ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

অন্যদের কমে আমাদের বাড়ে কেন?

ড. হারুন রশীদ | প্রকাশিত: ০৯:৪৬ এএম, ১৮ এপ্রিল ২০২২

চলছে সিয়াম সাধনার মাস রমজান। সব ক্ষেত্রে সংযম সাধনাই রমজানের অন্যতম লক্ষ্য ও বৈশিষ্ট্য। অথচ রমজানে উল্টো চিত্র দেখা যায় আমাদের দেশে। যে যেভাবে পারেন রমজানে টুপাইস কামিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টায় থাকেন। অথচ অন্য দেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানোর প্রতিযোগিতা চলে।

এবারও রমজান মাসে রোজাদারদের সেবায় ৮০০টিরও বেশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার। এক বিবৃতিতে খবরটি দিয়েছে দেশটির বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়। এই মূল্যছাড় রোজার আগে থেকেই কার্যকর হয়েছে। রমজান মাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই পণ্যমূল্য মেনে চলতে নির্দেশনাও দেওয়া হয়।

রমজানজুড়ে কাতারের সব বাজার ও সুপারশপে ভোক্তা অধিকার রক্ষা কর্মকর্তাদের অভিযান চালিয়ে নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছে কাতারের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়। নির্দেশনা লঙ্ঘনের তথ্য জানাতে ১৬০০১ নম্বরের পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের টুইটার ও ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে অভিযোগ করতেও বলা হয়েছে।

দুই.
আমরা চলেছি উল্টো পথে। রমজান এলেই নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন দেখা দেয়। রমজানে অপরিহার্য এমন অনেক পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়ে যায় কোনো কারণ ছাড়াই। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মুনাফার লোভে কারসাজি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়, যা রমজানের চেতনার পরিপন্থি। অন্যদিকে এই সংযমের মাসেই দেখা যায় বিত্তশালীদের বাড়াবাড়ি।

তারা খাদ্যের অপচয় করেন। অথচ অনাহারি ও অভাবক্লিষ্টরা কত কষ্টে থাকে। তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করাও রমজানের শিক্ষা। এছাড়া রমজানে রাজধানীর অন্যতম সমস্যা যানজট আরও তীব্র আকার ধারণ করে। এসব দিকে নজর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

রমজানে জনভোগান্তি দূর করার জন্য সব সময়ই দাবি থাকে। কিন্তু দেখা যায় এই সময়ে নানা ক্ষেত্রে ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, যানজট তীব্র আকার ধারণ করা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সংকট দেখা দেওয়া, ভেজালের সমারোহ ইত্যাকার নানা সমস্যায় জর্জরিত থাকে মানুষজন। সব কিছু মিলে এক অরাজক অবস্থা। অথচ সংযমের মাস পবিত্র রমজানে সব ক্ষেত্রেই দায়িত্বশীলতা ও নীতি-নৈতিকতার উন্মেষ ঘটার কথা।

যে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়ান, তিনি অন্তত রমজানে তা করবেন না; যারা খাদ্যে ভেজাল মেশান, তারা তা থেকে বিরত থাকবেন, যানজট দূর করতে আগের থেকেও সক্রিয় হবে পুলিশ—এভাবে সব ক্ষেত্রেই একটি ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে চায় মানুষ। কিন্তু রোজার প্রথম ধাক্কাটা লাগে পণ্যের বাজারে। এবারও রমজানের আগে থেকেই বাজার চড়া।

অথচ অন্য দেশে কোনো উৎসব-পার্বণে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দেওয়া হয়, যাতে ভালোভাবে সবাই সেই উৎসবে অংশ নিতে পারে। আমাদের দেশে এর উল্টো চিত্র। এ ব্যাপারে অনেক কথা হলেও কাজের কাজ খুব কমই হয়। এবারও রমজানের শুরুতেই প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। দেখার যেন কেউ নেই। ভোক্তাদের পকেট কাটা যাবে আর প্রশাসনযন্ত্র তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে এটা হতে পারে না। এ ব্যাপারে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে ন্যায্যমূল্যে ভোক্তারা পণ্য পায়।

রমজানে টিসিবির কার্যক্রম আরও জোরদার করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ বাজারে সমান্তরাল একটি সরবরাহব্যবস্থা থাকলে কোনো সিন্ডিকেটই খুব বেশি সুবিধা করতে পারবে না। তাছাড়া নিম্ন আয়ের লোকজন যেন অল্প দামে জিনিসপত্র কিনতে পারে, সেই ব্যবস্থাও চালু রাখা প্রয়োজন। এজন্য শুধু নামে কার্যক্রম চালালেই হবে না, যথেষ্ট পণ্য যেন মজুত থাকে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখাও জরুরি। টিসিবির পণ্য যেন সব জায়গায়ই পাওয়া যায়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারণাও চালাতে হবে।

অন্যদিকে রমজান মাসে যানজট তীব্র আকার ধারণ করে। অফিসগামী ও অফিসফেরতদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। শুধু ব্যবস্থাগত ত্রুটি ও অনেক ক্ষেত্রে অবহেলার কারণে যানজট এত তীব্র আকার ধারণ করে। কিন্তু যানজট দূর করতে বাড়তি কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। যানবাহনগুলো নিয়ম মেনে না চললেও সেগুলো দেখার কেউ নেই। কিন্তু এ অবস্থা চলতে পারে না। রমজানে অফিস সময় কমিয়ে দেওয়া হয়, যাতে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সবাই মিলে ইফতার করতে পারে। কিন্তু সে সময় যদি রাস্তায়ই নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী থাকতে পারে।

