নির্বাচন কমিশন: বৈঠকে হবে কি সমাধান?
নির্বাচন কমিশন তথা প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রক্রিয়াটি এবার আদালতের নির্দেশেই হোক আর যে ভাবেই হোক একটি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি আইন প্রণয়নের কথা থাকলেও সেটি সম্ভব হয়নি। না হওয়ার কারণ আছে এবং সেগুলো না বুঝলে পরে নির্বাচন কমিশন কেন এতো বিতর্কিত হলো সে বিষয়টি সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারবো না।
আমাদের সব জাতীয় সমস্যার গোড়া যেমন ১৯৭৫ সাল তেমনি নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং তাদের কেবলই ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহারের সূত্রপাতও দেশের প্রথম সামরিক সরকার জেনারেল জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নভেম্বর পর্যন্ত গোটা দেশটা ছিল একটা জেগে ওঠা চরের মতোন। যে যখন যেভাবে পেরেছেন লাঠি-বন্দুক নিয়ে এই চর দখল করার জন্য নেমে পড়েছেন। কখনো রেডিও স্টেশন দখল করে, কখনও বঙ্গভবনে গিয়ে অসুস্থ রাষ্ট্রপতির মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে বলেছেন, সই করে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে।
টেবিলের ওপর পা তুলে বসে বন্দুক পাশে রেখে একজন সামরিক জেনারেলের কীর্তিকলাপ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সায়েম তার বঙ্গভবনের স্মৃতিকথায় স্পষ্ট লিখে গেছেন। রাষ্ট্র ক্ষমতাই যখন এভাবে দখল হতে পারে তখন রাষ্ট্রের বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন গঠন ও তাদের কর্মপ্রক্রিয়া যে সুষ্ঠু ও সুস্থ থাকবে সে আশা নিশ্চয়ই আমরা করতে পারি না। থাকেওনি। ক্ষমতায় বসেই একটি হ্যাঁ/না ভোটের ব্যবস্থা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। আকাশ থেকে হেলিকপ্টার দিয়ে লিফলেট বিলিয়ে এর প্রচারণা চালানো হয়েছিল।
পরে জানা গিয়েছিল যে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি কে এম নুরুল ইসলাম বাধ্য হয়েছিলেন নির্বাচনে শতভাগ ভোট পড়ার এবং বলাই বাহুল্য প্রায় নব্বই ভাগ ভোটার হ্যাঁ-কে জয়যুক্ত করেছেন বলে সার্টিফিকেট দেওয়ার। যদিও জানা যায় না এই কাণ্ডটিও বন্দুকের নলের সামনে ঘটেছিল কি না। কিন্তু বিচারপতিদের হাত ধরে নির্বাচন কমিশনকে নষ্ট করার শুরুটা করেছিলেন বিচারপতি নুরুল ইসলাম এবং সর্বশেষ পেরেকটি মেরেছেন বিচারপতি এম এ আজিজ সাহেব।
কী হয়নি নির্বাচন কমিশনারদের হাত ধরে? জাল ভোট, নির্বাচন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এবং কোটি কোটি জাল ভোটারদের বৈধতা দেওয়া এবং নির্বাচনের পূর্বনির্ধারিত ফলাফলকে পাখির মতো পাঠ করে যাওয়া- এসব সবই আমরা বাংলাদেশের নির্বাচনে দেখেছি।
ফলে নব্বইয়ের দশকে ক্ষমতা সেনাবাহিনীর জেনারেলদের হাত থেকে জনগণের হাতে এলেও সেনাবাহিনীর হাতে গঠিত রাজনৈতিক দলের পক্ষে সেনাতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখানো সম্ভব হয়নি। মজার ব্যাপার হলো এই সময়টায়ও দুজন বিচারপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তারা একটি সুষ্ঠু ও বৈধ নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারেননি। রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ ও নির্দেশনায়ই তারা নির্বাচন কমিশনকে চালিয়েছেন এবং নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছেন।
প্রথমবারের মতো বিচারপতিদের বাইরে এসে নির্বাচনকে মোটামুটি একটি সুষ্ঠু ধারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন মোহাম্মদ আবু হেনা। অবসরপ্রাপ্ত সচিবদের হাতে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব যাওয়ার উদ্বোধন তার হাতে পড়লেও তার পরবর্তী অবসরপ্রাপ্ত সচিব এম এ সাঈদ যে নির্বাচনটি ২০০১ সালে করেন তা নিয়ে চরম বিতর্ক তৈরি হয়। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে ও পরে দেশে ঘটে যাওয়া রক্তকাণ্ড বন্ধে তার ব্যর্থতা ছিল ভয়ংকর। অন্য যে কোনো সভ্য দেশ হলে তাকে বিচার বিভাগীয় তদন্তের মুখোমুখি হতে হতো এবং তার প্রাপ্য শাস্তি তাকে বুঝে নিতে হতো। কিন্তু বাংলাদেশে তো সেই অর্থে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি।
