে, আর ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছেলেটি ঢাকা কলেজের পাকা ভবনের হোস্টেলে থাকছে। দু’জনের রুট এক হলেও সমাজ তাদের আলাদা করেছে এবং তাদের ভেতর যার যার (চর) অঞ্চল দখলে রাখার রাজনীতি শিখিয়েছে। আধিপত্য কায়েমের এই ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত আছে সহিংস আচরণ যাকে আমরা নাগরিক ভাষায় বলি ‘সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স’।
ছোট বড় মিলিয়ে ২৯টি মার্কেট এই এলাকায়। ঢাকা কলেজ ছাড়াও এখানে আরও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আবার এই নিউ মার্কেট, গাউছিয়া, নুর ম্যানশন বা ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট এ শহরের বড় লোকের মার্কেট নয়। যারা দরাদরি করে জামা কাপড় বা প্রয়োজনীয় জিনিস কেনেন তাদের মার্কেট এগুলো। ফলে এখানো ফুটপাথ দখলে থাকলে, পথচারী হাঁটতে না পারলে, যান চলাচল আটকে থাকলে নীতি নির্ধারক মহলে কোন টনক নড়ে না।
নিউমার্কেটে, গাউছিয়ায়, হকার্স মার্কেটের ভেতরে যত দোকান, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি দোকান বাইরে ফুটপাথে। এরা চাঁদা দিয়ে ফুটপাতের বরাদ্দ নেয়, আবার প্রতিদিন চাঁদা দেয়। এক হিসেবে বলা হয়েছে, এই এলাকার ফুটপাথের দোকান থেকে প্রতি মাসে চাঁদা উঠে দশ কোটি টাকার মতো।
একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে জানালেন, তাঁর চাকরি জীবনের শুরুতে একবার তিনি এই এলাকার ফুটপাথ পরিষ্কার করার উদ্যোগ নিতে গিয়ে দেখেছেন এটি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কারণ এই ফুটপাথের দোকানগুলো থেকে চাঁদা তোলা এবং সেটা নানা জায়গায় সরবরাহের যে নেটওয়ার্ক তা ক্ষমতা কাঠামোর রাঘব বোয়ালদের নিয়ন্ত্রণে। এ কারণেই এখানে ব্যবসা থামে না, দখল থামে না, সংঘাত থামে না। এবং এসব ব্যবসা, দখল, আর সংঘাতের ভেতর দিয়ে একটি প্রবল পক্ষ নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে একটি সাম্রাজ্য কায়েম করেছে যেখানে সহিংসতা অনিবার্য এবং দু’একটি মৃত্যু স্বাভাবিক হিসেবেই বিবেচিত।
দুটি পক্ষ ছিল। ছাত্র ও ব্যবসায়ী ও তাদের কর্মীরা। আত্মস্বার্থরক্ষা কত বড় ইস্যু সেটার প্রদর্শনী ছিল এই উন্মত্ততা। কিন্তু এই এলাকার বড় প্রশাসক সিটি মেয়র, তাঁর কাউন্সিলররা। আছেন একজন সংসদ সদস্যও। এখন এমনভাবে নির্বাচন হয় যে, এমপি বা কাউন্সিলরকে, সেটাও এলাকার জনগণ জানেনা, এসব জনপ্রতিনিধিদেরও জনগণের কাছে যেতে হয় না। কিন্তু দিনভর এরকম সহিংসতা হলো, পুলিশ এলো দেরি করে, কিন্তু দেখা মিলল না এলাকার এমপি ও কাউন্সিলরদের। এমনকি সংঘর্ষ থামার পর যে, সমঝোতা বৈঠক হলো সেখানও দেখা নেই তাদের। দেখা গেল দোকানদার নেতা, পুলিশ কর্মকর্তা আর শিক্ষকদের।
পুলিশের দেরিতে আসা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি আমরা জানতে চাই দায়িত্ববানদের কেউই কেন সকাল সকাল হাজির হলেন না ঘটনাস্থলে? কেন সারাটা সকাল অরক্ষিত পড়ে থাকল পুরো এলাকা? ব্যবস্থা মানেই কী কেবল পুলিশি ব্যবস্থা? নেতারা কোথায় ছিলেন? এমপি বা কাউন্সিলররা কোথায় ছিলেন? তবে কী তারা থাকেন কেবল অকাজের উৎসবে?
জনগণ তাদের ইচ্ছামতো যে কোনও ব্যক্তিকেই প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেন, সে অধিকার তাদের সংবিধানে দেওয়া আছে। বিপরীতে যে কোনও ব্যক্তিরই সমাজের প্রতিনিধিত্ব করবার অধিকার রয়েছে এবং সেটা আইনগত অধিকার। সেভাবে নির্বাচন হয় না এখন। তাই হয়তো এরা এলাকার সমস্যায় নিজেদের দায়িত্বের কথা অনুভব করেন না। নামে জনপ্রতিনিধি হলেও এরা অনুসরণযোগ্য কোনও উদাহরণ স্থাপন করতে পারছেন না। তারা আসলে মানুষের প্রতিনিধিত্বই করছেন না। সমাজের প্রতি, পরিবেশের প্রতি, মানুষের প্রতি প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা যাদের নেই তারা সেই তকমা নিয়ে বসে আছেন যার যার গদিতে।
এইচআর/এমএস