দুঃখজনক হচ্ছে, রমজানে যানজট নিরসনে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নতিতে নানা কৌশল নির্ধারণের কথা থাকলেও তা টিকছে না। স্থবির রাস্তায় অস্বস্তি আর ভোগান্তি নিয়ে যানবাহনে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হয়েছে অফিসগামী মানুষকে। খোঁড়াখুঁড়ির কারণে রাস্তায় যানজট হচ্ছে। কয়েক মাস ধরে চলা যানজটের ধারাবাহিকতায় রমজানেও তার প্রভাব পড়েছে। মেট্রোরেলের জন্য উন্নয়নকাজ চলায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে অনেক দিন ধরে। রমজানেও তা থেমে নেই। এক লেনে দুটির বেশি গাড়ি যেতে পারছে না। ফলে দেখা দিচ্ছে তীব্র যানজট।

রমজানের সময় খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ রাখার দাবি থাকলেও তা হয়নি। অথচ রোজাদাররা বাড়িতে গিয়ে যাতে সময়মতো ইফতার করতে পারেন সেজন্য কর্মঘণ্টা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে সময় যদি যানজটে পড়ে রাস্তায়ই নষ্ট হয়ে যায় এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে। প্রতিদিনই রাস্তায় নামছে অসংখ্য গাড়ি। কিন্তু সে অনুযায়ী রাস্তাঘাট কি বাড়ছে? অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কি নিশ্চিত হচ্ছে? ট্রাফিক ব্যবস্থা কি আধুনিকায়ন হচ্ছে?

তিন.
রমজানের রোজা রাখা মুসলমানের জন্য যেমন ফরজ তেমনি জাকাত প্রদান ফরজ। আর্থিকভাবে সচ্ছল মানুষদের ওপর জাকাত আদায় বাধ্যতামূলক। শুধু ধর্মীয় দিকই নয় সামাজিক বৈষম্য রোধ ও মানবিক মূল্যবোধতাড়িত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষেও জাকাত বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

জাকাত একটি আরবি পরিভাষা। এর অর্থ পবিত্রতা, প্রাচুর্যতা, ক্রমবৃদ্ধি এবং প্রশংসা ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায় জাকাত হচ্ছে সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ কোনো অসহায় মুসলমানকে দুনিয়াবি স্বার্থ ছাড়া প্রদান করা। জাকাত হচ্ছে অসহায়, অভাবী, অক্ষম এবং সুবিধাবঞ্চিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্যতা বিমোচনের মূল হাতিয়ার।

জাকাত হচ্ছে একটি মানবিক সমাজ গড়ার হাতিয়ার এবং মানবকল্যাণই জাকাতের মূলমন্ত্র। জাকাত আদায়ের মাধ্যমে একজন মানুষের সম্পদ পবিত্রতা অর্জন করে, আর সেই জাকাতের অর্থ দিয়ে বঞ্চিত মানুষের সমস্যা সমাধান হয়। জাকাত হচ্ছে ধনীদের সম্পদে গরিবের অধিকার, যা আদায় করতে ধনী ব্যক্তিটি বাধ্য।

কাজী নজরুল ইসলাম তার লেখায় বলেছেন- ‘দে জাকাত, দে জাকাত, তোরা দে রে জাকাত, তোর দিল খুলবে পরে, তোর আগে খুলুক হাত’-এ্ই বাণী অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা অনেক সম্পদশালী আছেন যারা সেটি খরচ করতে চান না। অথচ এটি গবিবের অধিকার। কেউ খাবে কেউ খাবে না-এটি ইসলামের নীতি নয়। ইসলাম শান্তির ধর্ম। সমতার নীতি প্রতিষ্ঠায়ই এর মূল কথা।

সমাজে যদি বৈষম্য থাকে, অভাব থাকে, ক্ষুধা থাকে, দারিদ্র্যতা থাকে তাহলে সেই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা কঠিন। সে কারণেই সম্পদের একটি সুষম বণ্টন ব্যবস্থা হচ্ছে জাকাত। আবার জাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের এখানে লোক দেখানো ব্যাপারও কাজ করে। অনেকে মাইকিং করে সস্তায় কেনা কাপড় প্রদান করেন। এতে ভিড়-ঠেলাঠেলিতে অতীতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও সতর্ক থাকতে হবে।

মানব কল্যাণই ইসলামের মূলমন্ত্র। তাই ইসলামের যাবতীয় কর্মই মানব কল্যাণের সাথে সংযুক্ত। মূলত মানব কল্যাণের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই ইসলামের মূল লক্ষ্য। জাকাত তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। জাকাত প্রদানের মাধ্যমে সমাজ থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্যতা, অশিক্ষা এবং অভাবকে দূর করে মানবিক একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই হোক আমাদের লক্ষ্য।

চার.
রমজানে যানজট দূর করতে ট্রাফিক বিভাগকে আরও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। যেখানে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে সেখানে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। যানজট দূর করা, দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখা, ভেজাল বন্ধ করা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ ঠিক রেখে জনভোগান্তি দূর করাই হবে এ মুহূর্তের করণীয়। মানবকল্যাণই গুরুত্বপাক রমজানে-এটিই কাম্য।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর জাগো নিউজ।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/জেআইএম