নির্বাচন কমিশনের এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাসটি এ কারণে উল্লেখ করা জরুরি ছিল যে, এর পরবর্তী যে নির্বাচন কমিশনকে দেশের সুশীল সমাজ এবং রাজনীতিবিদরা সবচেয়ে ক্ষমতাবান ও কার্যকর বলে মনে করেন সেই ড. এটিএম শামসুল হুদা কিন্তু নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দেশের রাজনীতিকে চরমভাবে হস্তক্ষেপ করেছিলেন এবং কথিত আছে যে, তিনি রাজনৈতিক দলকে ভেঙে সেনাবাহিনী ও চিহ্নিত সুশীলদের দেওয়া ফর্মুলা অনুযায়ী নতুন পক্ষকে প্রতীক দেওয়া কিংবা রাজনৈতিক দলের মূলধারাকে রাজনীতিচ্যুত করার চেষ্টা করেছিলেন, যদিও জনগণ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরোধিতার মুখে তিনি সেটি করতে ব্যর্থ হন। তিনি বাধ্য হন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনেকদিন পরে বাংলাদেশ একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে পেয়েছিল।
বিচারপতি এম এ আজিজের হাত থেকে তিনি নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পেয়েছিলেন এবং তাকে এজন্য আমাদের কৃতিত্ব দিতেই হবে যে, তিনি সেই এক কোটি ভুয়া ভোটারকে চিহ্নিত করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে একটি ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়নে সক্ষমতা দেখাতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এই ঘটনা বিশেষ হিসেবে চিহ্নিত থাকতে হবে।
ড. শামসুল হুদা পরবর্তী নির্বাচন কমিশনকে আমরা দু’ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি, যদিও সবার মধ্যেই প্রধান মিলটি হলো তারা সকলেই সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা তথা সাচিবিক দায়িত্ব পালন শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব লাভ করেন। দেশের প্রশাসন ব্যবস্থায় তারা যেমনই থাকুন না কেন নির্বাচন কমিশন হিসেবে কাজী রকিবুদ্দিন আহমদ এবং তারপরে কে এম নূরুল হুদা কমিশন যে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে পারেননি সে কথা স্বীকার করতেই হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতা না করলে এদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান যে সম্ভব নয় সেটি প্রমাণ করেছেন এই দুই নির্বাচন কমিশন। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো মূল খেলোয়াড় হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে যে ভ’মিকা পালনের কথা সেটি না সরকারী না বিরোধী, কোনো পক্ষ থেকেই নির্বাচন এই নির্বাচন কমিশনদ্বয় পাননি। প্রথমতঃ সরকার পক্ষ চেয়েছে শুধু জয়ী হতে আর বিরোধী পক্ষ নিজেদেরকে ‘অসহায়’ প্রমাণের জন্য বলতে গেলে নিষ্ক্রিয় থেকেছে।
বিদেশিদের কাছে নালিশ জানানোর অজুহাত খুঁজেছে এবং তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহেও চরম ব্যর্থতার প্রমাণ দিয়েছে। সুযোগ ছিল নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী প্রমাণ করার, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কিন্তু সেটি এই দুই নির্বাচন কমিশনের কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি। কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের কথা আমরা বলতে পারি যেখানে তারা ভূমিকা রেখেছিলেন বাকি নির্বাচনসমূহ বিশেষ করে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনকে নূরুল হুদা কমিশন অহেতুক বিতর্কিত করেছেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে কাজী রকিবুদ্দিন আহমদের কিছু করার ছিল না কারণ দেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণতো করেইনি, বরং নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বানচাল করার জন্য হেন কোনো পথ নেই যে তারা অবলম্বন করেনি। রাজপথে তাদের শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ নেই বলে দাবি করলেও নির্বাচন বন্ধে সারা দেশকে তারা মোটামুটি গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
সংক্ষেপে বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসের এই চিত্র থেকে আমরা আরও দেখতে পাই যে, ড. শামসুল হুদা কমিশন থেকেই নির্বাচন কমিশন দেশের সুশীল সমাজ, পেশাজীবী সমাজ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আলোচনায় বসার একটা রেওয়াজ তৈরি হয়েছে। এর আগে নির্বাচন কমিশন আসতেন, নির্বাচন করতেন মেয়াদ শেষ হলে চলে যেতেন, তাদের গায়ে দোষ যেটুকু লাগতো সেটা কেবল মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ বা বিশ্লেষণেই থাকতো। কিন্তু তারপর থেকে আলোচনার নামে, পরামর্শের নামে একটি আলোচনার জায়গা তৈরি হওয়া হয়তো গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য উপকারী কিন্তু সেই আলোচনা থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে এতোদিন বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ থাকতো বলে আমার মনে হয় না। কারণ অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক বিশিষ্ট ব্যক্তিই নির্বাচন কমিশনকে বিস্তর পরামর্শ দিয়ে আসেন এবং পরদিন পত্রিকার পাতা থেকে টেলিভিশন সংবাদ থেকে আমরা সেসব জানতে পারি। সকলেই গঠনমূলক পরামর্শ দেন, নিশ্চয়ই নির্বাচন কমিশনে সেসব নথিবদ্ধও থাকে, কিন্তু তার প্রয়োগ যে হয় না তার প্রমাণতো আমরা কোনো নির্বাচনেই দেখতে পাই বলে প্রমাণ নেই। তাহলে এই আলোচনার অর্থ কি? লোকদেখানো হলে সেটা ভিন্ন কথা।
গতকাল বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিদের সঙ্গে যে বৈঠকটি হয়েছে তাতে প্রায় সকলেই নির্বাচন সুষ্ঠু করতে, সব পক্ষকে ভোটে আনতে নির্বাচন কমিশনকে আস্থার সংকট কাটিয়ে ওঠার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির শিশুপাঠই হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো কখনোই একত্রিত হয়ে কোনো এক ব্যক্তির ওপর আস্থাশীল হতে পারেনি, পারবে বলেও মনে হয় না। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হতেই হবে। কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে একথা বলেই আসছেন যে, কোনো একটি পক্ষকে নির্বাচনে নিয়ে আসার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন পালন করতে পারবে না।
কথা সত্য, এটা তার দায়িত্বের মধ্যে পড়েও না। যদি তাই হয়ে থাকে, অর্থাৎ ২০১৪ সালে কাজী রকিবউদ্দিন কমিশন বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে কোনো ভূমিকা নেননি, তেমনই এবারও হয়তো কাজী হাবিবুল আউয়াল সে কাজটি করতে পারবেন না বলেই মনে হয়। সেক্ষেত্রে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চয়ই বসে থাকবে না? আর সেরকম কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আমরা কি হাবিবুল আউয়াল সাহেবকে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান না করার জন্য ব্যর্থ কমিশন হিসেবে দায় দিতে পারবো?
ফলে আলোচনা যতোই হোক না কেন, নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী খেলোয়াড়দেরকে আগে একমত হতে হবে যে, তারা নির্বাচন করবেন এবং রেফারিকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবেন। তবেই হয়তো এদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বা হতে পারবে। নাহলে এসব আলোচনা কেবল নির্বাচন কমিশনের ‘মাইনুটস’ বইতে নথিভুক্ত থাকবে, এর বেশি কিছু হবে কি?
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।
ঢাকা ১৯ এপ্রিল, মঙ্গলবার/২০২২
[email protected]
এইচআর/জিকেএস